কাঠের শিল্পে ঘুরছে চার গ্রামের ভাগ্যের চাকা

গ্রামে ঢুকতেই কানে ভেসে আসে মোটরের শোঁ শোঁ আওয়াজ। সঙ্গে বাটালির ঠুকঠাক শব্দ। একটি-দুটি নয়, ঘরে ঘরে এমন শব্দ; যার সঙ্গে মিশে রয়েছে সুরেলা ভাব। এ আর কিছুই না, কাঠ দিয়ে শিল্পকর্ম তৈরির শব্দ।

যশোর শহর থেকে দক্ষিণে ৩৫ কিলোমিটার দূরের আলতাপোল, কন্দর্পপুর, বড়েঙ্গা ও মঙ্গলকোট গ্রামজুড়ে মোটর, হাতুড়ি-বাটালি আর কাঠের শৈল্পিক ছন্দে যে কারও মন ভরে যায়। বাড়িতে বাড়িতে গড়ে ওঠা টিনের দোচালায় ছোট ছোট এসব কারখানায় ঘূর্ণায়মান কাঠের টুকরোতে বাটালির ছোঁয়ায় তৈরি হচ্ছে বাহারি ফুলদানি, মোমদানি, ছাইদানি, বাটি, পাউডার কেইস, বয়াম, চরকা, খুন্তি, বেলুন, টাকা জমানোর ব্যাংক, সিঁদুরদানি, টিফিন বক্স, হামানদিস্তা, চামচসহ নিত্যব্যবহার্য নানা পণ্য। পাশাপাশি নানা রকম শোপিসও তৈরি হচ্ছে। সারাবছরই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাঠ দিয়ে নিত্যব্যবহার্য সামগ্রী তৈরির ধুম থাকে গ্রাম চারটিতে।

কেশবপুর উপজেলার আলতাপোল গ্রামের আনছার আলীর হাত ধরে গ্রামগুলোয় এই শিল্পের বিকাশ। নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে ভারত থেকে শিখে এসে এই কুটিরশিল্পের কাজ শুরু করেন তিনি। অল্পদিনেই সাফল্যের মুখ দেখেন। তাঁর দেখাদেখি আলতাপোল, কন্দর্পপুর, বড়েঙ্গা, মঙ্গলকোটসহ আশপাশের গ্রামগুলোর অনেকেই জড়িয়ে পড়েন এই শিল্পের সঙ্গে। দিন দিন এ শিল্পকর্মের প্রসার ঘটছে। বর্তমানে কেশবপুরের ওই চার গ্রামেই রয়েছে অন্তত ৪০০ কারখানা। এসব কারখানায় মালিক-শ্রমিক ও কাঠ ব্যবসায়ী মিলিয়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কমপক্ষে ২০ হাজার মানুষের জীবিকা জুটছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিটি পরিবারের নারী-পুরুষ, এমনকি শিশুরাও এখন কাঠের শিল্পে পারদর্শী। নারীরা নিয়মিতভাবে এ কাজে যুক্ত হওয়ায় আয় বেড়েছে পরিবারের। চার গ্রামে মাসে তাদের বেচাকেনা প্রায় ১০ কোটি টাকা।

আলতাপোল গ্রামের একটি কারখানার মালিক নজরুল ইসলাম জানান, মূলত মেহগনি কাঠ থেকে এসব জিনিসপত্র তৈরি করেন তারা। বেশ আগে থেকেই এই কাজ শুরু হলেও প্রসার ঘটে এ অঞ্চলে বিদ্যুৎ আসার পর। তাঁর অধীনে আটজন শ্রমিক কাজ করছেন। সব খরচ বাদ দিয়ে মাসে ৩০-৪০ হাজার টাকা লাভ থাকে তাঁর।
আলতাপোল গ্রামের বাসিন্দা অজিয়ার রহমান কাঠের তৈরি জিনিসপত্র বরিশালে পাঠানোর জন্য বস্তায় ভরছিলেন। পুরোনো দিনের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলতে লাগলেন, বছর ১৫ আগে অন্যের জমিতে কামলা (দিনমজুরি) খাটতেন তিনি। এরপর শুরু করেন কাঠের ব্যবসা। পরে পাশের গ্রামের একজনের দেখাদেখি নিজের বাড়িতেই একটি কারখানা গড়ে তোলেন। ওই কারখানায় মেহগনি কাঠ থেকে মোমদানি, ফুলদানি, কলমদানি, বাটি, পাউডার কেস, বয়াম, ডিম সেটসহ নানা ধরনের শোপিস তৈরি করতে থাকেন। তাঁর ভাষ্য, প্রথম দিকে স্থানীয় বাজারে এগুলো বিক্রি করতেন। পরে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, কুষ্টিয়া, বাগেরহাট, পাবনাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অর্ডার আসতে শুরু করে। ঘুরতে থাকে তাঁর ভাগ্যের চাকা। তাঁর কারখানায় এখন কাজ করছেন ১৫ জন শ্রমিক। কারখানাটি আরও বড় করার স্বপ্ন দেখছেন তিনি। স্থানীয় কয়েকজন শ্রমিক জানান, গ্রামে তৈরি এসব কাঠের সামগ্রী ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলায় যাচ্ছে। পাইকাররা বাড়িতে এসেই কিনে নিয়ে যাচ্ছেন।

এই শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা জানান, পাইকারি মূল্যে মোমদানি বিক্রি হয় প্রতিটি ১২ থেকে ১৫ টাকা, ফুলদানি মাপ অনুযায়ী ১৫ থেকে ৫৫ টাকা, কলমদানি ২৫, বাটি ৭০ থেকে ১২০, পাউডার কেস ৪০, বয়াম ৩৫ থেকে ৪৫, ডিম সেট ৮০, হামানদিস্তা ৮৫ থেকে ১৫০, চরকা ৫ থেকে ৭, খুন্তি ১০ থেকে ৩০ টাকা, লেবু চাপা ৪০ থেকে ৬০ টাকা, বেলুন ২০ থেকে ২৫ টাকা, জমানো ব্যাংক ৯০-১০০ টাকা।

খুচরা পর্যায়ে প্রতিটি পণ্য ৫ থেকে ১০ টাকা বেশি দরে বিক্রি হয়। তবে স্থানভেদে আরও বেশি দামে বিক্রি হয়ে থাকে। গ্রামে তৈরি এসব কাঠের সামগ্রী ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় যাচ্ছে। পাইকাররা বাড়ি এসেই কিনে নিয়ে যান তাদের পণ্য। অনলাইনেও অর্ডার অনুযায়ী পণ্য সরবরাহ করে থাকেন তারা।
মঙ্গলকোট গ্রামে ভাই ভাই কুটিরশিল্পে প্রবেশ করে দেখা গেল শ্রমিকদের ব্যস্ততা। এ প্রতিবেদকের নানা প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময়ও থেমে নেই নিত্যব্যবহার্য পণ্য তৈরির কাজ। তৌফিক নামে এক শ্রমিক মেহগনি গাছের কাঠ দিয়ে মিনিট দুয়েকের ভেতর একটি বেলুন বানিয়ে দেখালেন। জানালেন, প্রতিটি জিনিস বানাতে ৪ থেকে ৫ মিনিট সময় লাগে তাঁর। তাঁর ভাষ্য, ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করেন শ্রমিকরা। অনেক শ্রমিক মাসিক বেতনে কাজ করলেও অনেকে কাজ হিসেবে টাকা নিয়ে থাকেন। তিনি জানান, প্রতিটি ফুলদানি, বয়াম, পাউডার কেস, অ্যাশট্রে ৪ টাকা করে, কলস ও বাটি ২ টাকা করে, ডিম সেট, চুরির আলনা ৮ টাকা করে, খুনতি ৩ টাকা, বড় বয়াম ১৫ টাকা হিসেবে পারিশ্রমিক দেওয়া হয়।

কারখানা শ্রমিক সফিউল জানান, প্রতিদিন তারা সব মিলিয়ে ১০০ থেকে ১৫০টি খেলনা বা তৈজসপত্র তৈরি করতে পারেন। প্রতিটির মজুরি হিসেবে ২ থেকে ৭ টাকা পর্যন্ত পান। গড়ে দিনে ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা আয় হয় তাদের। তিনি বলেন, এ কাজ করে ভালোভাবেই সংসার চলছে তাদের।

সুজিত বিশ্বাস নামে আরেক শ্রমিক জানান, চার গ্রামে এখন কেউ বেকার বসে থাকেন না। সবাই কোনো না কোনোভাবে এ কুটিরশিল্পের সঙ্গে যুক্ত। দিন-রাত এসব কারখানায় কাজ হয়। অনেক নারী শ্রমিকও কাজ করছেন।

স্থানীয়রা জানালেন, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই গ্রামের শত শত মানুষ মিলে গড়ে তুলেছেন এই শিল্প। বছর দুয়েক আগে সরকারি কিছু সহযোগিতা পেলেও ঋণের সুদ বেশি হওয়ায় আগ্রহ কম তাদের। এই শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা জানান, এক যুগ আগেও গ্রামগুলোর অনেক মানুষ কাজের অভাবে জীবিকা নির্বাহ করতে হিমশিম খেতেন। এখন সে মানুষরাই সারাদিন থাকেন কর্মমুখর। নিজেদের অর্থনৈতিক সচ্ছলতার পাশাপাশি গ্রামগুলোতেও লেগেছে উন্নতির ছোঁয়া।

বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড (বিআরডিবি) যশোরের উপপরিচালক বিএম কামরুজ্জামান বলেন, কেশবপুরের গ্রামগুলোয় তৈরি এসব পণ্য সারাদেশে সমাদৃত হচ্ছে। ইতোমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের উন্নত প্রশিক্ষণ, ঋণদান কর্মসূচিসহ নানান উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এসব পণ্যের মান আরও উন্নত ও উৎপাদিত পণ্য বিশ্বের অন্যান্য দেশে বাজারজাতকরণের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। তাদের এসব পণ্য উৎপাদনসহ নানা সহযোগিতার অংশ হিসেবে ঋণ দেওয়া হচ্ছে।

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন