জামায়াতের রাজনীতিতে রবীন্দ্রনাথের নির্দেশনা!
দৈনিক সিলেট ডট কম
দৈনিকসিলেটডেস্ক:উনিশ শতকের শুরুতে বঙ্গভঙ্গের সময়কালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বেশ কয়েকটি প্রতিবাদী গান জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এর মধ্যে ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে’ গানটি অন্যতম। যা ‘একলা চলো রে’ হিসেবেই পরিচিত। অন্যের কাছে গুরুত্ব না পেলে শ্রোতা যাতে তাঁর যাত্রা বন্ধ না করেন, তার অনুপ্রেরণা হিসেবে এই গান রচিত হয়। ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা মহাত্মা গান্ধী এই গানের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। নিজ কর্মে সফলও হয়েছিলেন।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে অন্যতম প্রভাবশালী দল জামায়াত ইসলামী এখন রবীন্দ্রনাথের সেই গানের নীতিতেই এগোচ্ছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হওয়া রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থীকে সমর্থন দেয়নি বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের প্রধান শরিক এই দলটি। নিজেদের কড়া অবস্থান বুঝিয়েছেন। ভোটও দেননি জামায়াতের ভোটাররা। সে নিয়ে জোটে ছিল তুমুল ঝড়।
সেই রেশ না কাটতেই এবার ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) উপ-নির্বাচনে হঠাৎ মেয়র প্রার্থী ঘোষণা করেছে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত এই দলটি। ঢাকা উত্তর জামায়াতের আমির ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য মুহাম্মদ সেলিম উদ্দিনকে প্রার্থী করা হয়েছে। শুরু করেছে গোপন গণসংযোগও। এ নিয়ে নতুন করে জোটের মধ্যে শুরু হয়েছে ঝড়। এতে বিএনপিসহ জোটের অনেক নেতাই বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত নিল কেন জামায়াত? সেই প্রশ্ন এখন জোট নেতাদের মুখে মুখে।
দীর্ঘদিন থেকে নির্বাচন কমিশনে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন স্থগিত রয়েছে। এ অবস্থায় দলীয় প্রতীকে নয়, স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবেই দাঁড়াতে হবে জামায়াত প্রার্থীকে। সেক্ষেত্রে অনেকেই মনে করেছিল, জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হওয়ায় সেই ভোট ব্যাংক বিএনপির দিকেই ঝুকবে। কিন্তু রংপুর সিটি নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবির পর ঢাকা উত্তরে জামায়াত প্রার্থী দেয়ায় নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে বিএনপিকে।
জামায়াত নেতারা জানিয়েছেন, রংপুর সিটি কর্পোরেশন (রসিক) এলাকায় জামায়াতে ইসলামীর প্রায় ১৫ হাজার রিজার্ভ ভোট থাকলেও সেখান থেকে কোনো ভোট বিএনপি প্রার্থীকে দেয়া হয়নি। এর কারণ হিসেবে জামায়াত নেতারা বলছেন, রংপুরের নির্বাচন নিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে জামায়াত বিএনপির সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করেনি। কেন্দ্রীয়ভাবে যোগাযোগ হলেও তা বলার মতো ছিল না। তাই তারা সাংগঠনিকভাবে কোনো প্রচার-প্রচারণায় অংশ নেননি।
তারা বলছেন, জামায়াত বা জোটের সঙ্গে কথা না বলে একক সিদ্ধান্তে বিএনপির প্রার্থী মনোনয়ন, মনোনয়নের পরও জামায়াতের সঙ্গে এ নিয়ে কোনো ধরনের সাংগঠনিক বৈঠক না করা, রসিক নির্বাচনে জোটের কোনো সমন্বয় কমিটি করা হয়নি, রংপুরে স্থানীয় জামায়াত নেতাদের বিপদ-আপদে বিএনপির পাশে না থাকা, এমনকি জেলে কারাবন্দি জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের ন্যূনতম সহানুভূতি না দেখানোর ঘটনা এবারের নির্বাচনে জামায়াতকে ক্ষুব্ধ করেছে। এর প্রভাব পড়েছে ঢাকা উত্তর সিটি নির্বাচনেও।
দলটির একাধিক সূত্র জানিয়েছে, জামায়াত-শিবিরের হাজার হাজার নেতাকর্মী কারাগারে রয়েছে। অসংখ্য নেতাকর্মী আছেন আত্মগোপনে। কিন্তু এসব নেতা-কর্মীদের সহায়তায় বিএনপি হাইকমাণ্ড কখনোই এগিয়ে আসেননি। নিজেদেরই সবকিছু মোকাবেলা করতে হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে জামায়াতের সাম্প্রতিক গোপন বৈঠকে ‘একলা চলো’ নীতির আলোকেই চলতে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
এ নিয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল ঢাকা মহানগর উত্তর জামায়াতের এক নেতার কাছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই নেতা বলেন, বিএনপি কী মনে করে, কোনো বিষয়ে জামায়াত বা জোট শরিকদের মূল্যায়ন না করে শুধুমাত্র নির্বাচন এলে ভোট পাবে? রংপুরে এবার সেই সুযোগ জামায়াত বিএনপিকে নিতে দেয়নি।’ তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘রংপুর নির্বাচন নিয়ে বিএনপি কার সঙ্গে আলোচনা করেছে? জোটের কোনো সভা কি হয়েছে? সেখানে কিছুই হয়নি।’ এই নেতা আরো বলেন, ‘ঢাকা উত্তর সিটি নির্বাচন ২৬ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু এখন পর্যন্ত বিএনপি এ নিয়ে আমাদের আলোচনা করতে আসেনি। দল হিসেবে আমাদেরও গুরুত্ব রয়েছে। নিজস্ব ভোট রয়েছে। আমরা কেন বসে থাকবো?’
সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, জামায়াত প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়ায় অনেকটাই চমকে গেছে বিএনপি ও ২০ দলীয় জোট। দলটির হঠাৎ এ সিদ্ধান্তের পর চিন্তায় পড়েছে বিএনপিও। শুধু তাই নয়, জামায়াতের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন বিএনপির শীর্ষ নেতারা। পরবর্তী জোটের এ বিষয়ে আলোচনা হতে পারে।
যদিও ২০ দলীয় জোটের নেতারা জানিয়েছেন, জামায়াত কেবল নিজেদের গুরুত্ব বাড়াতে চাচ্ছে। উত্তর সিটির উপ-নির্বাচন ও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দর কষাকষি করতেই এ ধরনের তৎপরতা শুরু করেছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি) চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ আরটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘জোটের অনেক বিষয় নিয়েই সবার মাঝে ক্ষোভ আছে। সেটা থাকতেই পারে। তবে জামায়াত তো আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেনি এখনো। সম্ভবত দর কষাকষি করতেই জামায়াতের এরকম অবস্থান নেওয়া। স্বতন্ত্র অবস্থান দেখাতেই প্রার্থী দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী।’ এতে জোটের কর্মকাণ্ডে কোনো প্রভাব পড়বে না বলেও মত প্রকাশ করেন তিনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জামায়াতের মজলিসে শূরা সদস্য আরটিভি অনলাইনকে জানান, ‘পার্টির জনশক্তিকে কাজে লাগানো ও ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষ্যেই ডিএনসিসি’তে মেয়র প্রার্থী দেয়া হয়েছে। জোটের বৈঠকে এখনো একক প্রার্থী দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়নি। দল হিসেবে জনগণের মাঝে আমাদের অবস্থান জানাটাও জরুরি। এজন্য আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, উত্তর সিটি নির্বাচনে জামায়াত থেকে প্রার্থীতা দেয়া হবে। এতে দলের শক্তিও স্পষ্ট হবে।’
তিনি বলেন, ‘বিএনপি তো জিজ্ঞাসাও করে না প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে। আমরা মনে করি, জামায়াতের অবস্থা আগের চেয়ে ভালো। তাই মেয়র প্রার্থী মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। এতে দোষের কি আছে?’
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘উত্তর সিটি নির্বাচনে জোটের প্রার্থী কে হবে, সেটা এখনো নির্ধারণ হয়নি। জোটের বৈঠকেই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে।’ জামায়াতের প্রার্থীতা নিয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
উৎসঃ আরটিভি