ডেঙ্গু প্রাকৃতিকভাবেও সারতে পারে
দৈনিক সিলেট ডট কম
দৈনিকসিলেটডেস্ক: ডা. খান আবুল কালাম আজাদ কালের কণ্ঠকে বলেছেন ডেঙ্গু প্রাকৃতিকভাবেও সারতে পারে, তবে কিছু লক্ষণে চোখ রাখতে বলেন। কালের কণ্ঠকে দেয়া এক সাক্ষকারে তিনি ডেঙ্গু প্রসঙ্গে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেন। দৈনিকসিলেটের পাঠকদের জন্য তা হুবহু তোলে ধরা হলো:
প্রশ্ন : ডেঙ্গুতে প্লাটিলেট কমে যাওয়া নিয়ে অনেকে বেশ উদ্বিগ্ন।
ডা. খান আবুল কালাম আজাদ : মানুষের দেহে প্লাটিলেট বা অণুচক্রিকার স্বাভাবিক মাত্রা হলো দেড় লাখ থেকে চার লাখ। রত্তক্ষরণ বন্ধে এই প্লাটিলেটের ভূমিকা রয়েছে। ডেঙ্গুতে প্লাটিলেট আক্রান্ত হয় এবং বেশির ভাগ রোগীর প্লাটিলেট কাউন্ট কমে যায়। কখনো বিপজ্জনক পর্যায়ে চলে যায় কিন্তু জানতে হবে সেই বিপজ্জনক পর্যায়টা কত।
একজন মানুষের আগে হয়তো প্লাটিলেট স্বাভাবিক ছিল। ডেঙ্গু হওয়ার পর এটা কমে হয়তো এক লাখ হলো, পরের দিন ৮০ হাজার হলো। এরপর কমে ৬০ হাজার হাজার হলো। এ রকম হতে পারে। প্লাটিলেট তো আর একটা একটা করে গণনা করা হয় না, গুচ্ছ ধরে গণনা করা হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ল্যাবরেটরির কম্পিউটারে এর মাত্রা ১০ হাজার থেকে ২০ হাজার বা এদিক-সেদিক হতে পারে। তাই যদি কারো প্লাটিলেট ৫০ হাজারের মধ্যে থাকে, তবে টেনশন করার কোনো দরকার নেই। প্লাটিলেট ২০ হাজারে নেমে এলেও কিন্তু রক্তক্ষরণ হয় না। তবে ৫০ হাজারের নিচে প্লাটিলেট নেমে গেলে তখন হাসপাতালে ভর্তি করা যেতে পারে।
প্রশ্ন : ইদানীং দেখা যাচ্ছে, ডেঙ্গু হলে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায়ও রক্তের প্লাটিলেট কমে যাচ্ছে।
ডা. খান আবুল কালাম আজাদ : যদি দেখা যায়, কেউ রক্তশূন্যতায় আক্রান্ত হয়েছে, দ্রুত প্লাটিলেটের মাত্রা কমে যাচ্ছে, চামড়ায় রক্তবিন্দুর পরিমাণ বেশি দেখা যাচ্ছে, মাসিকের সময় বেশি রক্ত যাচ্ছে, দাঁতের গোড়া বা মাড়ি দিয়ে রক্ত পড়ছে, খাদ্যনালি থেকে রক্ত পড়ছে, তখন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ব্লাড ট্রান্সফিউশন বা রক্তদানের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন নিয়োজিত চিকিৎসকরা। রোগী বা রোগীর লোকজনের উচিত প্লাটিলেটের বিষয়টি না ভেবে চিকিৎসকদের ওপর আস্থা রাখা।
প্রশ্ন : এখন জ্বরের সঙ্গে অনেকের বমিও হচ্ছে। এটা কি খারাপ কোনো লক্ষণ?
ডা. খান আবুল কালাম আজাদ : বমি মানুষের একটা প্রটেক্টিভ ম্যাকানিজম। কারো দেহে যখন একটা রোগ প্রবেশ করে, তখন সেখানে কতগুলো নন-স্পেসিফিক সিম্পটম হয়। কারোর বমি, মাথা ব্যথা, মাংসপেশির ব্যথা, চামড়ায় অস্বস্তি হতে পারে, ক্ষুধামান্দ্য হতে পারে—এসবই নন-স্পেসিফিক সিম্পটম। তবে ডেঙ্গু হলে কারো কারো ক্ষেত্রে পেটের অভ্যন্তরে কোনো কোনো অর্গানকে ইফেক্ট করতে পারে, সেটা হেপাটাইটিস হতে পারে, লিভারের এনজাইম বেড়ে যেতে পারে।
প্রশ্ন : এই সময় ভিটামিন ‘সি’ বেশি খাওয়ার কথা বলা হয় কেন?
ডা. খান আবুল কালাম আজাদ : ভিটামিন ‘সি’ আমরা খুব পছন্দ করি। এটা রক্তনালিকে শক্তিশালী করে। কিছুটা হলেও ক্ষুধামান্দ্য থেকে রক্ষা করে। কিছু কিছু হিলিং এর ক্ষেত্রে ভিটামিন ‘সি’ খাওয়া যেতে পারে। এর অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট রোল রয়েছে। অর্থাৎ শরীরে যখন বিক্রিয়া হয় বা সেলগুলো ওলটপালট হয়, তখন ভিটামিন ‘সি’ অনেকটাই উপকার করতে পারে।
প্রশ্ন : ডেঙ্গু এনএস১ পজিটিভ মানে কী?
ডা. খান আবুল কালাম আজাদ : এনএস১ হলো একটা অ্যান্টিজেন। নন-স্ট্রাকচারাল অ্যান্টিজেন। এই অ্যান্টিজেন ডেঙ্গু বা ডেঙ্গু ভাইরাসের উপস্থিতিকে প্রমাণ করে। এ জন্য ডেঙ্গু শনাক্ত করতে আমরা ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই এনএস১ অ্যান্টিজেন রক্ত পরীক্ষাটি করাতে বলি। সংক্রমণের পর সাধারণত এক থেকে তিন দিনের মধ্যে এর ফলাফল পাওয়া যায়।
প্রশ্ন : ডেঙ্গু রোগ আসলে কতটা ভয়াবহ? রোগী কখন জটিলতার দিকে যেতে পারে?
ডা. খান আবুল কালাম আজাদ : রক্ত পরীক্ষায় যদি কারো ডেঙ্গু ধরা পড়ে, তাহলে টেনশনের কারণ নেই। এতে ভয়েরও কিছু নেই। সাপোর্টিভ চিকিৎসা ও সঠিক পরিচর্যা করলে জ্বর ভালো হয়ে যায় ও ঝুঁকিমুক্ত থাকা যায়। তবে কোনো চিকিৎসা না করালে ডেঙ্গু কিন্তু প্রাণঘাতী হতে পারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ডেঙ্গু জটিলতার দিকে রূপ নিতে পারে। ডেঙ্গু থেকে মারাত্মক সমস্যা হলো প্লাজমা লিকেজ, ডিআইসি, মায়োকার্ডিটিস, রক্তপাত, তরল জমে যাওয়া, শ্বাসকষ্ট, কোনো অঙ্গের কার্যকারিতা নষ্ট ইত্যাদি।
প্রশ্ন : ডেঙ্গু হেমোরেজিক বোঝার উপায় কী?
ডা. খান আবুল কালাম আজাদ : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞা অনুযায়ী, জ্বরের সঙ্গে প্লাটিলেট কাউন্ট এক লাখের কম এবং রক্তে হেমাটোক্রিট (রক্তের পরিমাণের সঙ্গে লোহিত কণিকার পরিমাণের অনুপাত) ২০ শতাংশ কমবেশি হলে সেটা ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার। এর সঙ্গে রক্তবমি, রক্তনালি লিকের (প্লাজমা লিকেজ) উপসর্গ যেমন প্রোটিন কমা, পেটে বা ফুসফুসে পানি জমার মতো উপসর্গ থাকতে পারে।
প্রশ্ন : দ্বিতীয়বারের মতো ডেঙ্গু হওয়া ঝুঁকিপূর্ণ কেন বা কোন সেরোটাইপটি বেশি বিপজ্জনক?
ডা. খান আবুল কালাম আজাদ : ডেঙ্গুর উদ্বেগজনক বিষয়টি হলো, একবার সংক্রমিত হয়ে যাওয়া মানুষকে আবারও মারাত্মক সংক্রমণের ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি আলাদা সেরোটাইপ থাকে। কেউ একবার একটি সেরোটাইপে আক্রান্ত হলে তার আরো তিনবার ডেঙ্গু হতে পারে এবং পরবর্তী পর্যায়গুলো বেশ বিপজ্জনক হতে পারে। অর্থাৎ একবার কারো ডেন১ হওয়া মানে তার শরীরে কতগুলো অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে যাচ্ছে। এখন ডেন২ হওয়া মানে নতুন করে নতুন অ্যান্টিবডি তৈরি হচ্ছে, যা আগের অ্যান্টিবডির সঙ্গে মারাত্মকভাবে রি-অ্যাকশন করতে পারে। এ কারণে তীব্র ডেঙ্গু বা ডেঙ্গু শক সিনড্রোম হতে পারে। তাই বলা হয়, দ্বিতীয়বারের মতো ডেঙ্গু হওয়া ঝুঁকিপূর্ণ।
প্রশ্ন : এই জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তিদের কি আলাদা থাকা দরকার?
ডা. খান আবুল কালাম আজাদ : মানুষ থেকে মানুষে বা এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তিতে ডেঙ্গু ছড়ায় না। তবে ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তিদের মশা এড়িয়ে চলা উচিত। এই জ্বরে আক্রান্ত রোগী যতক্ষণ পর্যন্ত অসুস্থ থাকবে, তার রক্তের মধ্যে ওই ভাইরাস থাকতে পারে। সে সময় একটি জীবাণুবাহী এডিস মশা কামড় দিয়ে রক্ত শুষে অন্য একজন সুস্থ মানুষকে কামড়ালে তার অবশ্যই ডেঙ্গু হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। এ জন্য কোনো ব্যক্তি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে কমপক্ষে ৯ দিন পর্যন্ত তাকে মশারি টানিয়ে সম্পূর্ণ আলাদা করে রাখা উচিত, যত দিন পর্যন্ত তার রক্তে ভাইরাসের অস্তিত্ব না থাকে।
প্রশ্ন : ডেঙ্গু ভাইরাস কি চিরকাল মানবদেহের সিস্টেমে থাকে?
ডা. খান আবুল কালাম আজাদ : না। ডেঙ্গু ভাইরাস মানবদেহে স্থায়ীভাবে থাকে না। শরীরের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার মাধ্যমে একসময় ওই ভাইরাস শরীর থেকে পুরোপুরি বের হয়ে যায়। ডেঙ্গু ভাইরাস চিরকাল মানবদেহের সিস্টেমে থাকে না, কিন্তু ভাইরাসের জন্য যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয় সেই অ্যান্টিবডিটা চিরকাল সুপ্ত অবস্থায় থেকে যায়।
প্রশ্ন : এ ধরনের একটা কথা এখন বেশ প্রচলিত যে পেঁপে পাতার রস খেলে নাকি প্লাটিলেট বাড়ে?
ডা. খান আবুল কালাম আজাদ : পেঁপের পাতা বা পেঁপের ভেতর প্যাপেইন থাকে। এটার কোনো রোল আছে কি না তা জানা যায়নি। এ তথ্যের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তিও নেই। আমরা সব সায়েন্টিফিক পেপার ঘেঁটে দেখেছি, কিন্তু ডেঙ্গু প্রতিরোধে বা প্লাটিলেট বাড়াতে পেঁপে পাতার রসের কোনো উপকারিতার অস্তিত্ব আমরা খুঁজে পাইনি। স্থানীয়ভাবে অনেক কিছুতে যেমন লতা, গুল্ম, পাতায় ভেষজ দ্রব্য থেকে মানুষ উপকার পাওয়ার চেষ্টা করে। এটাও এমন ধরনের কোনো একটা বিষয় হতে পারে। তবে যেহেতু কথাটা উঠেছে, তাই আমাদের ফার্মাসিস্টদের উচিত সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা যে আসলেই এর কোনো উপকারী দিক রয়েছে কি না।
প্রশ্ন : এডিস মশা একবার কামড় দিলেই কি ডেঙ্গু হতে পারে?
ডা. খান আবুল কালাম আজাদ : হ্যাঁ, এডিস ইজিপ্টি প্রজাতির মশা কারো শরীরে একবার কামড় দিলেই কারো ডেঙ্গু হতে পারে যদি সেই ব্যক্তির ওই টাইপের ডেঙ্গু আগে না হয়ে থাকে। অর্থাৎ কারো ডেঙ্গু সেরোটাইপ১ হয়তো একবার হয়েছিল আগে, তখন মশা কামড় দিলে তার সেরোটাইপ২ হবে। অর্থাৎ এক সেরোটাইপ একবার হলে বাকি জীবনে আর ওই সেরোটাইপের ডেঙ্গু হবে না।
প্রশ্ন : সাধারণ মশা কি ডেঙ্গু ছড়াতে পারে?
ডা. খান আবুল কালাম আজাদ : না। শুধু এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গু হয়। সাধারণ অ্যানোফিলিস ও কিউলেক্স মশার কামড়ে ডেঙ্গু হয় না। তাদের সে ক্ষমতাও নেই। একেকটা ভাইরাসের অবস্থান একেক জায়গায়। ডেঙ্গুর ভাইরাসটি শুধু এডিস মশার অভ্যন্তরে যে প্রক্রিয়া বা সিস্টেম রয়েছে সেখানেই বাঁচতে পারে। তবে ডেঙ্গু সংক্রামক নয়, এটি এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তিতে ছড়ায় না।
প্রশ্ন : ডেঙ্গু নিরাময়ের দ্রুততম উপায় কী?
ডা. খান আবুল কালাম আজাদ : দ্রুততম বলতে ডেঙ্গু এমনিতেই সেরে যায়, যাকে বলে প্রাকৃতিক নিরাময়। অন্যান্য ভাইরাস জ্বরের মতোই এই জ্বরের নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। এই জ্বরের কোনো ভ্যাকসিন বা টিকাও নেই।
জ্বর হওয়ার পর রোগী যদি ঠিকমতো পানি পান করে, যদি প্যারাসিটামলজাতীয় ওষুধ ছাড়া আর কোনো ওষুধ সেবন না করে, যদি তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো থাকে, যদি অন্যান্য কোনো রোগ না থাকে তাহলে রোগী তিন থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে আল্লাহর রহমতে পরিপূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবে।
তবে সাবধান থাকতে হবে, জ্বরের সময় অন্য কোনো ট্রিটমেন্ট দেওয়া যাবে না। কোনো ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক, স্টেরয়েড বা ব্যথানাশক ওষুধও ব্যবহার করা যাবে না। বমি করলে আইভি ফ্লুইড দিতে হবে।
আর যদি কারো কো-ইনফেকশন থাকে অর্থাৎ কারো ডেঙ্গু হয়েছে এবং একই সঙ্গে টাইফয়েডও হয়েছে, তখন টাইফয়েডের চিকিৎসা করা যাবে। গুরুত্ব দিতে হবে প্রচুর তরল যেন দেহে ঢোকে সে বিষয়টির দিকে। এ জন্য প্রচুর পরিমাণ পানি, ডাবের পানি, শরবত, গ্লুকোজ, স্যালাইন, স্যুপজাতীয় তরল ইত্যাদি খাওয়ানো যেতে পারে। এ সময় রোগীকে পূর্ণ বিশ্রামেও রাখতে হবে।