পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার জানিয়েছেন, সম্প্রতি ইসলামাবাদ, ঢাকা ও বেইজিংয়ের মধ্যে ত্রিপাক্ষিক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে আঞ্চলিক কিংবা বাইরের দেশগুলোকেও অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও চীনের কূটনীতিকদের ত্রিপাক্ষিক আলোচনাটি হয় গত জুন মাসে। যেখানে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং মানুষের জীবনমান উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। কূটনীতিকরা তখন বলেছিলেন, এই সহযোগিতা ‘কোনো তৃতীয় পক্ষকে লক্ষ্য করে নয়’।
গত বুধবার ইসলামাবাদ কনক্লেভ ফোরামে ইসহাক দার বললেন, ‘আমরা জিরো সাম বা একপক্ষের লাভে অন্যের ক্ষতি হওয়ার নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছি। সবসময় জোর দিয়ে বলেছি, সংঘর্ষের চেয়ে সহযোগিতা অপরিহার্য।’
ইসহাক দারের মন্তব্যটি এলো আঞ্চলিক উত্তেজনা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে। এর মধ্যে আছে গত মে মাসে ভারত-পাকিস্তানের সংঘর্ষ। আর আগস্টে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর ঢাকা ও নয়াদিল্লির সম্পর্কও খারাপ হয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ড হলেও ভারত এখনো তাঁকে ফেরত পাঠাতে রাজি হয়নি।
ধারণা করা হচ্ছে, নতুন ব্লকটিতে ভারতকে বাদ দেওয়া কিংবা দেশটির প্রভাব সীমিত করা হবে। এমন ব্লকে দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশ, যেমন- ভুটান, নেপাল, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা কিংবা আফগানিস্তান (সবগুলোই সার্কভুক্ত) কি যোগ দিতে রাজি হবে?
পাকিস্তানের লক্ষ্য কী
ইসহাক দারের ভাষায়, বাংলাদেশ ও চীনের সঙ্গে ত্রিপাক্ষিক উদ্যোগের লক্ষ্য হলো পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়ানো। পাশাপাশি এই ধারণার বিস্তৃতি ঘটিয়ে আরো দেশকে অন্তর্ভুক্ত করা। এর প্রয়োজনীয়তার কারণ ইঙ্গিত করে তিনি বলেছেন, ‘আমাদের জাতীয় উন্নয়নের চাহিদা কিংবা আঞ্চলিক অগ্রাধিকার কারো অনঢ় অবস্থানের কাছে জিম্মি হতে পারে না, হওয়া উচিতও না।’
ইসলামাবাদ ও নয়াদিল্লির গঠনমূলক সংলাপ প্রক্রিয়া ১১ বছরের বেশি সময় ধরে স্থগিত আছে। ভারতের সঙ্গে অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোর সম্পর্কেও এখন দোদুল্যমানতা দেখছেন ইসহাক দার। এমন প্রেক্ষাপটে পাকিস্তান এমন একটি দক্ষিণ এশিয়ার কল্পনা করছে যেখানে বিভাজন নয়, সংযোগ ও সহযোগিতা থাকবে। অর্থনৈতিক সমন্বয় বৃদ্ধি পাবে। বিরোধগুলোর শান্তিপূর্ণ সমাধান হবে এবং মর্যাদা বজায় থাকবে।
ঢাকায় হওয়া দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। ফাইল ছবি: পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সৌজন্যে
ঢাকায় হওয়া দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। ফাইল ছবি: পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সৌজন্যে
লাহোর বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর সিকিউরিটি, স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড পলিসি রিসার্চের (সিএসএসপিআর) পরিচালক রাবিয়া আখতারের মতে, প্রস্তাবটি এখন যে পর্যায়ে আছে, সেটি কার্যকরের চেয়ে আকাঙ্ক্ষামূলকই বেশি। সার্ক এখন স্থবির। এ অবস্থায় আঞ্চলিক সহযোগিতায় বৈচিত্র্য আনার প্রস্তাবটি পাকিস্তানের ইচ্ছার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
সার্ক কেন স্থবির
১৯৮৫ সালে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকায়। প্রতিষ্ঠার সময় সদস্য ছিল সাতটি- বাংলাদেশ, ভুটান, মালদ্বীপ, নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা। ২০০৭ সালে অষ্টম সদস্য হয় আফগানিস্তান।
সংস্থাটির উদ্দেশ্যগুলোর মধ্যে আছে, দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের কল্যাণ ও জীবনমান উন্নয়ন, অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং সাংস্কৃতিক উন্নয়নে উৎসাহ দেওয়া। কিন্তু গত ৪০ বছরে এসব লক্ষ্য অর্জনে সংস্থাটি অনেকটাই ব্যর্থ। এর বড় কারণ হলো ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা।
২০১৬ সালে সার্কের ১৯তম শীর্ষ সম্মেলন হওয়ার কথা ছিল ইসলামাবাদে। কিন্তু কাশ্মীরে একটি প্রাণঘাতী হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে ভারত। এরপর তারা অংশ না নেওয়ার কথা জানালে সম্মেলন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়। সিএসএসপিআর-এর রাবিয়া আখতার বলছেন, সংস্থাটি সক্রিয় করতে সবার সম্মতি প্রয়োজন। বড় দুই সদস্য দেশ আঞ্চলিক সহযোগিতা ও দ্বিপাক্ষিক বিবাদকে আলাদা করতে না পারলে সার্কে পক্ষে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
সার্ক কেন গুরুত্বপূর্ণ
চলতি বছরের হিসাব অনুযায়ী, সার্কভুক্ত দেশের জনসংখ্যা দুই বিলিয়নের বেশি। যা এ অঞ্চলকে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল করে তুলেছে। কিন্তু এরপরও আঞ্চলিক বাণিজ্য খুবই সীমিত। বিশ্ব ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জোট আসিয়ানের সদস্যদের মধ্যে যে পরিমাণ বাণিজ্য হয়, তা দেশগুলোর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ২৫ শতাংশের সমান। বিপরীতে সার্কভুক্ত দেশগুলোর আঞ্চলিক বাণিজ্য মাত্র ৫ শতাংশ।
বিশ্ব ব্যাংকের পূর্বাভাস হলো, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো যদি নিজেদের মধ্যে প্রতিবন্ধকতা কমায় তাহলে তারা ৬৭ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য বিনিময় করতে পারবে।
দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্যের দুর্বলতার প্রধান কারণ হিসেবে দেখা হয় আঞ্চলিক যোগাযোগের ঘাটতিকে। ইউরোপে বাণিজ্যিক যান এক দেশ থেকে আরেক দেশে যেতে পারে। ২০১৪ সালে সার্কের জন্যও এমন একটি চুক্তির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ভারতের সঙ্গে উত্তেজনার জেরে পাকিস্তান তাতে বাধা দেয়।
এশিয়া সোসাইটি পলিসি ইনস্টিটিউটের সাউথ এশিয়া ইনিশিয়েটিভের পরিচালক ফারাহ আমীর মনে করেন, ভারত-পাকিস্তান নূন্যতম সহযোগিতা করলেও তা বৃহত্তর আঞ্চলিক স্বার্থের জন্য ভালো হবে। তখন সার্কও পুনরুজ্জীবিত হবে। কিন্তু দুই দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিকট ভবিষ্যতে এমন কিছুর সম্ভাবনা খুবই কম।
পাকিস্তান সার্কের বাইরে নতুন আঞ্চলিক অংশীদারত্ব তৈরির প্রথম চেষ্টাকারী দেশ নয়। সংস্থাটি ব্যর্থ হওয়ার পর, বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপাল (বিবিআইএন নামে পরিচিতি) নিজেদের মধ্যে একই রকম চুক্তি করেছে। এ ছাড়া, ভারত অন্যান্য আঞ্চলিক সংস্থারও সদস্য। যেমন বিমসটেক। যেখানে বাকি সদস্যদের মধ্যে আছে বাংলাদেশ, ভুটান, মিয়ানমার, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ড।
পাকিস্তানের প্রস্তাব কি সফল হবে
প্রস্তাবটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী হলেও এটির প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ সেন্টার ফর ইন্দো-প্যাসিফিক অ্যাফেয়ার্সের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক শাহাব এনাম খান। তাঁর মতে, নিরাপত্তাকেন্দ্রিক চিন্তাধারা কিংবা রাজনৈতিক সংকীর্ণতার কারণে বাস্তববাদী আঞ্চলিক সহযোগিতা বা কথিত ক্ষুদ্র গোষ্ঠীভিত্তিক সহযোগিতা গড়তে দক্ষিণ এশিয়া বারবার ব্যর্থ হয়েছে।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক প্রভীন দন্থি মনে করেন, তাত্ত্বিক দিক থেকে হলেও একটি নতুন আঞ্চলিক সংস্থা গড়ে তোলার সুযোগ আছে। ভারত ও পাকিস্তানের বৈরী সম্পর্কের কারণে সার্কের স্থবিরতা দক্ষিণ এশিয়ায় আরেকটি ফোরামের চাহিদা তৈরি করেছে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অবনতির দিকে, আবার পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কে উন্নতি ঘটছে। এমন অবস্থা চীনের অংশগ্রহণে ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতার পথ তৈরি করেছে।
এখন প্রস্তাবটি বাস্তবে কার্যকর হবে কি না, তা দুটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করছে বলে মনে করেন রাবিয়া আখতার। প্রথমত, ছোট ও নির্দিষ্ট বিষয়ভিত্তিক গোষ্ঠীতে অংশ নেওয়ার জন্য দেশগুলো স্বার্থ খুঁজে পাচ্ছে কি না; দ্বিতীয়ত, এমন গোষ্ঠীতে অংশগ্রহণ করলে ভারতকে ঘিরে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হবে কি না।
রাবিয়া আখতার বলেন, পাকিস্তানের প্রস্তাবিত আঞ্চলিক উদ্যোগে দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশ প্রাথমিক আগ্রহ দেখাতে পারে। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগদানের ক্ষেত্রে অগ্রগতি সীমিত থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
শাহাব এনাম খানের মতে, এটি সফল করতে হলে দেশগুলোর একসঙ্গে কাজ করার সক্ষমতা এবং ছোট দেশগুলোর প্রয়োজন বিবেচনায় নেওয়ার মানসিকতা দেখাতে হবে। প্রচলিত ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে আসতে হবে। অর্থনৈতিক স্বার্থকে এগিয়ে নেবে এমন সহযোগিতার প্রয়োজন দেখছে নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ। আমি মনে করি এই অঞ্চলের ভেতরে ও বাইরের দেশগুলোর এ ধরনের বিকল্প উদ্যোগে যোগ দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ভিত্তি আছে।
আর প্রভীন দন্থি বলছেন, পাকিস্তানের প্রস্তাবটি যদি সত্যিই এগিয়ে যায়, তাহলে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ব্যবধান আরো বাড়াতে পারে। একইসঙ্গে বাড়তে পারে চীনের সঙ্গে ভারতের আঞ্চলিক প্রতিযোগিতা।
