ঐতিহ্যের প্রাচীন ‘চাঁদের শহর’
পৌরাণিক যুগ থেকে বিচিত্র জাতির আগমন ঘটেছে বাংলার গ্রীষ্মপ্রধান ও উর্বর বরেন্দ্র অঞ্চলে। গড়ে ওঠে সমৃদ্ধশালী রাজ্য, দুর্গ, সংঘারাম, মঠ, মন্দির, বিহার বা বিশ্ববিদ্যালয়। সময়ের বিবর্তনে সেগুলো আজ হয়তো ধ্বংসস্তূপ; কিন্তু তার স্মারক বিদ্যমান। বাংলার সমৃদ্ধশালী ঐতিহ্যের তেমনই এক স্মারক পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার বা সোমপুর মহাবিহার। সংস্কৃত ভাষায় সোমপুর অর্থ ‘চাঁদের শহর’। সেই কারণে ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্বঐতিহ্য পাহাড়পুর বিহারসংলগ্ন এলাকাকে এক সময়ের ‘চাঁদের শহর’ হিসেবেও আখ্যায়িত করা হতো।
নওগাঁর বদলগাছী উপজেলায় অবস্থিত পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারকে বলা হয় অষ্টাদশ শতকে নির্মিত দক্ষিণ হিমালয়ের সবচেয়ে বড় বৌদ্ধবিহার। ইতিহাসবিদদের মতে, আয়তনে পাহাড়পুরের সঙ্গে তুলনা হতে পারে কেবল ভারতের নালন্দা মহাবিহারের। শুধু ভারতীয় উপমহাদেশ নয়, বরং চীন, তিব্বত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন স্থান থেকে বৌদ্ধরা এখানে আসতেন জ্ঞানার্জন করতে।
ইতিহাসমতে, পাল বংশীয় দ্বিতীয় রাজা ধর্মপাল ৭৭০ সাল থেকে ৮১০ সালে এই বিহার ও মন্দির নির্মাণ করেন। সে সময় বিহারটির দাপ্তরিক নাম ছিল ধর্মপাল মহাবিহার। শতাব্দীর পর শতাব্দী এই ধ্বংসাবশেষের ওপর ধুলোবালি ও মাটি জমে একসময় তা বিশাল আকৃতির পাহাড়ের আকার ধারণ করে। এভাবেই এই স্থানের নাম হয়েছে পাহাড়পুর। ১৮৭৯ সালে ইংরেজ প্রত্নতত্ত্ববিদ স্যার আলেকজান্ডার কানিংহাম এই বিশাল স্থাপনাটি আবিষ্কার করেন। তবে এর পূর্ণাঙ্গ খননকার্য শুরু হয় ১৯২০-এর দশকে। সে সময় বিএন দত্ত এবং আরডি ব্যানার্জির তত্ত্বাবধানে এখানকার মূল বিহারের প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ও উদ্ধারকাজ শুরু হয়। খননের পর এখানে চতুর্ভুজ আকৃতির বিহারের স্থাপনাসহ বৌদ্ধ ও হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি, প্রাচীন মুদ্রা, অলংকার, শিলালিপিসহ অসংখ্য নিদর্শন পাওয়া গেছে। ১৯৮৫ সালে ইউনেস্কো এই স্থানকে বিশ্বঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
বর্তমানে পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার কমপ্লেক্স ৭০.৩১ একর জমির ওপর অবস্থিত। ধারণা করা হয়, প্রাচীনকালে এর আয়তন আরও বড় ছিল। বাংলাদেশে পর্যটক আকর্ষণের অন্যতম এই পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার। এখানে প্রতিদিন দেশি-বিদেশি শত শত দর্শনার্থীর পদচারণা ঘটে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও এখানে আসেন গবেষণাকর্মে। বছরের অন্যান্য সময় দর্শনার্থীদের উপস্থিতি একটু কম হলেও শীতে তা বাড়ে। তবে পর্যটন অবকাঠামোর ঘাটতি, আবাসন সংকট, গাইডের অভাব ও মানসম্মত রেস্টুরেন্ট না থাকায় দেশি-বিদেশি ভ্রমণকারীরা বারবার এখানে এসে ভোগান্তির শিকার হন।
জানা গেছে, বর্তমানে পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারে সরকারিভাবে ১৮ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োজিত। এর বাইরে মাস্টাররোলে চাকরি করেন ২৭ জন। এত কম সংখ্যক জনবল দিয়ে দর্শনার্থীদের সেবা ও কার্যক্রম পরিচালনা যথেষ্ট নয় বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
অনিন্দ্যসুন্দর এই বিহারে শুধু চতুর্ভুজ আকারের মঠই নয়, এর চারটি বাহুতে রয়েছে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের জন্য ১৭৭টি সারিবদ্ধ কক্ষ। সামনে রয়েছে টানা বারান্দা এবং পেছনে অত্যন্ত প্রশস্ত প্রাচীর। উত্তর বাহুর পূর্ব কোণে রয়েছে বিরাট আকারের প্রবেশ তোরণ, যা দেখতে বেশ চমৎকার। তোরণগুলো আবার বাইরে থেকে দুটি ঘরের মাঝ দিয়ে মহাবিহারের উন্মুক্ত চত্বরের সঙ্গে যুক্ত। এ রকম স্থাপনা ইতিহাসের এক বিরল নিদর্শন। একই সঙ্গে বিহারের স্থাপত্যশৈলী তৎকালীন কারিগরি দক্ষতার প্রমাণ বহন করে।
১৯৩৪ সাল পর্যন্ত খননের ফলে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ মহবিহারের পূর্ব দিকে সত্যপীরের ভিটা ও মন্দিরের চারদিকে কক্ষগুলো আবিষ্কার করে। এর মধ্যভাগে রয়েছে প্রধান বিহার। তাকে ঘিরে রয়েছে ১৯৮টি বাসোপযোগী কক্ষ, বিস্তৃত প্রবেশপথ, অসংখ্য বিনোদন স্তূপ, ছোট ছোট মন্দির আর পুকুর। এই স্থাপনার উত্তর-দক্ষিণে দৈর্ঘ্য ৩৫৭ ফুট ও প্রস্থ পূর্ব-পশ্চিমে ৩১৪ ফুট। মূল বিহার এই আয়তনের মধ্যস্থলে অবস্থিত। বিহারের গায়ে নানা ধরনের জীবজন্তুর প্রতিকৃতি সমৃদ্ধ কারুকার্যখচিত। মূল ভূমি থেকে এই বিহারের উচ্চতা প্রায় ৭২ ফুট।
পাহাড়পুর বিহার চত্বরে রয়েছে মনোরম একটি জাদুঘর। সেখানে বিহার খননকালে প্রাপ্ত রৌপ্যমুদ্রা, মূর্তি, শিলালিপি সংরক্ষিত। জাদুঘরের প্রবেশমূল্য ১০০ টাকা।
নওগাঁ জেলা শহরের বাস টার্মিনাল বালুডাঙা থেকে সরাসরি বাসে বদলগাছী উপজেলা হয়ে উত্তরে পাহাড়পুরে যাওয়া যায়। নওগাঁ থেকে সড়কপথে বিহারের দূরত্ব প্রায় ৩২ কিলোমিটার। আবার জয়পুরহাট শহর থেকে বাস, অটোরিকশায়ও পাহাড়পুর যাওয়া যায়। শহর থেকে দূরত্ব মাত্র ৬ কিলোমিটার। ট্রেনযোগে জয়পুরহাটের জামালগঞ্জ স্টেশনে নেমে ভ্যান বা অটোরিকশায় যাওয়া যায়। সেখান থেকে দূরত্ব মাত্র ৪ কিলোমিটার।
যারা এই দুই জেলার বাইরে থেকে পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার দেখতে আসবেন, তাদের অবশ্যই দিন শেষে সন্ধ্যার আগে জয়পুরহাট বা নওগাঁ শহরে ফিরে যেতে হবে। কারণ পাহাড়পুর এলাকায় থাকার মতো তেমন আবাসিক হোটেল এখনও গড়ে ওঠেনি।
বৌদ্ধবিহারের কাস্টডিয়ান মুহাম্মদ ফজলুল করিম বলেন, প্রতিদিন গড়ে ৬৫০ দর্শনার্থী এখানে আসেন। ছুটির দিনে এ সংখ্যা ৯০০ থেকে হাজারে উন্নীত হয়। আমাদের এখানে চারটি রেস্ট হাউসে যে সংখ্যক কক্ষ রয়েছে তা চাহিদার তুলনায় খুবই কম। তা ছাড়া অফিসিয়ালি কোনো বুকিং ব্যবস্থা নেই। শুধু রেফারেন্স ও আইডি কার্ড যাচাইয়ের মাধ্যমে রুম বরাদ্দ দেওয়া হয়।