জাতীয় কবির সঙ্গীত

দৈনিক সিলেট ডট কম
আতিক আজিজ: বাংলা ভাষার অনেক কবিই একাধারে সুরস্রষ্টা ও সঙ্গীতজ্ঞ। এটি হয়তো বাংলার মাটির বৈশিষ্ট্য। উদাহরণস্বরূপ, রামপ্রসাদ, নিধু বাবু, দ্বিজেন্দ্রলাল, রজনীকান্ত, রবীন্দ্রনাথ, অতুল প্রসাদ ও কাজী নজরুল ইসলামের নাম করা যেতে পারে!
বিদ্রোহী কাজী নজরুল ইসলাম বিবিধ বিষয়ে সঙ্গীত রচনায় যে নৈপুণ্য দেখিয়েছেন, আর তাতে সুর যোজনায় যে বৈচিত্র্য সৃষ্টি করেছেন, তা বাস্তবিকই বিস্ময়কর। জাতীয় সঙ্গীত, ঠুংরি,হাসির গান, গজল, ধ্র“পদ, কীর্তন, বাউল, ভাটিয়ালী,টপ্পা,খেয়াল, ইসলাম সঙ্গীত, মর্সিয়া, ভাওয়াইয়া প্রভৃৃতি যে দিকে হাত দিয়েছেন, সেই দিকেই অপূর্ব সফলতা অর্জন করেছেন।
একই ব্যক্তি কেমন করে কীর্তন আর ইসলামী সঙ্গীতে সমান পারদর্শিতা দেখাতে পারেন,তা স্মরণ করে অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। এর কারণ আর কিছু নয়, শুধু এই যে-তিনি কবি সুলভ সহানুভূতিতে হিন্দু-মুসলিম-নির্বিশেষে জন-মনের সঙ্গে একাত্ম হতে পেরেছিলেন বলেই তাদের অব্যক্ত মনোভাব পরিপূর্ণরুপে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছিলেন। বিশেষ করে নিজের মরমী সাধনা আর জন-সংস্পর্শের ফলে, দেশে ধর্মীয়ভাব-তার আদর্শ ও উন্মাদনা-মর্মগ্রাহী ভাবে সুসঙ্গত মধুর বাণীতে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছিলেন।
শুধু গানের সংখ্যার দিক দিয়ে দেখতে গেলে অবশ্যই রবীন্দ্রনাথকে প্রথম স্থান দিতে হয়; কিন্তু তাঁর অনেক গানই প্রথমে কবিতা হিসেবেই রচিত হয়, পরে সেগুলো অন্যের দ্বারা বা তাঁর নিজের দ্বারাই সুরে গাঁথা হয়। রবীন্দ্রনাথের সেই সব গান বাণী-প্রধান, অর্থাৎ সুরের চেয়ে ভাবের আকর্ষণই তাতে বেশী প্রবল। কাজী নজরুল ইসলামের ক্ষেত্রে প্রথমে তাঁর মনে সুর আসতো, তারপর সুরানগত বিষয় এবং বাণীর ‘আবির্ভাব’ হ’ত (এ ক্রিয়াটি এত শীঘ্র ঘটত যে, তাতে ‘আবির্ভাব’ না বলে উপায় নেই।) কাজেই, গানের প্রকৃতি অনুসারে, তাল লয় গত ছেদ বা যতি দিয়ে না পড়লে (অর্থাৎ পদ্য আবৃত্তির মত পড়ে গেলে), অনেক স্থলে একটু খাপ-ছাড়া বলে বোধ হয়। প্রকৃতপক্ষে গান ত কবিতা নয়। সুতরাং এই-ই হওয়া উচিত। নজরুলকে এক সময়ে গ্রামোফোন কোম্পানীর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে অনেক রেকর্ড সঙ্গীত লিখতে হয়েছে। এগুলোকে কবিতা হিসেবে দেখতে যেয়ে অনেক সাহিত্যিক বলে থাকেন যে, নজরুল অনেক ক্ষেত্রে তাঁর কবিধর্ম বিসর্জন দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবিকপক্ষে সঙ্গীতকে বা সঙ্গীতের বাণীকে কবিতা হিসেবে দেখতে যাওয়াই ভুল। নিতান্ত জীবিকার প্রয়োজনে লিখিত গানেও তিনি গায়ক-ধর্ম ভুলেননি, বরং সঙ্গে সঙ্গে তাকে কাব্য-সৌন্দর্যেও মন্ডিত করেছেন। অবশ্য, নজরুল গীতিতে বাণী প্রধান গানও অনেক আছে! তা রবীন্দ্রপ্রভাব বিশেষ লক্ষণীয়। ভাবের গভীরতা আর প্রবলতা দুটো আলাদা জিনিষ। আমার মনে হয়, মোটের উপর গভীরতার দিক দিয়ে নজরুল-গীতি (বা সঙ্গীত) উৎকৃষ্টতর হ’লেও কাব্যের প্রবলতার দিক দিয়ে নজরুল-গীতি (বা বাক্য) নিঃসন্দেহেই শ্রেষ্ঠ। রবীন্দ্র সঙ্গীতে ভগবৎ-প্রেম, মানবীয় প্রেম আর ঋতু-সঙ্গীত ও ক্রিয়া সঙ্গীতের প্রাধান্য। এ সবের ভিতর দিয়ে একটা বিশিষ্ট ঢং গ’ড়ে উঠেছে, যাকে রবীন্দ্র-সঙ্গীত’ নাম দেওয়া হয়েছে। নজরুল-গীতিরও হয়তো একটা সাধারণ ঢং আছে; কিন্তু তার বৈচিত্র্য এত অধিক যে, সবগুলোকে একটা নিজস্ব ‘নজরুলী ঢং’ বলা বোধ হয় সংগত হয় না। তবু সঙ্গীত প্রতিযোগিতাতে রবীন্দ্র সঙ্গীতের মতো ‘নজরুল-গীতি’ ব’লে আর একটা শ্রেণীর রেওয়াজ গ’ড়ে উঠেছে।
কালক্রমে ‘নজরুল-সঙ্গীত’ এরও একটা বিশিষ্ট রূপ গ’ড়ে উঠতে পারে। তবু মনে হয়, উপরে নজরুল-সংগীতের যেসব শ্রেণী বর্ণিত হয়েছে, সেগুলোই নজরুল-গীতি পরিচয়ের জন্য বিশেষ প্রশস্ত।এখানে উল্লেখযোগ্য যে, রেকর্ড সংগীতের অজস্রতা আর দেশী ও বিদেশী মার্গ ও লৌকিক প্রভৃতি বিবিধ সুর সৃষ্টির সংখ্যা-বৈচিত্র্য নজরুল ইসলাম পৃথিবীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ স্থান অধিকার ক’রে রয়েছেন।
গজল গান স্বভাবতই দীর্ঘায়িত এবং একঘেঁয়ে ধরণের। এই একঘেঁয়েমী দূর করবার জন্য তিনি বাংলা গানে উর্দু শে’রের মত আবৃত্তি যোগ্য পদ সংযোজন ক’রে এর বৈচিত্র্য বিধান করেছেন। খেয়াল ধ্র“পদ গানে রীতিমত গাম্ভীর্য আর ভাব সংগীত বজায় রেখেছেন। এই গুলোর মধ্যে ওস্তাদের কাছে শিক্ষার ফল প্রত্যক্ষভাবে লক্ষ্য করা যায়। ঠুংরী ও টপ্পা গানেই নজরুলের বিশেষত্ব বেশী ক’রে ফুটে উঠেছে। সুরের বৈচিত্র্য ও আকম্মিক পরিবর্তন ত আছেই, সঙ্গে সঙ্গে ভাবের এমন তীক্ষè ঝলক অন্যত্র কমই দেখা যায়। দু’ টো উদাহরণ উল্লেখ করা হলোঃ
(ক) কারে মন দিলি কবি,
এ যে রে পাষাণ ছবি,
এ শুধু রুপের রবি নিশীথের স্বপনে।।
(খ) কাজল করি তারে রাখি গো আঁখি-পাতে
স্বপনে যায় সে ধুয়ে গোপন অশ্র“ সাথে।
বুকে তায় মালা করি রাখিলে যায় সে চুরি
বাঁধিলে বলয় সনে মলয়ায় যায় সে উড়ি ॥
কি দিয়ে সে উদাসীর মন মোহি?
(গ) বুকে তোর সাত সাগরের জল, পিপাসা মিটল না কবি,
ফটিক জল খুঁজিস যেথায় কেবলি তড়িৎ ঝলকে
এখানে মানবীয় প্রেমের মধুর ব্যর্থতা আর উদ্দামতা নিরাভরণ সারল্যের সাথে বর্ণিত হয়েছে। ভদ্রতার কৃত্রিমতা মনকে পরিতৃপ্ত করতে পারে, কিন্তু অকুণ্ঠ প্রবলতা হয়ত হৃদয়-বৃত্তির কাছে আরও ঘনিষ্ঠ ব’লে মনে হবে।
বাংলা-সাহিত্যে এ পর্যন্ত যত কীর্তন রচিত হয়েছে, তার মধ্যে নজরুল-রচিত কয়েকটি কীত’ন যে কাব্যাংশে শীর্ষস্থান অধিকার ক’রে রয়েছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। ইসলামী সঙ্গীতের ক্ষেত্রে হাম্দ, নাত,মর্সিয়া ইত্যাদি কবিতা সাধারণ মুসলমান সমাজের মনোবৃত্তিরই রূপায়ণ। এর কথা সরল,ভক্তি প্রধান এবং সচরাচর প্রচলিত উর্দু-গজলের সমপর্যায়ভূক্ত-কাব্যাংশে অনেক স্থলেই হীন। কিন্ত মাঝে মাঝে এমন পদ রয়েছে যা সমুদয় মুসলিম জগতে তুলনাহীন। “আমিনা মায়ের কোলে” আবির্ভূত হযরত মুহম্মদ (দঃ) এর গুণাবলীর মধ্যে রয়েছে- “ব্যথিত মানবের ধ্যানের ছবি”। এ রকম চরণ শেখ সাদী, হালী বা ইকবাল, বারো কবিতায় বা সঙ্গীতে কদাচিৎ দেখতে পাওয়া যায়। নজরুলের ইসলামী গানের সংখ্যাও প্রায় দুই শ’য়ের কাছাকাছি হবে। ডি,এল,রায়ের পরে এ পর্যন্ত আর দেখা যায়নি। ডি,এল,রায়ের মতো সামাজিক ব্যঙ্গ বিদ্রুপ ত আছেই, তা ছাড়া নিছক হাস্য রসের গানও অনেক রয়েছে।
নজরুলকে সুকণ্ঠ বলা যায় না। কিন্তু তাঁর গলায় সুরের যে ব্যঞ্জনা আর ভাবাশ্রায়িতা প্রকাশ পেত তার গুণে তাঁর গানের আসর জম-জমাট হয়ে উঠতো, সে পরিবেশে সকলের মনেই সাড়া জেগে উঠতো। তাঁর গানের রেকর্ডের গায়ক হচ্ছেন কৃঞ্চচন্দ্র দে, ইন্দুবালা, আব্বাসউদ্দীন প্রভৃতি বিখ্যাত শিল্পীবৃন্দ। কিন্তু প্রায় সব গানেরই সুর তার নিজের দেওয়া। তার রেকর্ড-সংগীতের অনেক মহড়াতে তাঁর সুরের তীক্ষè অনুভূতি উপস্থিতি লক্ষণীয়। তাঁর মনে প্রত্যেক গানের সুরের একটা রূপ বিরাজ করতো; শিল্পীদের সুরবিস্তারে সামান্য একটু ভাব-রুপের ব্যতিক্রম হ’লেই, মানানসই সুর বাত্লে দিতেন। এখানে সহজেই প্রশ্ন উঠতে পারে, কাজী নজরুল ইসলাম কি একজন মস্ত বড় ওস্তাদ ছিলেন? এর জবাব এই যে , তিনি এক সময়ে মুর্শিদাবাদের ওস্তাদ মঞ্জু-সাহেবের কাছে বেশ কিছুদিন আনুষ্ঠানিক ভাবে মার্গ-সঙ্গীত সাধনা করেছিলেন; তা ছাড়াও কলিকাতা,ঢাকা,কুমিল্লা প্রভৃতি বহু অঞ্চলের ওস্তাদের কাছ থেকে শুনে কিছু কিছু শিখেছিলেন বটে; কিন্তু যাকে ‘ওস্তাদ’ বলে, তিনি তা ছিলেন না। তবে কবি-প্রকৃতির গুণে সুর তাঁর মনের মধ্যে স্বাভাবিক ভাবে ব’সে গিয়েছিল। এক সময়ে তিনি এই উক্তি করেছিলেনঃ
‘ওস্তাদেরা কেউ গানের বি.এ.কেউ বা এম.এ পাশ। আমি হয়ত ম্যাট্রিক পাশ হলেও হ’তে পারি; কিন্তু এমন কতকগুলো জিনিষ জানি যা এম.এ. পাশ বা ডক্টর উপাধিধারীর যোগ্য।’
এ জিনিষটা বোধ হয় তার স্বাভাবিক সুর-সঙ্গীতবোধ। নজরুলের জাতীয় সংগীতগুলো এত বিখ্যাত যে, সে সন্বন্ধে কিছু না বললেও চলে। এর ভিতর দিয়ে বীর্য দৃঢ় সঙ্কল্প আর জাগরণীর বাণী ধ্বনিত হয়েছে, সুরের ভিতর দিয়ে যুদ্ধের পদক্ষেপ আর কাড়ানাকাড়ার ধ্বনি শোনা যায়।
গানের ভাষার উর্দু ফারসীর সুসঙ্গত মিশ্রণ, এবং সুরে উর্দু ধরণের বিশিষ্ট ঝোঁকের প্রবর্তন ক’রে নজরুল বাংলা সাহিত্য আর সঙ্গীতের সুর-বিন্যাস দুই দিক দিয়েই শ্রীবৃদ্ধি সাধন করেছেন। এছাড়া আরবী,তুর্কী এবং ইরানী, মিস্ রী প্রভৃতি বিদেশীয় সুর আমদানী করে, এবং অন্ততঃ পাঁচ ছয়টা নতুন রাগ সৃষ্টি ক’রে নিজের সঙ্গীত রসজ্ঞতার আর এক প্রমাণ দিয়েছেন।