শাহ আহমদ রেজা: ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে বেশি পরিচিত কবি কাজী নজরুল ইসলাম শিক্ষিত-স্বল্পশিক্ষিত নির্বিশেষে বাংলাদেশী মাত্রের হৃদয়েই ভালোবাসা ও সম্মানের স্থান করে নিয়েছেন। এমনকি নিরক্ষর বা অশিক্ষিত যারা তাদের মধ্যেও কাজী নজরুলের রয়েছে সীমাহীন জনপ্রিয়তা। বাংলাদেশের এই জাতীয় কবি আমাকেও ছোটবেলা থেকে গভীরভাবে আকর্ষণ করেছেন। ১৯৬০-এর দশকে ছাত্র রাজনীতি এবং তদানীন্তন পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরশাসক আইয়ুব-বিরোধী আন্দোলন ও গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বড় হয়েছিলাম বলে নজরুলের কবিতা ও সঙ্গীত আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে। সত্যি বলতে কি, ঘটনাক্রমে কবিতা আবৃত্তি করার বাইরে নজরুলের সাহিত্য খুব বেশি পড়ালেখা না করলেও তার জীবনের বিভিন্ন বিষয়ে বহু আলোচনা শুনেছি। কিছু কিছু পড়েছিও। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী আন্দোলনে নজরুলের ভূমিকা, ভারতের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম, গ্রেফতার ও কারাবাস থেকে দারিদ্র্য, বিয়ে ও পারিবারিক জীবন পর্যন্ত সব বিষয়েই আমাদের আগ্রহ ছিল প্রচুর। কেন ও কিভাবে তিনি বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন এবং চিরদিনের জন্য অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন তা নিয়েও কৌতূহলের অন্ত ছিল না। এ সম্পর্কে নানা কাহিনী শোনা যেতো। এসবের মধ্যে আবার সাম্প্রদায়িক উপাদানও মিশিয়ে দেয়া হতো। বিভ্রান্ত হইনি সত্য, তবে আমরাও জল্পনা-কল্পনা কম করতাম না। এখনো বিশেষ করে নজরুলের ধর্মীয় চিন্তার বিষয়টি আমাকে ভাবিয়ে তোলে। যেহেতু বিস্তারিত পড়িনি এবং গবেষণা করিনি, সেহেতু জোর দিয়ে কিছু বলা সম্ভব নয়। তা উচিতও নয়।
অবশ্য দু-একটি বিষয়ের উল্লেখ তো করা যেতেই পারে। যেমন মুসলমান হলেও কবি বিয়ে করেছিলেন আশালতা সেনগুপ্তাকে, পরে যিনি প্রমীলা নজরুল নামে পরিচিতি পেয়েছেন। তারা কেউই ধর্ম পরিবর্তন করেননি, যার যার ধর্ম পালন করেছেন। শাশুড়ি গিরিবালা দেবী তো বহু বছর নজরুলের পরিবারের সাথেই থেকেছেন। কবির বাসায় তার জন্য সব সময় আলাদা পূজার ঘর থাকত। সেখানে তিনি পূজা-অর্চনা করতেন অবাধে। নজরুল ও প্রমীলা ধর্ম পরিবর্তন না করার কারণে তাদের কেউ বাড়ি ভাড়া দিতে চাইত না। রক্ষণশীল হিন্দুরা এমনকি এ চেষ্টাও করত, যাতে কোনো হিন্দু মালিক তাদের বাড়ি ভাড়া না দেয়। সে কারণে কাজী নজরুলকে হুগলী ও কৃষ্ণনগরের মতো বিভিন্ন শহরে ঘুরে বেড়াতে হয়েছিল। কলকাতায়ও তিনি এক বাড়িতে বেশি দিন বসবাস করতে পারেননি। অভাব ও দারিদ্র্যের পাশাপাশি ধর্মের বিষয়টি তাকে সব সময় তাড়িয়ে বেড়াত। এভাবে অবশ্য কুপোকাত করা যায়নি নজরুল ইসলামকে। কারণ, প্রমীলা ছিলেন তার স্বপ্নের ‘রানী’- যার কাছে তিনি ‘হার ’ মেনেছিলেন ‘আজ শেষে’।
কাজী নজরুল তার প্রথম ছেলের নাম রেখেছিলেন ‘কৃষ্ণ মোহাম্মদ’। আজাদ কামালও তারই নাম ছিল, কিন্তু বেশি আলোচিত ও পরিচিত হয়েছে ওই কৃষ্ণযুক্ত নামটি। নামের দ্বিতীয় অংশের তাৎপর্য নিয়ে সম্ভবত কথা বাড়ানোর দরকার পড়ে না। এটুকু বলাই যথেষ্ট যে, ধর্মের ব্যাপারে নজরুলকে এক বিচিত্র ভাবনা ও ইচ্ছা পেয়ে বসেছিল। কবির দ্বিতীয় ছেলের নাম ছিল অরিন্দম। অন্য দুই ছেলে কাজী সব্যসাচী ও কাজী অনিরুদ্ধ- নাম দু’টিও কালের পরিপ্রেক্ষিতে ঠিক মুসলমানসুলভ ছিল না। বিয়ে বা সন্তানদের নাম সম্পর্কেই শুধু বলা কেন, লেখালেখিতেও তো কম দেখাননি নজরুল। হিন্দুদের পুরাণ ও মহাভারতের কাহিনীনির্ভর ‘শকুনিবধ’,‘রাজা যুধিষ্ঠিরের ‘সং’ ও ‘দাতা কর্ণ’সহ অসংখ্য নাটক ও রচনা রয়েছে তার। হিন্দুদের মতো শক্তিরও পূজারী ছিলেন তিনি। শিব, লক্ষ্মী, সরস্বতী এবং রাধা ও কৃষ্ণসহ হিন্দুদের দেব-দেবীদের নিয়ে শ্যামা সঙ্গীত, ভজন, আগমনী ও কীর্তনও তিনি অনেক রচনা করেছেন।
একই নজরুল আবার প্রধানত ফার্সি ও উর্দুতে রচিত গজলের অনুকরণে বাংলায় গজল লিখেছেন। গোলাপের কাছে জানতে চেয়েছেন, এই ফুল নবীর তথা রাসূলুল্লাহ সা:-এর পায়ে চুমু খেয়েছিল বলেই তার খুশবু আজও গোলাপের তৈরি আতরে পাওয়া যায় কি না? বুলবুলিকে জিজ্ঞেস করেছেন, রাসূলুল্লাহ সা:-এর নাম জপেছিল বলেই তার কণ্ঠও এত মধুর হয়েছে কি না। পবিত্র আল কুরআন, মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা:, নামাজ, রোজা, হজ ও জাকাতও এসেছে নজরুলের প্রধান বিষয় হিসেবে। হজরত ওমর রা:, হজরত আলী রা: প্রমুখকেও কাজী নজরুল ইতিহাসের আলোকে সাবলীলভাবে উপস্থাপন করেছেন। তিনি ধর্মান্ধতার শিকার হননি বরং পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন, ‘টিকি’ রাখলেই হিন্দু পণ্ডিত হওয়া যায় না, মুসলমান মোল্লা হওয়া যায় না ‘দাড়ি’ রাখলেই। নজরুল ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে ‘মানুষ’ হওয়ার জন্য হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টানদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন।
কে জানে, এভাবেই নজরুলের ভেতরে নতুন ধরনের কোনো ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক চিন্তা দৃঢ়মূল হয়েছিল বা হচ্ছিল কি না। এখানে কাজী নজরুল সম্পর্কে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর খুবই তাৎপর্যপূর্ণ একটি মন্তব্য স্মরণ করা যায়। ভাসানী শুধু একজন রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না, পীর বা দরবেশ হিসেবেও তার পরিচিতি রয়েছে। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের পাশাপাশি আসামসহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে তার মুরিদের সংখ্যা কয়েক লাখ। নজরুল প্রসঙ্গে মওলানা ভাসানীকে হঠাৎ টেনে আনার বিশেষ কারণ রয়েছে। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, কাজী নজরুল ও মওলানা ভাসানীর শৈশব ও কৈশোরের মধ্যে অনেক মিল রয়েছে। অভিভাবকহীন অবস্থায় নজরুল তথা ‘দুখু মিয়া’ ওই বয়সে এক খুঁটি থেকে অন্য খুঁটিতে গেছেন। ‘চ্যাকা মিয়া’ নামে পরিচিত মওলানা ভাসানীর অবস্থাও ছিল নজরুলের মতোই। কৈশোরে ‘দুখু মিয়া’ যাত্রা দলে যোগ দিয়েছিলেন। ‘চ্যাকা মিয়া’ নামের মওলানা ভাসানীকেও কৈশোরে এদের সাথেই একটা সময় কাটাতে হয়েছিল। নজরুল ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে বিখ্যাত হয়েছিলেন, মওলানা ভাসানীও সারা জীবন শুধু সংগ্রামই করেছেন। তিনি বিখ্যাত হয়েছিলেন ‘প্রোফেট অব ভায়োলেন্স’ এবং ‘লাল’ মওলানা নামে। ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের সময় বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী সাপ্তাহিক ‘টাইম’ ম্যাগাজিন এই ‘প্রোফেট অব ভায়োলেন্স’ ভাসানীকে নিয়েই প্রচ্ছদ কাহিনী প্রকাশ করেছিল।
১৯২৮ থেকে ১৯৪০ পর্যন্ত সময়কালে মওলানা ভাসানীর সাথে কবি নজরুলের বহুবার দেখা ও কথা হয়েছে। আসাম মুসলিম লীগের সভাপতি হিসেবে মওলানা ভাসানী সে সময় অবিভক্ত বাংলা ও আসামের বিভিন্ন এলাকায় বহু কৃষক-প্রজা সম্মেলন করেছেন। কিন্তু অনেক ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মূলত ভবঘুরে ধরনের স্বভাবের কারণে কবি নজরুলকে কোনো সম্মেলনে অতিথি করে আনতে পারেননি। এই দুঃখের কথা তিনি নিকটজনদের কাছে বলেছেন। নজরুল সম্পর্কে মওলানা ভাসানীর চিন্তাভাবনা ঠিক সাধারণ মানুষের মতো ছিল না। যেমন তিনি মনে করতেন, ১৯৩৭ থেকে ১৯৪০ সালের মধ্যে নজরুল আধ্যাত্মিক সাধনায় গভীরভাবে মনোনিবেশ করেছিলেন। কিন্তু মুসলিম পীর বা সুফিদের তরিকার সাথে বৈদিক তন্ত্র-মন্ত্রের অনুশীলন ও মিশ্রণ ঘটাতে গিয়ে নজরুল সম্ভবত ভারসাম্য রাখতে পারেননি, দিকভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন। এটাই স্বাভাবিক। কারণ, মুসলমানদের ক্ষেত্রে পীর-দরবেশের এবং হিন্দুদের ক্ষেত্রে গুরুর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধান তথা নির্দেশনা ও পরিচালনা ছাড়া কোনো ব্যক্তির পক্ষে আধ্যাত্মিক সাধনায় সফল হওয়া সম্ভব নয়। তাকে দিকভ্রান্ত হতেই হবে। এ জন্যই বহু মানুষকে এখনো পাগল হয়ে যেতে দেখা যায়। ভাসানী অনুসারী অনেকের ধারণা, মওলানা ভাসানী সম্ভবত বোঝাতে চাইতেন, দেহ ও মনোজগতে আধ্যাত্মিক ও জাগতিক বিভিন্ন বিষয়ের প্রচণ্ড সংঘর্ষের পরিণতিতেই নজরুল বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন।
মওলানা ভাসানী তার এক কৌতূহলী ভক্তকে বলেছিলেন, নজরুল ‘যে দেখা দেখতে গিয়ে’ নিজেই অন্যের ‘দেখার বিষয়ে’ পরিণত হয়েছেন, তার ‘খোঁজ’ করো না কেন? নজরুলের উপলব্ধি সম্পর্কে বুঝতে হলে প্রথমে সেই জগতে পৌঁছতে হবে, যে জগতে তার বিচরণ ছিল। মওলানা ভাসানীর এই কথাটা নিছক কথার কথা ছিল না।
স্বাধীনতার পর কবিকে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হলে মওলানা ভাসানী একবার ধানমন্ডির বাসভবনে তাকে দেখতে গিয়েছিলেন। এটা ১৯৭২ সালের মে মাসের শেষ বা জুন মাসের প্রথম দিকের ঘটনা। ‘হক-কথা’ সম্পাদক সৈয়দ ইরফানুল বারী লিখেছেন, ‘নজরুল নিচের তলায় একটি লম্বা সোফায় ছেলেমানুষের মতো জড়সড় হইয়া চোখ বুজিয়া শুইয়া ছিলেন। মেঝেতে কার্পেট বিছানো ছিল। হুজুর (মওলানা ভাসানী) সরাসরি নজরুলের সম্মুখে গিয়া (যেভাবে নামাজে বসিতে হয়) বসিলেন। কবি ভবনের আঙ্গিনায়, বারান্দায় ও ভিতরে মানুষ গমগম করিতেছিল। কবির মুখাবয়বের দিকে হুজুর এক দৃষ্টিতে কতক্ষণ তাকাইয়া রহিলেন। এর মধ্যে কবি দুইবার কি তিনবার চোখ মেলিয়া তাকাইলেন। অতঃপর বুজিয়া যেভাবে শুইয়াছিলেন সেই ভাবেই শুইয়া রহিলেন। হুজুর মিনিট তিনেক চোখ বুজিয়া বসিয়া রহিলেন। অতঃপর কাগজ কলম চাহিয়া লইলেন এবং তাহাতে কবির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করিয়া এবং তাঁহাকে দোয়া করিয়া ৭-৮টি বাক্য লিখিলেন।’ (সৈয়দ ইরফানুল বারী, ‘আমার ভালোবাসা মওলানা ভাসানী’, ২০০৪; পৃষ্ঠা- ৬৩-৬৬)
মাত্র কয়েক মিনিটের হলেও এই ঘটনার মধ্যে চিন্তার যথেষ্ট খোরাক রয়েছে। তা ছাড়া কবি নজরুলের আধ্যাত্মিক সাধনা প্রসঙ্গে মওলানা ভাসানীর কথাগুলো নিয়েও বিশেষভাবে চিন্তা করা দরকার। এর মধ্য দিয়ে কবি নজরুল সম্পর্কে নতুন কোনো সিদ্ধান্ত বা উপসংহারও বেরিয়ে আসতে পারে।
লেখক : সাংবাদিক ও ইতিহাস গবেষক
ই-মেইল : shahahmadreza@yahoo.com
