সুলতানের কৃষিদর্শন নিয়ে পাঁচ প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছে গবেষণা

চিত্রকর এস এম সুলতানের কৃষিজিজ্ঞাসা পাঠ করতে গিয়ে লেখক ও গবেষক পাভেল পার্থ পঞ্চশস্য, পঞ্চভূত কিংবা পঞ্চইন্দ্রিয়ের মতো প্রধানত পাঁচটি প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছেন। প্রথমত সুলতানের কাজের কোনো পূর্ণাঙ্গ পাবলিক নথি ও আর্কাইভ নেই। দ্বিতীয়ত সুলতানকে নিয়ে অধিকাংশ আলাপ তাঁকে ‘মিথ’ ও ‘মহান’ বানিয়ে তাঁর শিল্পকর্মের বিশ্লেষণ এবং বিবরণ বিস্তারের চেয়ে শিল্পীর নানাবিধ ব্যক্তিজীবনকেই বেশি ‘চাউর’ করে। তৃতীয়ত তাঁকে ‘বোহেমিয়ান’ বানিয়ে তাঁর সৃষ্টিকর্মকে ‘একক’ ও ‘অপর’ করে ফেলা হয়। চতুর্থত ছবির ‘পেশি’ নিয়ে যত আলাপ, বরং কম আলাপ হয় তাঁর চিত্রকলার কারিগরি বনিয়াদ নিয়ে। পঞ্চমত কৃষির রাজনৈতিক বাস্তবতা ও ধারাবাহিক ঐতিহাসিকতাকে আড়াল করে অধিকাংশ আলাপই সুলতানের কৃষকদের ‘আদিম’ বানিয়ে রাখে।

সুলতানের ছবির কৃষিজিজ্ঞাসা নিয়ে গবেষণামুখী কোনো বিস্তর আলাপ নেই। ‘পাঁচ প্রশ্ন ও বিস্ময়’ থেকেই গবেষক সুলতানের ‘কৃষিজিজ্ঞাসাকে’ বুঝতে চেয়েছেন। সুলতান জন্মশতবাষির্কী উপলক্ষে কাজটি শুরু হলেও এর সঙ্গে যুক্ত হয় গবেষক পাভেল পার্থর পূর্ববর্তী মাঠকর্মের অভিজ্ঞতা।

সুলতান কোন কৃষিব্যবস্থার ছবি এঁকেছেন কিংবা কৃষিরাজনীতিকে কেমনভাবে চিত্রিত করেছেন, সেসবের ধারাবাহিক প্রামাণ্য আলাপ আমরা পাই না। আর এসব কারণে পাভেল পার্থ বোধ করেন সুলতানের ছবির কৃষিজিজ্ঞাসা নিয়ে গবেষণামুখী কোনো বিস্তর আলাপ নেই। ‘পাঁচ প্রশ্ন ও বিস্ময়’ থেকেই গবেষক সুলতানের ‘কৃষিজিজ্ঞাসাকে’ বুঝতে চেয়েছেন। সুলতান জন্মশতবাষির্কী উপলক্ষে কাজটি শুরু হলেও এর সঙ্গে যুক্ত হয় গবেষকের পূর্ববর্তী মাঠকর্মের অভিজ্ঞতা।

গ্রামীণ কৃষিজমিন থেকে শহরের গ্যালারি ও পাঠাগারে গবেষক বিচরণ করেছেন সুলতানের চিত্রকর্মের কৃষির সুলুক সন্ধানে। মাঠকর্ম, চিত্রকর্ম বিশ্লেষণ ও পূর্ববর্তী কাজের পর্যালোচনার ভেতর দিয়ে রচিত গবেষণাকর্মটি আমাদের সামনে সুলতানের কৃষিজিজ্ঞাসার বহুমুখী তলকে হাজির করে। চিত্রকর্ম নিয়ে এমন গবেষণাকর্ম বাংলাদেশে নতুন। গবেষণাকর্মটির বিবরণ, বয়ান ও বিন্যাসের ভেতর দিয়ে শিল্প এবং কৃষিচর্চার এক জরুরি প্রামাণ্য হাজির হয়েছে, যা কৃষিসভ্যতার রূপান্তরকে বি–ঔপনিবেশিক কায়দায় পাঠের জরুরত তুলে ধরেছে। প্রায় দেড় বছরের এই গবেষণাটি দুনিয়াদারি আর্কাইভের সার্বিক সহায়তায় সমাপ্ত হয়েছে।

সুলতানের চিত্রকর্ম ও কৃষিজিজ্ঞাসার জমিন, সুলতানের কৃষক: পেশি-তর্ক কিংবা বহুভাষ্যের বিপরীতে, নড়াইল ও সুলতানের বীজদানা সংগ্রহ, অধিপতি অকৃষিকরণ বনাম সুলতানের শক্তিময় কৃষিভাষ্য, সুলতানের কৃষিচিত্রকর্ম: বোনা ও রোপা বয়ান, ‘প্রথম বৃক্ষরোপণ’: একটি খণ্ডিত বয়ান এবং নয়াউদারবাদ বনাম আপন লড়াই—এই প্রধান সাতটি অধ্যায়ের ভেতর দিয়ে গবেষক ‘সুলতানের কৃষিজিজ্ঞাসা’ আমাদের সামনে হাজির করেছেন।

গ্রামীণ কৃষিজমিন থেকে শহরের গ্যালারি ও পাঠাগারে গবেষক বিচরণ করেছেন সুলতানের চিত্রকর্মের কৃষির সুলুক সন্ধানে। মাঠকর্ম, চিত্রকর্ম বিশ্লেষণ ও পূর্ববর্তী কাজের পর্যালোচনার ভেতর দিয়ে রচিত গবেষণাকর্মটি আমাদের সামনে সুলতানের কৃষিজিজ্ঞাসার বহুমুখী তলকে হাজির করে।

সুলতানকে ‘মিথ’ বানানোর কসরত থেকে শুরু করে বহু ‘অপরায়ণের’ চাতুরীকে গবেষক প্রশ্ন করেছেন কৃষির প্রতিবেশগত রাজনৈতিকতার প্রমাণের ভেতর দিয়ে। সুলতান ‘কৃষি’ ও ‘কৃষকের’ ছবি এঁকেছেন; এমন সব প্রতিষ্ঠিত ভাষ্যকে গবেষক অনৈতিহাসিক হিসেবে দেখেছেন। নিদারুণ কৃষি বাস্তবতা ও যন্ত্রণার দাগ মুছে সুলতান কীভাবে এক ‘সার্বভৌম উৎপাদন ইতিহাসের’ গল্পবীজ বুনেছেন, ক্যানভাসের জমিনজুড়ে গবেষক বরং সেইসব দাবিয়ে রাখা সত্যকে টানটান করার চেষ্টা করেছেন। কৃষকের শ্রেণি-বর্গ পরিচয়, কৃষিজমিনের বাস্তুতন্ত্র, ঋতু ও মৌসুম কিংবা নদীর পরিবেশগত অবদানের মতো বিষয়কে সুলতানের চিত্রকর্ম থেকে সন্ধান করেছেন গবেষক। হাইব্রিড ও জেনেটিক্যালি মডিফায়েড বীজনির্ভর রাসায়নিক কৃষির দুনিয়ায় সুলতানের কৃষকেরা কোন ধানের ভাত খেতে পারেন, এমন প্রশ্ন হাজির করা বিপজ্জনক হলেও সব শিল্পমাধ্যমের জন্য এটি জরুরি। সুলতান কি আমন, আউশ, বোরোধানের তিনটি মৌসুমের ছবিই এঁকেছেন? কেন তাঁর ছবিতে রাত ও বৃষ্টি নেই? সুলতানের গরুরা কী কী জাতের ঘাস খায় কিংবা তিনি কত ধরনের প্রতিবেশবৈচিত্র্য ক্যানভাসে হাজির করেন? এমন বহু জিজ্ঞাসার উত্তর মিলেছে খোদ সুলতানের চিত্রকর্মের ভেতরেই।

মডিফায়েড বীজনির্ভর রাসায়নিক কৃষির দুনিয়ায় সুলতানের কৃষকেরা কোন ধানের ভাত খেতে পারেন, এমন প্রশ্ন বিপজ্জনক হলেও সব শিল্পমাধ্যমের জন্য এটি জরুরি। সুলতান কি আমন, আউশ, বোরোধানের তিনটি মৌসুমের ছবিই এঁকেছেন? কেন তাঁর ছবিতে রাত ও বৃষ্টি নেই? সুলতানের গরুরা কী কী জাতের ঘাস খায়?

সুলতানের চিত্র কারিগরিতে গাব, তিসি, পাট, কয়লা দেশীয় উপকরণের ব্যবহার ও তাঁর চিত্রকর্মে দেশীয় কৃষির উপস্থাপনকে গবেষক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কৃষি-ইশতেহার হিসেবে পাঠ করেছেন। তেভাগা, টংক, নানকা কৃষক আন্দোলন থেকে কৃষির ওপর বৈশ্বিক ক্ষমতার কর্তৃত্ব ও নয়াউদারবাদী বাহাদুরি কীভাবে একই সঙ্গে শিল্পচর্চার ওপরেও নিয়ন্ত্রণ জিইয়ে রাখে, পাভেল পার্থের লেখায় সেসব ধারাবাহিকভাবেই এসেছে। ‘বিশ্রামরত কৃষক’, ‘যাত্রা’ কিংবা ‘প্রথম বৃক্ষরোপণ’ নিয়ে গবেষক নয়া আলাপ হাজির করেন, যা দেশের প্রকৃতি ও সংস্কৃতির ঐতিহাসিকতাকে আপন কায়দায় বয়ান করে।

কৃষক, শিল্পী, পেশাজীবী নানা শ্রেণি-বর্গের বহুজনের সঙ্গে আলাপচারিতা; বহু মুদ্রিত-অমুদ্রিত দলিল, ভিডিও-অডিও, আলোকচিত্র নানাবিধ সূত্র ও সান্নিধ্যের সন্নিবেশনে উপস্থাপিত ‘সুলতানের কৃষিজিজ্ঞাসা’ এক গুরুত্বপূর্ণ জরুরি গবেষণার উদাহরণ। এ জিজ্ঞাসা আরও বিস্তৃত ও বিকশিত হোক সর্বজন এবং সর্বপ্রাণের তর্ক ও তালাশের ধারাবাহিকতায়। দুনিয়াদারি আর্কাইভ ও ইউপিএল এ গবেষণার পাণ্ডুলিপি নিয়ে এক আলাপের আয়োজন করেছে। আর এই আলাপ ছাপিয়ে কিছুদিনের মধ্যেই ‘সুলতানের কৃষিজিজ্ঞাসা’ দেখা-অদেখা বহু তথ্য, চিত্রসূত্র এবং অসংখ্য চিত্রমালা নিয়ে পূর্ণাঙ্গ বইয়ে মুদ্রিত হয়ে পাঠকের হাতে আসবে। সেই পর্যন্ত বাংলার কৃষি ও সুলতানের কৃষিজিজ্ঞাসার তত্ত্ব তালাশের অপেক্ষায় থাকল অনুসন্ধিৎসু ইতিহাস পাঠক।

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন