ফাঁকা বাসে ভয়ঙ্কর ফাঁদ, টার্গেট কম বয়সী নারী যাত্রী
দৈনিক সিলেট ডট কম
নিউজ ডেস্ক:: শেষ বিকেল। একটু পরই সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসবে। চোখে মুখে অনিশ্চয়তা নিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন মেয়েটি। নাম মিতা আক্তার (ছদ্মনাম), বয়স আনুমানিক ২০ বছর। গ্রামের বাড়ি নওগাঁ। দুই মাস হয়েছে মিতা ঢাকায় এসেছে। ততটা চেনা জানা নেই শহুরে রাস্তাঘাট। তার গন্তব্য নবীনগর। পথ না চেনায় বাইপাইল বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষা করছিলেন মেয়েটি। কিভাবে গন্তব্যে পৌঁছাবে, এমন চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল তার মাথায়। এমন ভাবনায় যখন মিতা কিংকর্তব্যবিমূঢ়, তখনই হঠাৎ তার সামনে দাঁড়াল এক যুবক।
আপা কোথায় যাবেন? স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে মিতা বললেন, নবীনগর। সে সময় পাশেই ছিলেন ‘আশুলিয়া ক্লাসিক’ নামে বাইপাইল-আব্দুল্লাহপুর-মহাখালী রুটের একটি বাস। বাসটির হেলপার ওই যুবক।
ছেলেটি মিতাকে জানাল, এ বাসটিই নবীনগর যাবে। বাইপাইল থেকে নবীনগর যাওয়ার জন্য বাসে উঠে পড়ে মিতা। কিছু দূর যেতেই বাধে বিপত্তি। সন্ধ্যায় বাসটি গন্তব্যে না গিয়ে থামে নির্জন জায়গায়। এরপর বাসচালক ও সুপারভাইজার মিতাকে ধর্ষণের চেষ্টা করে। চিৎকার করে মেয়েটি। আর সেই চিৎকার কানে পৌঁছায় ঘটনাস্থলের অদূরে থাকা র্যাবের গোয়েন্দা দলের। তারা দ্রুত এসে উদ্ধার করে মেয়েটিকে। এ যাত্রায় রক্ষা মেলে মিতার। ঘটনাটি গত শনিবার সন্ধ্যায়।
গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় এক তরুণী (২৫) রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোডে তার খালার বাসা থেকে টঙ্গীর উদ্দেশে আসমানী পরিবহনের (ঢাকা মেট্রো-ব-১১-৮৩২৮) একটি বাসে ওঠেন। পরে বাসের মধ্যে ওই তরুণী ঘুমিয়ে পড়েন। সন্ধ্যা সোয়া ৭টার দিকে কারো হাতের স্পর্শে তার ঘুম ভাঙলে দেখতে পান বাসের চালক-হেলপারসহ আরো কয়েকজন তাকে ঘিরে ধরেছে।
পরে তার কাছ থেকে মোবাইল ফোন ও গলায় থাকা একটি স্বর্ণের চেন ছিনিয়ে নেয় ওই দুর্বৃত্তরা। এরপর মেয়েটিকে ধর্ষণের চেষ্টা চালায় তারা। সম্ভ্রম বাঁচাতে মেয়েটি চলন্ত বাসের জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়ে। এতে তার মাথা, হাত-পাসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় গুরুতর আঘাত পায়।
ঘটনাটি বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল। এ ঘটনায় মামলা হলে পুলিশ চালককে গ্রেফতার করলেও অন্যদের গ্রেফতার করতে পারেনি। শুধু এই দু’টি লোমহর্ষক ঘটনাই নয়, ঢাকার আশপাশে রাস্তায় এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটে। কিছু কিছু ঘটনায় জানাজানি হলেও বেশির ভাগেই লোকলজ্জার ভয়ে অভিযোগ করেন না ভুক্তোভোগীরা।
র্যাব ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শুধু ঢাকার আশপাশেই নয়, দেশের মহাসড়কেও রাতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এই ভয়ঙ্কর চক্রের সদস্যরা। এ চক্রটি দিনের বেলায় যাত্রী আনা-নেয়া করলেও সন্ধ্যা নামলেই এরা ভয়ঙ্কর বনে যায়। তাদের টার্গেট থাকে নারী যাত্রী। বাসে যাত্রী তোলার নাম করে রাস্তায় গন্তব্যের জন্য দাঁড়িয়ে থাকা কম বয়সী নারী যাত্রীদের টার্গেট করে। এরপর টার্গেট করা তরুণীর পাশাপাশি কিছু যাত্রীও বাসে ওঠায়। এরপর একটা নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে অন্য যাত্রীদের নামিয়ে দেয়। পাশাপাশি টার্গেটকৃত তরুণীকে গন্তব্যে পৌঁছানোর আশ্বাস দিয়ে গাড়ি দ্রুত চালিয়ে নির্জন স্থানে নিয়ে পাশবিক নির্যাতন চালায়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাতে কর্মব্যস্ত মানুষের নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছানোয় যানবাহনের স্বল্পতা থাকে। আর এ সমস্যাকে কাজে লাগিয়ে এক রুটের বাস অন্য রুটে যাওয়ার কথা বলে লোক উঠিয়ে ফাঁদ পাতছে বেশ কিছু সঙ্ঘবদ্ধ অপরাধী চক্র।
র্যাব জানায়, বাসটি আব্দুল্লাহপুরে পৌঁছানোর পর সব যাত্রীকে নামিয়ে দেয়া হয়। ভিকটিমও নেমে পড়ে। সব যাত্রী চলে যাওয়ার পর বাসের চালক, হেলপার ও সুপারভাইজার মেয়েটিকে গন্তব্যে পৌঁছে দেয়ার কথা বলে জোরপূর্বক বাসে তুলে ধর্ষণ চেষ্টা চালায়। এ সময় র্যাব মেয়েটিকে উদ্ধার করে। তখন বাসের চালক খলিল মিয়া, সুপারভাইজার মেহেদী হাসান বাবু ও হেলপার রাকিব হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়।
গতকাল দুপুরে রাজধানীর কাওরান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে র্যাব-১ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল সারোয়ার-বিন-কাশেম বলেন, চক্রটি বাস চালানোর পাশাপাশি নারী যাত্রীদের টার্গেট করে ধর্ষণ করত এবং মূল্যবান জিনিসপত্র ছিনিয়ে নিত। গ্রাম থেকে আসা তরুণীদের গন্তব্যে পৌঁছানোর কথা বলে তারা বাসে তুলত। পরে নির্জন জায়গায় গিয়ে জোরপূর্বক ধর্ষণ করত এবং ভিডিও করে রাখত। সেই ভিডিও ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয়ার ভয় দেখাত। এতে অনেকে লজ্জায় বিষয়গুলো গোপন রাখত।
র্যাব কর্মকর্তা বলেন, শনিবার তরুণীটি বাইপাইল থেকে নবীনগর যাওয়ার জন্য বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষা করছিল। এ সময় ‘আশুলিয়া ক্লাসিক’ নামক বাইপাইল-আব্দুল্লাহপুর-মহাখালী রুটের একটি বাস থামিয়ে হেলপার তাকে গন্তব্য জিজ্ঞাসা করলে ভিকটিম নবীনগর যাওয়ার কথা জানায়। এ সময় হেলপার তাকে নবীনগর নামিয়ে দেয়ার কথা বলে গাড়িতে তুলে নেয়। ঢাকায় নতুন আসায় ও রাস্তাঘাট চেনা না থাকায় ভিকটিম তাদের কথামতো বাসে উঠে পড়ে। এ সময় তরুণী তার ভাইকে ফোন দিয়ে সুপারভাইজারের কাছে ঠিকানা জানিয়ে দেয়। তারপরও বাসটি কৌশলে তরুণীকে আব্দুল্লাহপুর নিয়ে আসে।
সেখানে পৌঁছানোর পর সব যাত্রীকে নামিয়ে দেয়া হয়। এ সময় ওই তরুণী বাস থেকে নেমে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। এটি দেখে বাসের সুপারভাইজার জোর করে তরুণীকে বাসে তুলে নেয়। পরে বাসটি রাস্তার পাশে থামিয়ে তরুণীকে ধর্ষণের চেষ্টা এবং কাছে থাকা মূল্যবান জিনিস ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। এ সময় তার চিৎকারে পাশে থাকা র্যাবের গোয়েন্দা দলের সদস্যরা তাকে উদ্ধার করে এবং আসামিদের গ্রেফতার করে।
র্যাব জানায়, গ্রেফতার খলিল পেশায় চালক। এক বছর ধরে আশুলিয়া ক্লাসিক বাসের চালক তিনি। তার কোনো ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। এ ছাড়া বাসটিরও কোনো বৈধ কাগজপত্র নেই। মেহেদী হাসান বাবু প্রায় ৬ বছর ধরে ওই বাসের সুপারভাইজার হিসেবে কর্মরত। হেলপার টার্গেটকৃত কোনো নারী যাত্রীকে দেখিয়ে ইশারা করলে সে ভিকটিমের কাছে ভাড়া নিত না বলে জানায়।
একপর্যায়ে সে ভিকটিমের সাথে গল্প-গুজব শুরু করে, যাতে ভিকটিম কোন দিকে যাচ্ছে তা বুঝতে না পারে। এ ছাড়া হেলপার রাকিব মূলত বাসে যাত্রী ওঠানোর সময় কম বয়সী নারী যাত্রীদের টার্গেট করে এবং অপর দু’জনের সাথে ইশারায় জানিয়ে দেয়। এ ক্ষেত্রে তারা পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী কিছু দূর যাওয়ার পর সুযোগ বুঝে বাসের অন্য যাত্রীদের নামিয়ে দেয় এবং বাসে করে ভিকটিমকে জোরপূর্বক নির্জন স্থানে নিয়ে ধর্ষণ করে। এ চক্রটির হাতে এর আগেও অনেক নারী যাত্রী যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে বলে র্যাবের কাছে স্বীকার করেছে গ্রেফতারকৃতরা।