সালমান শাহ হত্যা মামলা: আসামিরা কে কোথায়?

জনপ্রিয় চিত্রনায়ক চৌধুরী মোহাম্মদ শাহরিয়ার ওরফে ইমন। যিনি চলচ্চিত্র অঙ্গনে সালমান শাহ নামে পরিচিত। তার মৃত্যুর ঘটনায় ২৯ বছর আগের অপমৃত্যুর মামলা এখন হত্যা মামলায় রূপ নিয়েছে। আদালতের নির্দেশে দীর্ঘ আইনি লড়াই শেষে ২১ অক্টোবর রাজধানীর রমনা থানায় সালমান শাহর মামা চলচ্চিত্র পরিচালক আলমগীর হোসেন কুমকুম বাদী হয়ে হত্যা মামলাটি দায়ের করেন। হত্যা মামলার এজাহারে সালমান শাহর স্ত্রী সামিরা হক, শাশুড়ি লতিফা হক লুসি ও বিতর্কিত ব্যবসায়ী এবং অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক আজিজ মোহাম্মদ ভাইসহ ১১ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। অজ্ঞাতনামা আরও কয়েকজনও আছেন আসামি তালিকায়। এসব আসামি কে কোথায় আছেন সুনির্দিষ্ট করে জানাতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো।

এই হত্যা মামলায় যাদের আসামি করা হয়েছে তারা হলেন সালমান শাহর স্ত্রী সামিরা হক, শাশুড়ি লতিফা হক লুসি, বিতর্কিত ব্যবসায়ী অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক আজিজ মোহাম্মদ ভাই, বাংলা চলচ্চিত্রের খলনায়ক মোহাম্মদ আশরাফুল হক ওরফে ডন। ডেভিড, জাভেদ ও ফারুক নামের তিন জনকে আসামি করা হয়েছে, যাদের ঠিকানা দেওয়া হয়েছে রাজধানীর বিএফডিসি। এছাড়া আরও চার জনকে আসামি করা হয়েছে। তারা হলেন ফরিদপুরের রেজভী আহমেদ ওরফে ফরহাদ, রুবী, আ. ছাত্তার ও সাজু।

মামলা পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানান, গত ১৩ অক্টোবর আদালতে শুনানির সময় এই প্রথম উপস্থিত ছিলেন সালমান শাহর স্ত্রী সামিরা হক। এর এক সপ্তাহ পরই আদালতের নির্দেশে রাজধানীর রমনা থানায় হত্যা মামলাটি দায়ের করা হয়।

প্রশ্ন উঠেছে আসামিরা এখন কে কোথায় আছেন? অনেক আগে থেকেই ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাই দেশের বাইরে অবস্থান করছেন বলে দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানিয়েছে। আসামি রেজভী আহমেদ ওরফে ফরহাদ অবস্থান করছেন লন্ডনে। সালমানের স্ত্রী সামিরা হক, তার মা লতিফা হক লুসি ও অপর খলনায়ক ডন দেশেই অবস্থান করছিলেন। ১৩ অক্টোবর আদালতেও উপস্থিত ছিলেন সামিরা। তবে ২০ অক্টোবর আদালত থেকে হত্যা মামলা দায়েরের নির্দেশ দিলে তারা গাঢাকা দিয়েছেন বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। অন্য আসামিদের অবস্থান এখনও নিশ্চিত করে জানাতে পারেনি পুলিশ।

মামলাটি তদন্ত করে পুলিশের চারটি সংস্থা। প্রথমে রমনা থানার এসআই মাহবুবুর রহমান এ মামলার তদন্ত করেন। পরে মামলাটি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কাছে হস্তান্তর করা হয়। তখন মামলাটি পর্যায়ক্রমে ডিবির দুই কর্মকর্তা তদন্ত করেন। তারা হচ্ছেন সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) হুমায়ুন কবীর ও এএসপি মো. মজিবুর রহমান। এরপর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) স্থানান্তর করা হয়। সেখানে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন এএসপি খালেক-উজ-জামান। এরপর আদালতের নির্দেশে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) মামলাটির তদন্ত করে। এ সংস্থায় মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন ইন্সপেক্টর মো. সিরাজুল ইসলাম বাবুল। এ তদন্তে তদারকি কর্মকর্তা ছিলেন পিবিআই’র পুলিশ সুপার শফিউল আজম ও বশির আহমেদ। প্রত্যেকটি সংস্থার প্রতিবেদনেই চৌধুরী মোহাম্মদ শাহরিয়ার ওরফে ইমন ওরফে সালমান শাহর মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে উল্লেখ করা হয়।

সালমান শাহর মৃত্যুর ঘটনাটির জুডিশিয়াল (বিচারিক) তদন্তও করা হয়। ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) কোর্টের বিচারক ইমদাদুল হক মামলাটির জুডিশিয়াল তদন্ত করেন। তার তদন্তেও তখন একই চিত্র উঠে আসে।

গত ২১ অক্টোবর হত্যা মামলা দায়েরের পর মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে রমনা থানার ইন্সপেক্টর আতিকুল আলম খান্দকারকে। এ বিষয়ে বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘নতুন করে মামলার তদন্ত কার্যক্রম শুরু করেছি। ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও সাক্ষীদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছি। পাশাপাশি আসামিদের অবস্থান শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে।’

আসামিরা দেশে আছেন, নাকি দেশের বাইরে পালিয়ে গেছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘জানলে তো ধরেই ফেলতাম। তারা কে কোথায় আছেন, সেটা জানার চেষ্টা চলছে। আসামিরা যাতে দেশ ত্যাগ করতে না পারে সে জন্য ইমিগ্রেশনে মামলার তথ্য পাঠানো হয়েছে।’

অ্যাডভোকেট ফারুক আহম্মদ বলেন, ‘মামলার আসামিরা যারা দেশে আছেন তারা যাতে দেশ ছেড়ে পালাতে না পারেন, সে জন্য নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। পুলিশও এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘এ মামলার আসামি রেজভীর দেড় বছরের সাজা হয়েছিল। পরে জামিনে বেরিয়ে লন্ডন পালিয়ে যান। তিনি লন্ডন থেকে একটা মেইল পাঠিয়েছেন তদন্ত কর্মমকর্তার (আইও) কাছে। একটি ভয়েস মেইল পাঠিয়েছেন আদালতের কাছে। আমরা আদালত থেকে সেটার সার্টিফায়েড কপি চেয়েছি। সেখানে আসামি কী বলেছেন জানার জন্য, তার ভয়েসে কী আছে। যদিও আইনগতভাবে এটা তিনি পারেন না। কারণ তিনি পলাতক। আদালত থেকে তাকে পলাতক ঘোষণা করা হয়েছে। সাজা পরোয়ানা ঘুরতেছে। এ দুটি বিষয় আমরা চেয়েছিলাম। কিন্তু নিম্ন আদালত আমাদের আবেদন নামঞ্জুর করেছেন। এটার জন্য আমরা মহানগর দায়রা জজ আদালতে রিভিশন করেছিলাম। ওই রিভিশন শুনানি ১৩ অক্টোবর হয়েছে। সেই শুনানিতে সালমান শাহর স্ত্রী সামিরা হক এই প্রথম শুনানির সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন। তিনি এই মামলার মূল আসামি।’

সালমান শাহ হত্যা মামলার প্রধান এই আইনজীবী আরও বলেন, ‘সালমান শাহর মৃত্যুর দিনই অনেকটা পরিবারের অজান্তে সালমানের বাবা কমর উদ্দিন চৌধুরীর সই নিয়ে রমনা থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা করে পুলিশ। সেই মামলার তদন্ত চলা অবস্থায় ১৯৯৭ সালে রেজভী আহমেদ নামের একজন অন্য এক মামলায় গ্রেফতার হয়ে আদালতে জবানবন্দি দেন। সেই জবানবন্দিতে তিনি স্বীকার করেছিলেন, সালমান শাহকে হত্যা করে আত্মহত্যার ঘটনা সাজানো হয়েছে এবং তিনি নিজেও সেই হত্যায় জড়িত ছিলেন। এরপর সালমান শাহর বাবার মামলায় ১০ জনের নাম উল্লেখ করে আদালতে নালিশি হত্যা মামলা করা হয়। সর্বশেষ করা হত্যা মামলায় আসামির সংখ্যা ১১।’

হত্যা মামলার বাদী সালমান শাহর মামা চিত্রপরিচালক মো. আলমগীর কুমকুম বলেন, ‘সালমানের মৃত্যুর ঘটনায় হত্যা মামলা দায়ের করেছি। পুলিশ তদন্ত করছে। আমরা খুনিদের বিচার চাই।’

সালমান শাহ মারা যান ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর। রমনা থানা এলাকার নিউ ইস্কাটন রোডের ১১/বি ইস্কাটন প্লাজার ফ্ল্যাট থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ওইদিনই রাজধানীর রমনা থানায় একটি এজাহার দাখিল করেন নায়কের বাবা কমর উদ্দিন আহমদ চৌধুরী। পুলিশ সেটিকে অপমৃত্যুর মামলা হিসেবে নথিভুক্ত করে। ১৯৯৭ সালের ৩ নভেম্বর আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন (ফাইনাল রিপোর্ট) দেয় পুলিশের অপরাধ ও তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এ প্রতিবেদনে সালমান শাহর মৃত্যুকে ‘আত্মহত্যা’ বলে উল্লেখ করা হয়। মামলা দায়েরের কয়েক বছর পর ২০০০ সালের ১১ মে তিনি মারা যান। এরপর মামলাটির আইনি লড়াই চালিয়ে যান সালমান শাহর মা নিলুফার জামান চৌধুরী ওরফে নীলা চৌধুরী। শুরু থেকেই তার অভিযোগ ছিল- সালমান শাহকে হত্যা করা হয়েছে। অভিযোগের আঙুলও ছিল পুত্রবধূ সামিরা হকসহ অনেকের দিকে।

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন