যেভাবে বাংলাদেশের প্রেমে পড়ল এই মার্কিন পরিবার

বাংলাদেশ-ভারত ফুটবল ম্যাচে দর্শক গ্যালারিতে বেঙ্গল টাইগার থিমে সাজা একটি বিদেশি পরিবারের ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খুব ভাইরাল হয়েছে। মা–বাবা আর পাঁচ শিশুসন্তানের কারও মাথায় লাল-সবুজ, কারও গালে লাল-সবুজ। এঁরা কারা, কবে থেকে বাংলাদেশ ফুটবল দলের সমর্থক? খোঁজখবর করলেন জাওয়াদুল আলম

বাংলাদেশ-ভারত ফুটবল ম্যাচ। শুরু থেকেই টানটান উত্তেজনা। ১১ মিনিটের মাথায় শেখ মোরছালিনের গোল গ্যালারির বাংলাদেশের সমর্থকদের পাগল করে তুলল। টিভি পর্দায় তখন ভিনদেশি এক পরিবারকে বাংলাদেশের জন্য গলা ফাটাতে দেখা গেল। ওই পরিবারের সাত সদস্য বেঙ্গল টাইগারের আদলে সেজেছেন।

মা–বাবা আর পাঁচ শিশুসন্তান। কারও মাথায় লাল-সবুজ ব্যান্ডানা। কারও গালে বাংলাদেশের পতাকা। টিভি পর্দায় আরও কয়েকবারই তাঁদের দেখা গেল। পরিবারটির পরিচয় জানার কৌতূহল হলো। পরে ফেসবুকের মাধ্যমে খুঁজে পেলাম ‘জ্যাকব ভাইয়া’ নামে একটি পেজ। সেই সূত্রেই জানা গেল পরিচয়।

ভিনদেশি এই দম্পতি হলেন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক জ্যাকব বার্লিন আর জয়া বার্লিন। তবে বাংলাদেশই এখন তাঁদের আপন ঠিকানা। জ্যাকব পেশায় কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট। ঢাকার গুলশানে তাঁর কাউন্সেলিং সেন্টার আছে।

এ ছাড়া ‘অ্যাকশন-জয় এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড’ নামে বাংলাদেশে নিজেদের একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও গড়ে তুলেছেন জ্যাকব–জয়া। ফরিদপুরের সুবিধাবঞ্চিত নারীদের তৈরি বিভিন্ন সামগ্রী যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রি করেন তাঁরা।

পরিবারটির সঙ্গে আলাপ–পরিচয় করতে একদিন গুলশানে জ্যাকবের কাউন্সেলিং সেন্টারে হাজির হই। প্রথমে এলেন জয়া বার্লিন, কিছুক্ষণ পর আড্ডায় যোগ দিলেন জ্যাকব। জ্যাকবের পরনে কালো পাঞ্জাবি আর গ্যাবার্ডিন প্যান্ট। জয়া পরেছিলেন সালোয়ার–কামিজ। দুজনের পোশাক আর ঝরঝরে বাংলা শুনে ভুলেই গিয়েছিলাম, ভিনদেশি কোনো দম্পতির সঙ্গে আড্ডা চলছে।

আলাপে জানলাম, বাংলাদেশ বনাম হংকং চায়নার ফুটবল ম্যাচ দেখতে প্রথম সপরিবার মাঠে গিয়েছিলেন তাঁরা। মুঠোফোন থেকে সেদিনের ছবিও দেখালেন জয়া। পরিবারের সবাই সেদিন বাংলাদেশের জার্সি পরেছিলেন। তবে জ্যাকব পরেছিলেন লুঙ্গি আর বুকে আঁকা ছিল বাংলাদেশের পতাকা।

আলাপে বুঝলাম, স্বামী-স্ত্রী দুজনেই ফুটবল ভালোবাসেন। নিয়মিত ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ দেখেন। সেই সূত্রে তাঁরা হামজার ভক্ত। কয়েক মাস আগে যখন জানতে পারলেন, বাংলাদেশের জাতীয় দলে খেলবেন হামজা, তখন থেকে তাঁরা বাংলাদেশের ফুটবলের খোঁজখবরও রাখা শুরু করেন।

শুধু বাংলাদেশে বসবাস নয়, বাংলাদেশকে ধারণ করে এই পরিবার। তাঁরা সবাই বাংলা ভাষা রপ্ত করেছেন। ছেলেমেয়েদের বাংলাও চমৎকার। এমনকি আদর করে ছেলেমেয়েদের বাংলা ডাক নামও রেখেছেন জয়া–জ্যাকব—আনন্দ, হাসি, খুশি, সুখী ও মিষ্টি।

জ্যাকব-জয়ার বাংলাদেশপ্রেম এক যুগের বেশি পুরোনো। একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার প্রকল্পে চাকরিসূত্রে ২০১৩ সালে বাংলাদেশে এসেছিলেন তাঁরা। সেবার টানা ছয় বছর বাংলাদেশে বাস করেন তাঁরা।

প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যান এই দম্পতি। এরপর নিজ দেশে ব্যবসা শুরু করেন জ্যাকব ও জয়া। তবে মাসখানেক যুক্তরাষ্ট্রে থাকার পর দুজনেই অনুভব করেন, মার্কিন মুলুকে তাঁদের মন টিকছে না।

কয়েক হাজার মাইল দূরের ফরিদপুরের মেঠো পথে পড়ে আছে তাঁদের মন। তত দিনে দুনিয়াজুড়ে করোনা শুরু হয়ে গেছে। ফলে হুট করে বাংলাদেশে ফেরাটা সহজ ছিল না। মহামারির সময় বাড়িতে বসেই বাংলাদেশে ব্যবসা শুরুর ছক আঁকেন দুজন।

অবশেষে ২০২২ সালে আবার পরিবার নিয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসেন তাঁরা।

বর্তমানে তাঁদের প্রতিষ্ঠানে ৪০ জন স্থায়ী কর্মী চাকরি করেন। এ ছাড়া ফরিদপুরের বিভিন্ন উপজেলার সুবিধাবঞ্চিত এবং আগে যৌন পেশায় জড়িত ছিলেন—এমন পাঁচ শতাধিক নারী প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে যুক্ত আছেন। এই নারীদের তৈরি ও নকশা করা ব্যাগ, ওয়ালেট, কুশন কভারসহ বিভিন্ন সামগ্রী সরাসরি কিনে যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রি করেন জ্যাকব ও জয়া।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ২০০৯ সালে জ্যাকব ও জয়ার পরিচয়। তখন তাঁদের মধ্যে টুকটাক যোগাযোগ ছিল। এরপর ২০১১ সালে চাকরি নিয়ে তিন মাসের জন্য পটুয়াখালীতে আসেন জ্যাকব। বাংলাদেশের মানুষের আতিথেয়েতায় মুগ্ধ হন।

জ্যাকব বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন দেশের মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে আমার ভালো লাগত। অন্য দেশের সংস্কৃতি জানার প্রতি আমার বেশ আগ্রহ। সব সময় মনে মনে চাইতাম, সম্পূর্ণ ভিন্ন সংস্কৃতির এক দেশে গিয়ে চাকরি করব। বাংলাদেশে তিন মাস থাকার পর মনে হলো কল্পনার সেই কর্মস্থল বাস্তবে খুঁজে পেয়েছি।’

ওই বছরই দেশে ফিরে জয়াকে বিয়ে করেন জ্যাকব। মজার ব্যাপার হলো বিয়ের কয়েক মাস পর নববধূকে নিয়ে মধুচন্দ্রিমায় বাংলাদেশে আসেন জ্যাকব। আগেই অবশ্য জয়াকে বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের ভাবনার কথা জানিয়েছেন তিনি।

জ্যাকব বলেন, ‘বাংলাদেশ সম্পর্কে জয়ার কোনো ধারণা ছিল না। যেই দেশে স্থায়ীভাবে থাকার পরিকল্পনা করছি, সেটি তো জয়াকে দেখাতে হবে। তাঁর পছন্দ না হলে তো আর বাংলাদেশে থাকা সম্ভব হবে না।

ওই সময় আমরা এক মাসে ঢাকা, সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী, ফরিদপুর আর পটুয়াখালী ঘুরে বেড়ালাম। তবে বাংলাদেশ তখন জয়ার খুব একটা মনে ধরেনি। আমি এটি নিয়ে খুব টেনশনে ছিলাম। কিন্তু জয়া আমাকে এত ভালোবাসে যে আমার প্রস্তাব আর ফেরাতে পারেনি।’

২০১৩ সালে বাংলাদেশে চাকরি নিয়ে স্থায়ীভাবে ঢাকায় থাকতে শুরু করেন জ্যাকব আর জয়া। তবে ঢাকার নাগরিক কোলাহল তাঁদের পছন্দ হচ্ছিল না। তাই ঢাকার বাইরে কোনো জেলা শহরে বদলির আবেদন করেন জ্যাকব।

জ্যাকব আর জয়া একসঙ্গেই বলে উঠলেন, বাংলাদেশের আসল সৌন্দর্য দেখতে হলে গ্রামের বিকল্প নেই। অবশেষে ২০১৪ সালের তাঁদের আশা পূরণ হলো। প্রকল্প পরিচালক হিসেবে ফরিদপুরে জ্যাকবের বদলি মঞ্জুর হলো। কাজের অংশ হিসেবে স্থানীয় শিশু-কিশোর আর তরুণদের ইংরেজি শেখাতেন জ্যাকব। আর জয় তখন পুরোদস্তুর গৃহিণী।

যুক্তরাষ্ট্রে বেশ আদর আর স্বাচ্ছন্দ্যেই বড় হয়েছেন জয়া। সেই আয়েশি জীবন ছেড়ে বাংলাদেশের মফস্‌সল এলাকায় সংসার! জয়ার বয়স তখন সবে ২৫। কীভাবে ভিন্ন এই জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নিলেন—জানতে চাইলাম।

জয়া হেসে বলেন, ‘সত্যি বলতে, শুরুতে বাংলাদেশ একদমই ভালো লাগত না। ভাষাগত পার্থক্য ছিল। আবার সাংস্কৃতিক পার্থক্যও অনেক। আমার স্বামীর অনুরোধেই বাংলাদেশে আসার সিদ্ধান্ত নিই। তারপর তো ধীরে ধীরে এখানকার মানুষের মায়ায় পড়ে গেলাম।

ফরিদপুরে থাকার সময় একটা সরকারি প্রকল্পে খণ্ডকালীন কাজের সুযোগ পেয়েছিলাম। তখন যৌনপল্লির অনেক নারীর মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করি। ওই কাজের অভিজ্ঞতা আমার জীবনের দর্শন অনেকটা ঘুরিয়ে দেয়।

এর পর থেকে বাংলাদেশ আমার কাছে আরও আপন লাগতে শুরু করে। ফরিদপুরের প্রতিবেশীদের কাছ থেকেই বাংলা শিখেছি, বাংলাদেশের রান্না শিখেছি। এখন আমাদের পরিবারে প্রায় প্রতিদিনই বাংলা খাবার রান্না হয়।’

বর্তমানে ফরিদপুর আর ঢাকা মিলেই তাঁরা বাস করেন। সন্তানেরা ঢাকায় পড়াশোনা করে। বাংলাদেশের পরিবেশের সঙ্গেও দারুণ মানিয়ে নিয়েছে তারা। ছুটিতে যুক্তরাষ্ট্রে দাদা বা নানাবাড়ি বেড়াতে গেলেও তাদের মন বাংলাদেশেই পড়ে থাকে।

জ্যাকব আর জয়া বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পাওয়ার স্বপ্ন দেখেন। নাগরিকত্ব পেলে ফরিদপুরে একখণ্ড জমি কিনে একটি বাড়ি তৈরি করতে চান তাঁরা। আর সেখানেই কাটিয়ে দিতে চান বাকি জীবন।

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন