শুভজন্মদিন
কবি মুহিত চৌধুরী : বহুমাত্রিক প্রতিভার এক অনন্য আলোক

মানুষ শুধু প্রাণে বাঁচতে চায় না এ পৃৃথিবীতে, নিজের সাক্ষর কিংবা পদচিহ্ন এঁকে অমর হয়ে থাকতে চায় মৃত্যুর পরও। জীবিতকালে তাই সময় ও সমাজের বুকে আঁকে অস্তিত্বের চিহ্ন। কবিতা, সাহিত্য, সংগীত, সাংবাদিকতা কিংবা সংস্কৃতি-সবই মানুষের আত্মপ্রকাশের মাধ্যম। আর এই বহুমাত্রিক সৃজনযাত্রার এক উজ্জ্বল প্রতিভা কবি মুহিত চৌধুরী। যিনি কবি, সাংবাদিক, গীতিকার, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার ও সংগঠক-সব ভূমিকায়ই আলোকিত ও সার্থক।
কবি মুহিত চৌধুরী শুধু একজন সাহিত্যিক নন, তিনি এক বহুমাত্রিক সৃষ্টিশীল ব্যক্তিত্ব। কবিতা, নাটক, গান, গবেষণা ও সাংবাদিকতা- প্রাতটি ক্ষেত্রেই তাঁর স্বতন্ত্র পদছাপ রয়েছে। চার দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি সাহিত্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত। তিনি বাংলাদেশ বেতারের ‘ক’ শ্রেণির গীতিকার ও নাট্যকার। বাংলাদেশ বেতারে তাঁর লেখা অসংখ্য গান ও নাটক প্রচারিত হয়েছে। তাঁর রচিত অনেক গান শ্রোতাপ্রিয়তা পেয়েছে। মুহিত চৌধুরীর গানে যেমন আছে দেশপ্রেম ও মানবতা, তেমনি আছে প্রকৃতি ও সময়চেতনার সুর।
মানবতাবাদ, দেশপ্রেম ও জীবনের গভীর অনুভব তাঁর রচনায় বারবার ফিরে আসে। তাঁর সৃষ্টিতে মিশে আছে সিলেটের মাটির গন্ধ, প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা এবং মানুষের প্রতিঅকৃত্রিম ভালোবাসা। সব নিয়েই আজ কবি মুহিত চৌধুরী এক আলোকিত নাম-যার আলো ছড়িয়ে পড়বে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তর।
আশির দশক ছিল বাংলা কবিতার নতুন জাগরণের সময়। গদ্যের ভেতর থেকে কবিতা তখন ফিরে পাচ্ছিল ছন্দ, ঐতিহ্য ও মানবতার মূল সুর। কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ লিখেছিলেন-‘গদ্য কবিতার নিরগল পশ্চাদ্বাবন ছেড়ে নতুন প্রজন্মের কবিরা ফিরেছে ছন্দে, ঐতিহ্যে এবং নতুন পরীক্ষায়।’
এই ধারার অন্যতম প্রাণপুরুষ মুহিত চৌধুরী। তাঁর কবিতায় প্রতিবাদ, প্রেম, সময় ও সমাজ একাকার হয়ে যায় অনবদ্য ভাষায়।
মুহিত চৌধুরী শব্দের শহরে দাঁড়িয়ে এক মানুষ, কলম হাতে স্বপ্ন বুনেন নীল আকাশে-তাঁর চোখে সিলেটের সকাল, তার কণ্ঠে প্রতিবাদের বজ্রধ্বনি। তিনি জানেন- কবিতা শুধু ছন্দ নয়, কবিতা মানে দায়িত্ব, মানবতার মুখে আলো ধরার সাধনা। তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘নিলামে উঠুক তোমার পৃথিবী’ মানবতার অবক্ষয়, যুদ্ধবিরোধিতা ও প্রেমের নান্দনিক মিশেলে এক অনন্য সৃষ্টি।
তিনি লিখেছেন-
‘এবার নিলামে উঠুক
ক্রোধ-হিংসা এবং প্রবঞ্চনে ভরা
তোমার পৃথিবী,
যে পারে সে কিনে নেবে-
তাতে আমার কী।’

স্বৈরাচারের নির্মম অন্ধকারে যখন চারপাশ জুড়ে খুন, গুম, রক্ত আর মানবাধিকারের করুণ বিলাপ- যখন স্বাধীন চিন্তাও বন্দি হয়ে পড়ে স্বার্থপর রাজনীতির শৃখলে, তখনও কবি নীরব থাকেন না। তিনি জানেন, প্রেমের ফুল তখনই অর্থহীন, যখন চারদিকে ছড়িয়ে থাকে মানুষের কান্না, বঞ্চনা আর অন্যায়ের অগ্নিশিখা। তাই তিনি তাঁর প্রিয়ার আঁচলে ভালোবাসার ফুল নয়, তুলে দেন প্রতিবাদের শব্দ, মানবতার আহ্বান। ‘স্বপ্নের রঙ’ কবিতায় তিনি দৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা দেন-

‘যে পিদিম থেকে প্রতিদিন স্বপ্ন বিচ্ছুরিত হতো,
যে আলোর মিম্বার থেকে প্রতিদিন পাখিরা
উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে ভালোবাসার কথা বলতো-
সেই পিদিম, সেই মিম্বার মৃত সভ্যতার বুকে নিয়েছে ঠাঁই।’
এ কবিতা শুধু প্রেমের প্রত্যাখ্যান নয়- এ এক যুগের প্রতিবাদ, এক সময়ের দলিল।
তিনি আরও লেখেন-
‘যে ক্ষিতিজ শস্য-দানা ফলমূলে আমরা
পরিতৃপ্ত হয়ে হৃদয় থেকে উচ্চারণ করতাম
স্তুতি বাক্য, সেখানেও আজ হ্যামলকের স্থায়ী বসবাস।
এমন দুঃসময়ে তোমার আঁচলে পূর্ণিমা চাঁদ
বেঁধে দেয়ার দুঃসাহস আমি দেখাতে পারি না।’
এই পঙ্ক্তিগুলোয় কবি মুহিত চৌধুরীর কণ্ঠ হয়ে ওঠে প্রতিরোধের প্রতীক,যিনি প্রেমকেও ব্যবহার করেন সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার ভাষা হিসেবে। এখানে ভালোবাসা নয়, জেগে ওঠে বিবেক; আর কবিতা হয়ে ওঠে মানবতার অগ্নিসাক্ষী। ফিলিস্তিনের গণহত্যা ও মানবতার বিপর্যয়ের মুহূর্তে কবি মুহিত চৌধুরীর কণ্ঠ যেন আরও তীব্র আরও ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তাঁর কবিতায় তখন কেবল বেদনা নয়-জেগে ওঠে এক গভীর মানবিক প্রতিবাদ, এক অসহ্য নৈঃশব্দ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী উচ্চারণ। যখন বিশ্বসভ্যতা নীরব, আন্তর্জাতিক সম্প্র্রদায় কেবল ‘উদ্বেগ’ প্রকাশেই সীমাবদ্ধ, আর জাতিসংঘের নীতিহীনতা রক্তের স্রোতে ভেসে যায়, তখন কবি তার কলমে তুলে নেন গাজার জ্বলন্ত আর্তনাদ। ‘গাজার ধ্বংসস্তুুপ থেকে বলছি’ কবিতায় তিনি যেন এক নিহত শিশুর কণ্ঠস্বর হয়ে উচ্চারণ করেন মানুষের লজ্জা ও সভ্যতার পতনের ইতিহাস-
‘আমি অবরুদ্ধ গাজার ধ্বংসস্তুুপ থেকে বলছি
যেখানে চলছে শিশু হত্যার মহোৎসব,
যে শিশুটি এই মুহূর্তে জন্ম নিয়েছে
সে জানে না আর কতটা সময় সে বেঁচে থাকবে।
যে নারী মরুদ্যানের স্বপ্ন চোখে হেঁটে ছিলো
রক্তের বৃষ্টি তাকে ভিজিয়ে দিয়েছে।’
এখানে কবির কণ্ঠ এক নিঃশব্দ চিৎকার-যেখানে মানবতার মৃত্যু ঘটছে, অথচ সভ্য বিশ্ব তা দেখেও নির্বিকার। কবি প্রশ্ন তোলেন, কিন্তু বিচার চান না, কারণ তিনি জানেন-এই পৃথিবীতে ন্যায় এখন কেবল শব্দ, যার কোনো প্রাণ নেই। তাই তিনি তীব্র কটাক্ষ ছুঁড়ে দেন-
‘না, আমি তোমাদের কাছে বিচার চাই না
তোমরা মানবতা এবং স্বাধীনতা নামক
বিশ্রুত শব্দের করেছো ভিন্নার্থ,
তোমরা এক চোখা অপকৃষ্ট জীব।’
ফিলিস্তিনে ইজরাইলের গণহত্যা বন্ধে কার্যকর কোন ভূমিকা গ্রহন না করায় তাঁর ক্ষোভ আছড়ে পড়েছে জাতিসংঘের প্রতিও তাইতো বলেন-
‘অ্যান্টোনিও গুতেরেস’- না, তোমার কাছেও বিচার চাই না,
ম্যানহাটনের সুউচ্চ প্রাচীরে বসে তুমি শুধু উদ্বেগ প্রকাশ করো,
যে বাঘের দাঁত এবং নখ নেই, তার সুঠাম দেহের কোনো মূল্য নেই।’

এই কবিতায় মুহিত চৌধুরী শুধু গাজার নয়, সমগ্র বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠেন। তাঁর কবিতা হয়ে ওঠে মানবতার বিরুদ্ধে নীরবতার বিরুদ্ধে এক জ্বলন্ত ম্যানিফেস্টো, যেখানে শব্দই হয়ে যায় প্রতিবাদের আগুন, আর কবি-এক অবরুদ্ধ জাতির বিবেক।
তবে মুহিত চৌধুরী কেবল প্রতিবাদের কবি নন, তিনি প্রেমের কবিও বটে। তাঁর কবিতায় প্রেম ও বিরহ মিশে গেছে জীবনের নান্দনিকতায়-
‘তুমি নেই, আমি একা,
বৃষ্টির ছায়া বিহানের পথে,
অন্ধকার নেমে এল—
প্রাপ্তির সীমান্তরেখা।’

কবি মুহিত চৌধুরীর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ১২টি
১. প্রতিশোধ নেবনা (নাটক),২.সানাই কথা বললো না (কাব্য) ৩.নির্লজ্জের লজ্জা (কাব্য) ৪.যদি ভালোবাসা মরে যায় (কাব্য) ৫. কসম সিনাই পর্বতের (কাব্য) ৬. নিলামে উঠুক তোমার পৃথিবী (কাব্য) ৭.পাখি গেলে পোঁকার বাস (গীতিসংকলন) ৮. ফিরে আসা (উপন্যাস) ৯. এই ঘর এই মন (উপন্যাস) ১০.সহজ হজ্ব গাইড(ধর্ম বিষয়ক) ১১. আমমেরিকায় বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি( গবেষণা) ১২. বাংলাদেশে অনলাইন সাংবাদিকতা (সাংবাদিকতা বিষয়ক)
মুহিত চৌধুরী আশির দশকে লেখালেখি ও সাংবাদিকতা শুরু করেন। ১৯৯৮ সালে তিনি সম্পাদনা শুরু করেন মাসিক বিশ্ববাংলা। মুহিত চৌধুরী সিলেটে অনলাইন সাংবাদিকতার পথিকৃৎ হিসেবেও খ্যাত। তিনি ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠা করেন জনপ্রিয় অনলাইন নিউজপোর্টাল দৈনিক সিলেট ডটকম এবং ২০১৪ সালের ৮ জুলাই প্রতিষ্ঠা করেন সিলেট অনলাইন প্রেসক্লাব-যা এখন সারাদেশে অনলাইন সাংবাদিকতার প্রেরণার নাম। অনলাইন সাংবাদিকতায় সংগঠন, কাঠামো ও পেশাদারিত্ব প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মুহিত চৌধুরীর ভূমিকা অনন্য। ১৯৯৫ সালে মানবতাবাদী একটি কবিতার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের National Library of Poetry তাঁকে বিশেষ সম্মাননায় ভূষিত করে-যা শুধু তাঁর ব্যক্তিগত কৃতিত্ব নয়, সিলেট তথা বাংলাদেশের সাহিত্যচর্চারও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। কবি মুহিত চৌধুরীর কলম কখনো থেমে থাকেনি। তিনি বিশ্বাস করেন-‘লেখা মানে দায়িত্ব, আর দায়িত্ব মানে জাগ্রত বিবেক।’ এই বিশ্বাস থেকেই তিনি লিখে যাচ্ছেন মানবতার পক্ষে, সত্যের পক্ষে, প্রেমের পক্ষে। তাঁর কবিতা, গান ও সাংবাদিকতা সময়ের অন্যায় ও অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে এক আলোকিত প্রতিবাদ।
মুহিত চৌধুরী এক বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী- যিনি সাহিত্য, সাংবাদিকতা ও সংস্কৃতির ত্রিবেণীধারায় সৃজনের আলোকবর্তিকা হয়ে আছেন। তিনি আমাদের সময়ের বিবেক, যিনি শব্দ দিয়ে নির্মাণ করেন সৌন্দর্য, সত্য ও মানবতার সেতুবন্ধন। তাঁর সৃষ্টির ভেতর দিয়ে সময় একদিন মনে রাখবে-‘মুহিত চৌধুরী ছিলেন, আছেন, থাকবেন-সত্য ও সৃষ্টির এক উজ্জ্বল প্রতীক।’
কবি মুহিত চৌধুরী লেখেন যন্ত্রণার ভিতর থেকেও জীবনের গান, অন্যায়ের অন্ধকারে জ্বেলে দেন আশার প্রদীপ। কলম তার নিঃশব্দ বিপ্লব,যার অক্ষরে জেগে ওঠে অবহেলিত মানুষের মুখ। তিনি শব্দে শব্দে জাগান স্বপ্ন,ভালোবাসা আর মানবতার জয়গান গেয়ে সিলেটের আকাশে রেখেছেন এক অমলিন স্বাক্ষর।
সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলার চক্রবাণী গ্রামে ১৯৬০ সালের ২ নভেম্বর মুহিত চৌধুরী জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ আব্দুন নূর চৌধুরী ও মাতা সুলতানা নূর চৌধুরী। বিবাহিত জীবনে তিনি ২ পুত্র সন্তানের গর্বিত জনক।
তাঁর হাতে রচিত হোক আরো কিছু অনবদ্য লিরিক,আরো কিছু হৃদয় নিংড়ানো কথামালা –এই হৃদয়জ কামনা…শুভজন্মদিন।
লেখক: কবি ও আইনজীবী।

 

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন