বিয়ে যেভাবে হার্টের ক্ষতি করে অথবা ভালো করে
দৈনিক সিলেট ডট কম
এস এম গল্প ইকবাল : অনেক গবেষণার মতে, মানুষের হার্টের স্বাস্থ্য তাদের সম্পর্কের ধরনের সঙ্গে খুব জড়িত। গবেষণায় দেখা যায় যে তালাকপ্রাপ্ত, সিঙ্গেল বা অবিবাহিত এবং বিচ্ছিন্ন মানুষদের তুলনায় সুখী বিবাহিত মানুষদের মধ্যে বিশ্বের এক নম্বর প্রাণঘাতী করোনারি হার্ট রোগের পরিমাণ কম।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ডিভোর্স বা তালাকের সঙ্গে করোনারি অ্যাথেরোসক্লেরোসিস নামক হার্টের রোগ জড়িত। নতুন এক গবেষণা ইঙ্গিত করে যে, দীর্ঘমেয়াদী সম্পর্ক এবং কার্ডিয়াক স্বাস্থ্যের মধ্যে সম্পর্ক বেশি জটিল হতে পারে।
অ্যামেরিকান সাইকোলজিস্ট জার্নালের এক বিশেষ সংস্করণে ইউনিভার্সিটি অব ইউটাহের অধ্যাপক টিমোথি স্মিথ এবং ব্রায়ান বাউকাম হার্টের স্বাস্থ্য ও বিয়ে বা বিয়ের মতো সম্পর্কের বিভিন্ন দিক প্রকাশ করেন। তারা উল্লেখ করেন যে, মানুষের অনেকগুলো গুণ, যেমন- ব্যক্তিত্ব, মানসিক বা আবেগের সুসমন্বয় এবং অন্যান্য গুণ যা মানুষে মানুষে সম্পর্ক উন্নত করে তা তাদেরকে সুস্থ রাখতে, স্ট্রেস বা চাপ সামলাতে এবং ভালোভাবে ঘুমাতেও ভূমিকা রাখে। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, বিয়ে মানুষকে সুস্থ রাখছে না। তাদের যেসব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তাদের স্বাস্থ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে তা তাদের বিয়ে ভাঙনও ঘটাচ্ছে এবং উভয়েই একটি আরেকটির ওপর প্রভাব বিস্তার করছে।
ইউনিভার্সিটি অব ইউটাহের মনোবিজ্ঞানের বিশিষ্ট অধ্যাপক স্মিথ বলেন, কার্ডিওভাসকুলার রোগ বা বিষণ্নতা, উদ্বেগ, ক্রোধ, বৈরভাব, হতাশা, বুদ্ধিস্বল্পতা এবং পোস্ট ট্রম্যাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারের উন্নতি বা অবনতির জন্য আপনি যদি সর্বাধিক তথ্যবহুল স্বতন্ত্র ঝুঁকিসমূহের দিকে দৃষ্টিপাত করেন তাহলে দেখবেন এসবের সঙ্গে সম্পর্কের অসুবিধাগুলোর খুব নির্ভরযোগ্য সম্পর্ক রয়েছে।
তিনি বলেন, বাস্তবিক জ্ঞানের আলোকে বলা যায় যে, মানুষের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী রোগ ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন, যেমন- হার্টের রোগ বাড়া বা কমা সম্পর্কের আচরণের ওপর নির্ভর করে। বৈবাহিক কলহ না হলে বা কম হলে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কম থাকে এবং নিয়মিত বৈবাহিক কলহ হলে হার্টের সংবহনে বেশি চাপ সৃষ্টি হয়।
কার্ডিয়াক বা হার্টের রোগের জন্য কিছু স্পষ্ট ব্যবহারিক বিষয়কে দায়ী করা হয়। কার্ডিয়াক রোগের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়সমূহ যেমন- ধূমপান, ব্যায়ামের অভাব এবং চর্বিযুক্ত খাবার, কোনো মানুষের পক্ষে পরিবর্তন বা বর্জন করা সহজ হয় যদি এসব ত্যাগের ব্যাপারে উৎসাহী জীবনসঙ্গী থাকে। যদি স্বামী বা স্ত্রী ধূমপায়ী হয় ও শুধুমাত্র ভাজাপোড়া খাবার খায় এবং জীবনসঙ্গী তার এসব অভ্যাস বর্জনে যথেষ্ট উদ্যমী না হয় তাহলে কার্ডিয়াক রোগীর পক্ষে এসব ছাড়া কঠিন।
প্রচুর গবেষণায় ইতোমধ্যে বিয়ে এবং ওজন বৃদ্ধির সঙ্গে যোগসূত্র পাওয়া গেছে। বিজ্ঞানীরা দৃঢ়ভাবে প্রমাণ করেছেন যে, স্থূলতা বা ওজন বৃদ্ধির সঙ্গে হার্টের রোগ, ডায়াবেটিস এবং নির্দিষ্ট ক্যানসারের ঝুঁকি রয়েছে। স্মিথ বলেন, ‘ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের সঙ্গে জড়িত সমস্যাসমূহ (যেমন- বিষণ্নতা এবং বৈরভাব) ধূমপান বর্জন কিংবা ব্যায়ামের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে।’ এর কারণ হচ্ছে মানুষ যখন দুর্দশা অনুভব করে তখন সুস্থ থাকার নিয়মাবলী পালন করে না বললেই চলে।
অন্যদিকে কার্যকরী বা সুসম্পর্কের জুটি চিকিৎসা পরিকল্পনাকে (যেমন- বিশেষ করে হার্টের রোগীদের ক্ষেত্রে) সহজে পরিচালনা করতে সাহায্য করে। অবিবাহিত বা একাকী দিন কাটানো মানুষদের তুলনায় সমর্থনমূলক এবং সুখী সম্পর্কে আবদ্ধ লোকদের ওষুধ গ্রহণে বেশি করে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয় ও তাদের ফলো-আপ অ্যাপয়েন্টমেন্টও বেশি হয় এবং তারা তিক্ত বা অকার্যকর সম্পর্কে জড়িত ব্যক্তিদের তুলনায় কম জ্বালাতন এবং শাসানির মুখোমুখি হন।
এবার ঘুমের কথায় আসা যাক। স্মিথ বলেন, ‘স্লিপ ডিসঅর্ডার এবং ইনসমনিয়া দৃঢ়ভাবে হার্টের রোগের পূর্বাভাস দেয়।’ যেসব মানুষেরা তাদের স্বামী বা স্ত্রীর সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকে বা যারা একাকী থাকে কিংবা অসুখী চিন্তাভাবনায় মগ্ন থাকে তাদের তুলনায় বিবাহিত জীবনে সুখী মানুষেরা ভালো ঘুমাতে পারে। এসব সুখী মানুষদের কর্মক্ষেত্রে চাপপূর্ণ দিন অতিবাহিত করে ঘরে ফিরে কলহে লিপ্ত হতে হয় না, তারা শান্ত হতে পারে এবং তাদের সংবহন প্রক্রিয়াকে চাপ থেকে মুক্তি দিতে পারে।
কার্ডিওলজিস্টদের প্রতি স্মিথ এবং বাউকামের পরামর্শ হল রোগীদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে তারা যেন স্বামী-স্ত্রীর জটপাকানো ভূমিকা অনুধাবন করে। চেস্ট ক্যাভিটির বহুপ্রকোষ্ঠ বিশিষ্ট অঙ্গ তদন্তের পাশাপাশি চিকিৎসকরা হার্টের বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে দেখতে পারেন যা স্ক্যানে ধরা পড়ে না। চিকিৎসক মন্দ বা তিক্ত সম্পর্কে জড়িত রোগীদের অনলাইন ভিত্তিক বৈবাহিক কোর্স বা বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বিবাহ শিক্ষা গ্রহণের ব্যাপারে পরামর্শ দিতে পারেন।
স্মিথ বলেন, ‘স্বামী বা স্ত্রী হচ্ছে বিস্ময়কর সত্য পর্যবেক্ষণকারী।’ অনেক চিকিৎসক রোগীদের নিজস্ব রিপোর্ট বা বিবরণ এবং প্রশ্নাবলীর উত্তরের ওপর ভিত্তি করে তাদেরকে মূল্যায়ন করেন। কিন্তু বিখ্যাত টিভি ডক্টরের ভাষ্যমতে, ‘রোগীরা মিথ্যা বলে।’ একজন রোগী বলতে পারে যে তিনি নিয়মিত ব্যায়াম করেন অথবা কোনো ব্যথা অনুভব করছেন না, কিন্তু এ ব্যাপারে প্রকৃত সত্য জানেন তার জীবনসঙ্গী এবং তিনি সত্য অভিমত ব্যক্ত করতে পারেন।
স্মিথ ১১৪ দম্পতির ওপর একটি গবেষণা চালান। গবেষণায় তিনি তাদের সাম্প্রতিক কলহের বিষয়ে কথাবার্তা বলার সময় পারস্পরিক প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করেন। তিনি প্রত্যেকের ওপর করা পর্যবেক্ষণ নোট করে রাখেন এবং তারপর প্রত্যেকের কার্ডিয়াক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়। দেখা যায় যে, যারা বৈরভাব এবং কম গঠনমূলক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে তাদের মধ্যে উচ্চতর করোনারি অ্যাথেরোসক্লেরোসিস ছিল। তাদের প্রসঙ্গে স্মিথ বলেন, ‘তাদের নিজস্ব রিপোর্টের চেয়ে তাদের পারস্পরিক প্রতিক্রিয়া ভালো পূর্বাভাষদাতা ছিল (রোগের ব্যাপারে)।’ তিনি বলেন যে, কলহ ধূমপান বা স্থূলতার মতোই কার্ডিয়াক সমস্যার জন্য দায়ী।
কিন্তু তিনি গ্রাহ্য করেন না যে, বিবাহ একটি জাদুকরী বুলেট। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি না যে এই সম্পর্কে জাদুকরী কোনো কিছু আছে, এটি হচ্ছে দীর্ঘসময়ের আন্তঃব্যক্তিগত সম্পর্কের পুনরাবৃত্তিমূলক নমুনা।’ তিনি কতগুলো প্রশ্ন রাখেন: আমাদের কি অন্যদের সঙ্গে নিয়মিত সন্তোষজনক সম্পর্ক আছে বা আমরা কি ভিন্নতা এবং একাকিত্ব অনুভব করি? আমরা যখন ভিন্নতা অনুভব করি তখন গঠনমূলক সহযোগিতার জন্য কাউকে আহ্বান করতে পারি, এটা কি আমরা অনুভব করি? অথবা আমরা কি সরাসরি দ্বন্দ্বমূলক কোনো প্রবৃত্তির সঙ্গে জড়িত?
তিনি অনুমান করেন যে, বিয়ে এসব স্বাস্থ্য প্রতিক্রিয়াকে বাড়িয়ে তুলবে। কিন্তু এসব সংঘটিত হওয়ার জন্য এটি কোনো পারফেক্ট মার্কার নয়।
তথ্যসূত্র : টাইম