পেরুতে পুরনো হারিয়ে যাওয়া শহর খুঁজে পেলেন প্রত্নতাত্ত্বিকরা
পেরুতে প্রত্নতাত্ত্বিকরা আবিষ্কার করেছেন একটি প্রাচীন শহর, যার বয়স প্রায় ৩ হাজার ৫০০ বছর। সদ্য আবিষ্কৃত শহরটির নাম পেনিকো। শহরটি সম্ভবত প্যাসিফিক উপকূল, আন্দিজ পর্বতমালা ও আমাজন বনাঞ্চলের প্রাচীন সমাজগুলোর মধ্যে বাণিজ্যিক সংযোগস্থল হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
রাজধানী লিমা থেকে প্রায় ২০০ মাইল উত্তর দিকে, বারাঙ্কা প্রদেশে অবস্থিত এই শহরটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১ হাজার ৯৭০ ফুট উঁচু এক পাহাড়ের ঢালে গড়ে উঠেছে।
গবেষকদের মতে, শহরটি খ্রিস্টপূর্ব ১ হাজার ৮০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ সালের মধ্যে গঠিত হয়েছিল —অর্থাৎ যখন প্রাচীন মিসর, ভারত, সুমের ও চীনে সভ্যতা গড়ে উঠছিল। ড্রোনের মাধ্যমে ধারণ করা ভিডিওতে দেখা গেছে, শহরের কেন্দ্রে একটি বৃত্তাকার কাঠামো রয়েছে, যা চারপাশে পাথর ও কাদামাটির তৈরি ভবনের ধ্বংসাবশেষ দিয়ে ঘেরা। এই স্থাপনাগুলোর আকৃতি পেরুর আরেক প্রাচীন শহর কারাল-এর সঙ্গে বিস্ময়করভাবে মিলে যায়। কারালকে আমেরিকার সবচেয়ে প্রাচীন সভ্যতা হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং এটি পেনিকো থেকে মাত্র ১৭ মাইল পশ্চিমে অবস্থিত।
গবেষকদের ধারণা, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কারাল ধ্বংস হয়ে গেলে তার পরবর্তী উত্তরসূরি হিসেবে পেনিকো গড়ে উঠতে পারে।
কারাল সভ্যতা প্রায় ৫ হাজার বছর আগে উদ্ভূত হয় এবং এটি মিসর, ভারত ও সুমেরের প্রাচীন সভ্যতাগুলোর সমসাময়িক হলেও সম্পূর্ণভাবে একাকী বিকশিত হয়েছিল বলে গবেষকরা মনে করেন।
পেনিকো আবিষ্কারের নেতৃত্বে থাকা প্রত্নতাত্ত্বিক রুথ শাদি ১৯৯০-এর দশকে কারাল শহরের খনন কাজও পরিচালনা করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘কারাল ধ্বংস হওয়ার পর তাদের উত্তরাধিকার কীভাবে বহাল ছিল, তা বোঝার জন্য পেনিকো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।এই শহর ছিল উপকূল, পর্বত এবং জঙ্গলের সঙ্গে বাণিজ্যিক আদান-প্রদানের কেন্দ্র।’
পেরুর সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের প্রত্নতত্ত্ববিদ মার্কো মাচাকুয়াই বলেন, কারাল সভ্যতা সম্ভবত খরা ও বন্যার কারণে খ্রিস্টপূর্ব ১ হাজার ৮০০ সালের দিকে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। সেই পতনের পর পেনিকো গড়ে ওঠে। প্রায় ৮ বছর গবেষণা চালিয়ে প্রত্নতাত্ত্বিকরা পেনিকোতে মোট ১৮টি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা চিহ্নিত করেছেন, যার মধ্যে রয়েছে ধর্মীয় মন্দির, আবাসিক ভবন, দেয়ালে খোদাই করা চিত্র ও অলংকরণ।
শহরের কেন্দ্রীয় প্রাঙ্গণের দেয়ালে খুঁজে পাওয়া গেছে শঙ্খ দিয়ে তৈরি ‘পুটুতু’ নামের এক ধরনের বাঁশির চিত্র, যা প্রাচীন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হতো এবং যেটি বহু দূর পর্যন্ত শব্দ প্রেরণ করতে পারত।এগুলো সম্ভবত পেনিকো সমাজে ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
অন্য স্থাপনাগুলোতে পাওয়া গেছে মানুষের কঙ্কাল, মৃত্তিকার তৈরি মানব ও প্রাণীর ভাস্কর্য, ধর্মীয় উপাসনাসামগ্রী এবং সামুদ্রিক ঝিনুক দিয়ে তৈরি নেকলেস। এই শহরের বিভিন্ন নিদর্শনে উপকূল, পর্বত এবং বনাঞ্চলের সাংস্কৃতিক প্রভাব একসঙ্গে দেখা গেছে। এ থেকে প্রত্নতত্ত্ববিদরা মনে করছেন, পেনিকো ছিল ওই অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক কেন্দ্র। কারাল প্রত্নতাত্ত্বিক অঞ্চলের মুখপাত্র ইওশিও কানো বলেন, ‘সুপি উপত্যকা ছাড়াও হুয়াউরা উপত্যকার সঙ্গে বাণিজ্যের প্রমাণ মিলেছে। এ ছাড়া পর্বতমালা ও বনাঞ্চলের সঙ্গে দীর্ঘ দূরত্বে সম্পর্ক ও একীকরণেরও ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।’
২০২৫ সালের ৩ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে পেনিকো পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। শহরের ধর্মীয় স্থানগুলোর ডিজিটাল পুনর্গঠন করা হয়েছে, যাতে দর্শনার্থীরা দেখতে পারেন শহরটি তার সর্বোচ্চ গৌরবে কেমন ছিল। উল্লেখ্য, পেরুতে আরো রয়েছে ইনকা সাম্রাজ্যের বিখ্যাত মাচু পিচু ও রহস্যময় নাজকা লাইনস। মাচু পিচু ১৫০০ শতকে গঠিত হলেও পেনিকো ছিল তারও হাজার বছর পুরনো একটি শহর। নাজকা লাইনস তৈরি হয়েছিল আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২০০ থেকে খ্রিস্টীয় ৫০০ সালের মধ্যে। সূত্র : দ্য টেলিগ্রাফ