অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভপাত কেন হয়?
দৈনিক সিলেট ডট কম
দৈনিকসিলেটডেস্ক: মিসক্যারেজ বা অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভপাত- এ কথাটি শুনেই অনেকে মুখ ফিরিয়ে নেন, অস্বস্তিতে কুঁকড়ে যান অনেকে। কিন্তু কেন? মিসক্যারেজের কারণ নিয়ে অনেকেরই আছে অনেক কুসংস্কার, আছে অনেক ভীতি। কিন্তু আসলেই মিসক্যারেজের জন্য কী কী দায়ী? তা জানতে আমরা কথা বলি আনোয়ার খান মডার্ন হসপিটালের মেডিকেল অফিসার ডঃ আয়েশা নূর মিলির সাথে।
মিসক্যারেজ হবার বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে বলে জানান তিনি, আর গর্ভাবস্থার বিভিন্ন পর্যায়ে অর্থাৎ, প্রথম ও দ্বিতীয় তিন মাস বা ট্রাইমেস্টারে আলাদা আলাদা কারণে হতে পারে মিসক্যারেজ।
প্রথম ট্রাইমেস্টার (১ থেকে ১৩ সপ্তাহের মাঝে)
প্রথম ট্রাইমেস্টারে সাধারণত ভ্রূণ বা ফিটাসের কোন অ্যানোমালি (সমস্যা) থাকলে মিসক্যারেজ হতে পারে। প্রতি চারটি মিসক্যারেজের মাঝে তিনটি হয়ে থাকে এই সময়ে।
ক্রোমোজমের সমস্যা
ক্রোমোজোম হলো ডিএনএর টুকরো। এগুলো ধারণ করে এমন কিছু নির্দেশনা যা শিশুর জীবনের অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণ করে, যেমন শরীরের বৃদ্ধি, চোখের রং ইত্যাদি। কখনো কখনো গর্ভধারণের প্রক্রিয়ায় সমস্যা দেখা দিতে পারে এবং ভ্রূণে খুব বেশি বা খুব কম পরিমাণে ক্রোমোজোম উপস্থিত থাকতে পারে। এর কারণটা সব সময়ে পরিষ্কার নয়। তবে এর ফলে ভ্রূণ সঠিকভাবে বাড়ে না এবং মিসক্যারিজ হয়ে যায়। গর্ভাবস্থার প্রাথমিক পর্যায়ে যেসব মিসক্যারিজ হয় তার তিনভাগের দুইভাগ হয় এই কারণে। কিন্তু তারমানে এই নয় যে এর পেছনে শিশুর পিতা বা মাতার ক্রোমোজোমের কোন দোষ আছে।
প্ল্যাসেন্টার কোনো সমস্যা
প্ল্যাসেন্টা হলো সেই অঙ্গ যা মায়ের রক্তপ্রবাহকে শিশুর রক্তপ্রবাহের সাথে যুক্ত রাখে। প্ল্যাসেন্টার গঠনে কোনো সমস্যা হলে তা থেকেও মিসক্যারেজ হতে পারে।
এ সময়ে যা যা বাড়ায় মিসক্যারেজের ঝুঁকি-
দৃশ্যত কোন কারণ ছাড়াও এই সময়ে মিসক্যারেজ হতে পারে। এমনকি তা এত আগে হয়ে যেতে পারে যে সেই নারী আসলে বুঝেও উঠতে পারেন না যে তিনি আসলে গর্ভবতী ছিলেন কিছুদিনের জন্য। তবে কিছু কিছু কাজ এ সময়ে গর্ভপাতের ঝুঁকি বাড়ায়। বিশেষ করে মায়ের বয়স এখানে একটা জরুরী ব্যাপার-
– ৩০ বছরের কম বয়সী নারীর প্রতি ১০জনে ১ জনের গর্ভপাত হতে পারে
– ৩৫-৩৯ বছর বয়সী নারীর প্রতি ১০ জনে ২ জনের গর্ভপাত হতে পারে
– ৪৫ বছরের বেশি বয়সই নারীর অর্ধেকেরও বেশি গর্ভপাত হতে পারে
অন্যান্য রিস্ক ফ্যাক্টরের মাঝে থাকে-
– ওবেসিটি বা অতিরিক্ত ওজন
– গর্ভাবস্থায় ধূমপান
– গর্ভাবস্থায় মাদক সেবন
– দৈনিক ২০০ মিলিগ্রামের বেশি ক্যাফেইন পান (এক মগ ইনস্ট্যান্ট কফিতে ১০০ মিলিগ্রাম এবং এক মগ চায়ে ৭৫ মিলিগ্রাম ক্যাফেইন থাকে)
ক্যাফেইন
দৈনিক ২০০ মিলিগ্রামের বেশি ক্যাফেইন পান বাড়ায় গর্ভপাতের ঝুঁকি। ছবি: নূর
সেকেন্ড ট্রাইমেস্টার (১৪ থেকে ২৬ সপ্তাহের মাঝে)
এ সময়ে মিসক্যারেজ হতে পারে গর্ভবতী নারীর কোনো শারীরিক সমস্যার কারণে। ভ্রূণের কোনো ইনফেকশনের কারণেও হতে পারে তা। এসব ইনফেকশনে সাধারণত শিশুকে ঘিরে থাকা পানি ভাঙ্গার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
দীর্ঘমেয়াদি কোন অসুখ
বিভিন্ন ক্রনিক স্বাস্থ্য সমস্যা এ সময়ে ঝুঁকির সৃষ্টি করে। তার মাঝে আছে-
– ডায়াবেটিস (অনিয়ন্ত্রিত)
– উচ্চ রক্তচাপ
– লুপাস
– কিডনি রোগ
– অতিসক্রিয়া বা কম সক্রিয় থাইরয়েড গ্রন্থি
ইনফেকশন
কিছু কিছু ইনফেকশনও গর্ভপাতের ঝুঁকি বাড়ায়। এগুলো হলো-
– রুবেলা
– সাইটোমেগালোভাইরাস
– ব্যাকটেরিয়াল ভ্যাজাইনোসিস
– এইচআইভি
– ক্ল্যামাইডিয়া
– গনোরিয়া
– সিফিলিস
– ম্যালেরিয়া
ফুড পয়জনিং
সংক্রমিত খাবার থেকে হওয়া ফুড পয়জনিং বাড়াতে পারে গর্ভপাতের ঝুঁকি। যেমন
লিস্টেরিওসিস- অপাস্তরিত দুধ এবং দুগ্ধজাত খাবার থেকে হতে পারে
টক্সোপ্লাজমোসিস- কাঁচা বা আধাসেদ্ধ মাংস থেকে হতে পারে
স্যালমোনেলা- সাধারণত কাঁচা বা আধাসেদ্ধ ডিম থেকে হতে পারে
ওষুধ
কিছু কিছু ওষুধ বাড়াতে পারে আপনার মিসক্যারিজ হবার সম্ভাবনা, যেমন- মাইসোপ্রোস্টল, রেটিনয়েড, মেথোট্রেক্সেট এবং নন-স্টেরয়ডাল অ্যান্টি-ইনফ্লামেটরি ড্রাগস। গর্ভাবস্থায় নিরাপদ থাকতে যে কোনো ওষুধ গ্রহণের আগে অবশ্যই ডাক্তারের অনুমতি নিতে হবে।
কিছু খাবার
গর্ভাবস্থায় আনারস এবং পেঁপে খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে কারণ এগুলো গর্ভপাতের ঝুঁকি বাড়ায়।
গর্ভের কাঠামো
গর্ভের গঠনে বিভিন্ন সমস্যা এবং জটিলতার কারণেও সেকেন্ড ট্রাইমেস্টারে গর্ভপাত হতে পারে। এ সমস্যাগুলোর মাঝে থাকতে পারে-
– গর্ভে ফাইব্রয়েডের উপস্থিতি
– অস্বাভাবিক গড়নের গর্ভ
– দুর্বল সারভিক্স
পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম (PCOS)
এটা এমন একটি জটিলতা যেখানে ওভারিগুলো হয়ে থাকে স্বাভাবিকের চাইতে বড়। সাধারণত হরমোনাল চেঞ্জের কারণে এটা হয়। PCOS এর কারণে বন্ধ্যাত্ব দেখা দিতে পারে। এর পাশাপাশি এর কারণে মিসক্যারিজ হয়, তার কিছু প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে কী কারণে তার গর্ভপাতের জন্য দায়ী তা পরিষ্কার নয়।
মিসক্যারেজ নিয়ে কুসংস্কার
গর্ভপাতের ঝুঁকি নিম্নোক্ত কাজগুলোতে বাড়ে না-
– মায়ের মানসিক অবস্থা যেমন স্ট্রেস বা ডিপ্রেশন
– ভয় বা শক পাওয়া
– ব্যায়াম (তবে কী ধরণের ব্যায়াম করবেন তা অবশ্যই ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করে নেবেন)
– কোনো কিছু ওঠানো
– চাকরি বা কাজ করা
– শারীরিক সম্পর্ক
– বিমানে ভ্রমণ করা
– ঝাল খাবার খাওয়া
অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, বিভিন্ন কারণে গর্ভপাত হয় এবং অনেক সময়ে তার কারণটা বোঝাও যায় না। ফলে এ সময়ে যার গর্ভপাত হয়েছে সেই নারীকে কোনোভাবেই দোষারোপ করা সমীচীন নয়।