স্ত্রী মারা গেছেন, আবার বিয়ে!
দৈনিক সিলেট ডট কম
সুলতানা আলগিন: জীবনসঙ্গীর অকালপ্রয়াণ শোকাবহ ও কষ্টদায়ক। ব্যক্তিজীবনে মানুষকে তা করে দেয় একা ও নিঃসঙ্গ। তাই পুনরায় বিয়ে নারী বা পুরুষের যৌক্তিক আইনি অধিকার। এটা নবজীবনের সন্ধান দেয়। পাশাপাশি নানা সমাজবাস্তবতা, পারিবারিক সংকট, আশঙ্কার বিষয়গুলো আমলে না নিয়ে উপায় নেই।
লাইফ স্ট্রেস স্কেল
হোমস-রাহের লাইফ স্ট্রেস ইনভেনটরি অনুযায়ী মানুষের জীবনে ৪৩টি স্ট্রেস বা জীবনের ঘটনা মানুষকে মানসিক যন্ত্রণার মুখোমুখি করে। এগুলোর মধ্যে স্ত্রী বা স্বামীর মৃত্যু, তালাক, বিচ্ছেদ পরপর প্রথম ৩টি স্থান এবং বিয়ে সপ্তম স্থান দখল করে নিয়েছে। স্কেলে স্কোরিং অনুযায়ী ১৫০-৩০০ হলে পরবর্তী দুই বছরে স্ট্রেসজনিত স্বাস্থ্যহানির আশঙ্কা ৫০ শতাংশ আর স্কোর ৩০০-এর বেশি হলে পরবর্তী দুই বছরে স্ট্রেসজনিত স্বাস্থ্যহানির আশঙ্কা ৮০ শতাংশ।
আমাদের দেশে ঢাকা স্ট্রেস স্কেল চালু আছে। সমাজ-সংস্কৃতিতে ‘সন্তানের মৃত্যু’ এসব স্ট্রেসের মধ্যে এগিয়ে আছে।
৩৫-৩৬ বছর বয়সী একজন নারী একটু দ্রুততার সঙ্গে চেম্বারে ঢুকলেন। বললেন, আপনার সঙ্গে একটু কথা ছিল।
বললাম, বলুন।
তিনি জানালেন, তাঁরা চার বোন এক ভাই। ভাই এখনো স্কুলের গণ্ডি পেরোয়নি। বোনদের বিয়ে হয়ে গেছে। তাঁদের মা ছয় মাস হলো মারা গেছেন। মেয়ে হওয়ায় তাঁরা কেউই বাবা-ভাইয়ের খোঁজখবর রাখতে পারছেন না। যে যাঁর সংসার নিয়ে ব্যস্ত। এখন বাবা একা একা সংসারের চাপ নিতে পারছেন না। তিনি বিয়ে করতে চাইছেন। এখন আপনিই বলুন এসব শুনে বোনদের শ্বশুরবাড়ির লোকেরা হাসাহাসি করছে। স্বামীরা হেসে হেসে বলছেন, তাঁদেরও পথ সুগম হলো।
তিনি জানতে চেয়ে বললেন, বাবার মাথা ঠিক আছে কি না। ব্রেনের কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে হবে কি না।
একটার পর একটা প্রশ্ন করেই যাচ্ছেন।
আমি বললাম, উনি যথেষ্ট সেবাশুশ্রূষা পাচ্ছেন না, তাই হয়তো এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছেন।
এর মধ্যে বাবা ঢুকে পড়লেন। দেরি না করে জানালেন, ছেলের সংসারী হতে এখনো অনেক দিন বাকি। মেয়েরা বিভিন্ন রকম সেবা ওদের মায়ের কাছ থেকে পেয়েছে। এখন ওরাও কম আসে। আমার তাহলে কেমনে চলবে? আপনিই বলেন?
কথা বলে দেখলাম, ভদ্রলোকের স্ত্রীর ওপর অধিক নির্ভরশীলতা, একাকিত্ব তাঁকে নতুন জীবনসঙ্গী খুঁজতে উৎসাহিত করেছে। সহকর্মী প্রতিবেশীরা কয়েকটা সম্বন্ধ নিয়ে এসেছেন। বললেন, ছেলেমেয়েরা আমার সঙ্গে প্রচণ্ড খারাপ ব্যবহার করছে। আপনি এটার একটা সমাধান করে দেন।
স্ত্রী মারা গেলে সবাই কি বিয়ে করেন?
সবাই বিয়ে করেন না। বেশির ভাগ নারী স্বামী মারা গেলে সন্তানদের নিয়ে বাকি জীবন কাটিয়ে দেন। কিন্তু পুরুষদের অনেকেই দ্বিতীয় বিয়ে করেন। কারও কারও পরিবারে হয়তোবা দ্বিতীয় বিয়ে করার রীতি প্রচলিত আছে। ছেলেরা ছোটবেলা থেকে সংসারের কাজে অনভ্যস্ত। তাই ভীতি কাজ করে। সন্তানের লালন-পালন স্ত্রীরাই করেন। এই ব্যাপারটা এড়াতে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে পুরুষেরা দেরি করেন না।
ছেলেমেয়েরা অনিচ্ছুক হলেও আত্মীয়স্বজনের অনেকেই প্রবল উৎসাহ নিয়ে এগিয়ে আসেন। তাঁরা উদ্বুদ্ধ করেন। পুরুষ মানুষের বউ ছাড়া কি চলে? কে তাঁকে দেখবে? ছেলেমেয়ে আর কয়দিন। নানা রকম বিচিত্র যুক্তি। পেশাগত কারণে নানা ভুক্তভোগীর অভিজ্ঞতা জেনেছি। বিপত্নীকের মা, বোন, ভাবিরাও উসকানিতে কম যান না। নতুন নতুন সব উপসর্গ যোগ হয়। এখন অনেকে ধর্মীয় রীতির দোহাই দেন। বলেন, বিয়ে করাই উত্তম। পুরুষ মানুষের বিয়ে করাই উত্তম। একা থাকা ঠিক না।
কারা করেন না?
যাঁরা স্ত্রীকে ভালোবাসতেন অথবা আর সংসারের বাঁধনে জড়াতে চান না। যাঁরা ঘরকুনো; মানুষের সঙ্গে তেমন মেশেন না, তারা বিয়ে করে নতুন ঝামেলায় জড়াতে চান না। সন্তানদের নিয়ে থাকেন বা নিজের মতো থাকেন। আবার অনেকে আছেন এসব ভুলে থাকতে কাজকে আপন করে নেন। বাইরে ব্যস্ততা বাড়িয়ে দেন।
কেন করেন?
সামাজিক চাপ, জৈবিক তাড়না আর মানসিক জটিলতা মোকাবিলার জন্য বিয়ে করতে বাধ্য হন। পুরুষশাসিত সমাজে দ্বিতীয় বিয়ে তেমন কোনো ব্যাপার নয়। সবাই এটা মেনে নেয়। চাপে থাকে সন্তানেরা। তারা না পারে সইতে না পারে কিছু করতে। বংশের নতুন নতুন প্রদীপ জ্বালানোর জন্য আত্মীয়স্বজন অস্থির হয়ে পড়েন। জৈবিক তাড়না অনেকে স্বীকার করতে লজ্জা পান। কিন্তু বাস্তবে এটা মেনে নেওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ। এতে অনেক অঘটন থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
বিয়ের পর সমস্যা
বিয়ের পর সমস্যাও কম নয়। নানা রকম পারিবারিক সংকট দেখা দেয়। বাবা বা মায়ের নতুন বিয়ের প্রতি সন্তানদের সমর্থন বিরল। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সন্তানদের মধ্যে মনোজটিলতা দেখা দেয়। তারা মানতে পারে না। বিয়ে যতটা না দেয় মানসিক প্রশান্তি; তার চেয়ে ক্ষেত্রবিশেষে সার্বিক অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এমনও জীবনকাহিনি জেনেছি, বাবার দ্বিতীয় বিয়ের পর সন্তানেরা অনেক দূরে সরে গেছে। বাবা ও সন্তানের যে স্বাভাবিক সম্পর্ক ও আনন্দ; তা নষ্ট হয়েছে। এই মানসিক চাপও একজন বাবার জন্য বিব্রতকর ও দুঃসহ। একজন বিপত্নীক বিয়ে চান; কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সন্তানদের সঙ্গে দূরত্বও চান না। সম্পত্তির বণ্টন নিয়ে তীব্র টানাপোড়েন ও মামলা-মোকদ্দমা চলতে থাকে। নতুন মায়ের সঙ্গে সন্তানদের দুর্ব্যবহার; দূরত্ব, মন্দ ও তিক্ত সম্পর্ক; কিংবা স্বামীর আগের পক্ষের সন্তানদের সঙ্গে নতুন মায়ের অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যবহার রীতিমতো সাহিত্যের অনুষঙ্গ। এই জটিল পরিস্থিতির দুই পিঠেই আছে অনেক যুক্তি ও কষ্টের গল্প।
আবার মা-বাবার নতুন বিয়ের সঙ্গে সুন্দর মানিয়ে নেওয়া বা আগের পক্ষের সন্তানদের প্রতি অনন্য ভালোবাসা, স্নেহ ও মধুর বন্ধনের কাহিনিও একদম বিরল নয়।
যা করা উচিত
বাস্তব পরিস্থিতির আলোকে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। কোন পরিস্থিতিতে বিয়ে, কেন, সমস্যা-সংকট, সুবিধা-অসুবিধা সব ইস্যু ঠান্ডা মাথায় বিচার-বিশ্লেষণ করে নেওয়াই উত্তম।
কারও প্ররোচনায় নয়; বরং এ ধরনের জটিল পারিবারিক সমীকরণ সমাধানে নিজের বিবেক-বুদ্ধিকে প্রাধান্য ও গুরুত্ব দিতে হবে।
সন্তানদের কাছে নিজের ইচ্ছাকে লুকানো চলবে না। তাদের সঙ্গে খোলা মনে আলাপ করাই উত্তম।
সন্তানদের চাহিদা, যুক্তি-প্রতিযুক্তি, বক্তব্য সর্বাধিক গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে।
কেন বিয়ে দরকার, কী সুবিধা; সেসব সন্তানদের কাছে তুলে ধরা দরকার। নিজে না পারলে আত্মীয়স্বজন এ ক্ষেত্রে আলাপে সহায়তা করতে পারেন।
যাঁর সঙ্গে বিয়ে, তাঁকে নিজ সংসারের বাস্তব পরিস্থিতি, সন্তানদের মনোভাব, মানিয়ে নেওয়ার সহায়তা—এসব বিষয়ে আলোচনা থাকতে হবে।
শুধু বিয়ের পিঁড়িতে বসা নয়; নবাগতকেও বুঝতে হবে। তাঁর ইচ্ছা-অনিচ্ছা, আগ্রহ, আত্মবিশ্বাসকে মূল্যায়ন করতে হবে।
নতুন যাঁর সঙ্গে নিবন্ধন; তাঁর সঙ্গে বিয়ের সম্পর্ক গড়ার আগে সন্তানদের সঙ্গে পরিচয় করানো ভালো। তাঁদের মধ্যে বোঝাপড়া, সহজিয়া সম্পর্ক, ভাববিনিময় দরকার।
নতুন একটি বন্ধনে জড়িয়ে আরেকটি জীবনকে সমস্যার তিক্ততায় বাঁধা নয়। এই বিয়ে যেন আনন্দ, সুখ, স্বস্তি ও প্রশান্তির হয়; সেটা বিবেচনায় নিয়েই সিদ্ধান্ত কাম্য।
মানসিক সম্পর্কবিদ ও সহযোগী অধ্যাপক, মনোরোগ বিদ্যা বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
-প্রথম আলো