যে গুণ মুমিনের ব্যক্তিত্ব নির্মাণ করে
জাওয়াদ তাহের
সব মানুষের আকাঙ্ক্ষা দুনিয়াতে সে আত্মমর্যাদা ও সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকবে। কারো কাছে যেন মাথা ঝোঁকাতে না হয়, লাঞ্ছিত না হতে হয়। এই আত্মমর্যাদার জন্য প্রয়োজন অমুখাপেক্ষিতা। এর দ্বারা মানুষের ব্যক্তিত্ব নির্মিত হয়। মুমিনের সম্মান ইজ্জত কোন জিনিস আছে, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলে দিয়েছেন। এক হাদিসে এসেছে, ‘মুমিনের সম্মান তাহাজ্জুদ পড়ার মধ্যে এবং তার মর্যাদা মানুষ থেকে অমুখাপেক্ষী থাকার মধ্যে।’ (তাবারানি, হাদিস : ৪২৭৮)
এ হাদিস থেকে বোঝা যায়, সম্মানের বড় একটি মাধ্যম হচ্ছে পরনির্ভর না হওয়া। যত দিন মানুষ পরনির্ভরশীল থাকবে তত দিন সে সম্মানিত থাকতে পারবে না। তার সম্মান ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে থাকবে। এ জন্য অপর থেকে উপকার চেয়ে নেওয়া থেকে বিরত থাকাই কাম্য।
প্রিয় নবী (সা.) সাহাবাদের সেভাবেই দীক্ষা দিয়েছেন। সবাই যেন অন্তর থেকে পরনির্ভরশীলতা বর্জন করে। এ ব্যাপারে তিনি বায়াত গ্রহণ করতেন। আউফ ইবনে মালিক আল আশজাই (রা.) থেকে বর্ণিত, আমাদের সাত বা আট বা নয়জন লোকের উপস্থিতিতে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা কেন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে বায়আত করছ না?’ অথচ আমরা এর আগে বায়আত গ্রহণের সময় তাঁর হাতে বায়আত গ্রহণ করেছি। আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসুল, আমরা তো আপনার কাছে বায়আত গ্রহণ করেছি। তিনি আবার বললেন, ‘তোমরা কেন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে বায়আত হচ্ছো না? বর্ণনাকারী বলেন, অতঃপর আমরা হাত বাড়িয়ে বললাম, হে আল্লাহর রাসুল, আমরা তো এর আগেই আপনার কাছে বায়আত গ্রহণ করেছি, এখন আবার আপনার কাছে কিসের বায়আত করব? তিনি বললেন, ‘তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, তার সঙ্গে কাউকে অংশীদার স্থাপন করবে না, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করবে। এবং আল্লাহর আনুগত্য করবে। তিনি আর একটি কথা বললেন চুপে চুপে, তা হলো লোকের কাছে কিছুর জন্য হাত পাতবে না। বর্ণনাকারী বলেন, এরপর আমি দেখেছি, সে বায়আত গ্রহণকারী দলের কারো কারো উটের পিঠে থাকা অবস্থায় হাত থেকে চাবুক পড়ে গেছে কিন্তু সে কাউকে তা তুলে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেনি; বরং নিজেই নিচে নেমে তুলে নিয়েছে। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২২৯৩)
তাই নিজের কাজ নিজেই করা শ্রেয়। যতক্ষণ সামর্থ্য থাকে অন্য কারো সাহায্য নেওয়া থেকে বিরত থাকা। আমাদের অনেকের ধারণা পয়সা-কড়ি চাওয়া থেকে বিরত থাকাকে অমুখাপেক্ষী বলে। অথচ বিষয়টা এমন নয়। নিজের প্রয়োজনীয় যাবতীয় জিনিস—চাই পয়সা কিংবা কোনো সেবা সুপারিশ কারো সুপারিশ গ্রহণ ইত্যাদি সবগুলো থেকেই নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার মাঝেই সম্মান। আমাদের প্রিয় নবী (সা.) ঘরের মধ্যে নিজের কাজ নিজেই করতেন। অথচ রাসুলের একাধিক স্ত্রী ছিলেন। তিনি ইচ্ছা করলেই তাঁদেরও বলতে পারতেন। তাঁরা আনন্দের সঙ্গে করে দিতেন। কিন্তু রাসুল (সা.) সেটা না করে নিজের কাজ নিজেই করেছেন। আর আমাদের জন্য শিক্ষা রেখে গেছেন। আসওয়াদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আয়েশা (রা.)-কে জিজ্ঞেস করলাম, নবী (সা.) ঘরে থাকা অবস্থায় কী করতেন? তিনি বললেন, ঘরের কাজ-কর্মে ব্যস্ত থাকতেন। অর্থাৎ পরিবারবর্গের সহায়তা করতেন। আর নামাজের সময় হলে নামাজের জন্য চলে যেতেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৭৬)
এ জন্য ছোটবেলা থেকেই নিজেকে এই গুণে অধিষ্ঠিত করতে থাকা। কারণ এই গুণ তার ব্যক্তিত্ব নির্মাণে অনেক ভূমিকা রাখবে। অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, সাহল বিন সাদ (রা.) থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি নবী (সা.)-এর কাছে উপস্থিত হয়ে বলল, হে আল্লাহর রাসুল, আমাকে এমন একটি কাজের কথা বলে দিন, যা আমি করলে আল্লাহ আমাকে ভালোবাসবেন এবং লোকেরাও আমাকে ভালোবাসবেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তুমি দুনিয়ার প্রতি অনাসক্তি অবলম্বন করো। তাহলে আল্লাহ তোমাকে ভালোবাসবেন। মানুষের কাছে যা আছে, তুমি তার প্রতি অনাসক্ত হয়ে যাও, তাহলে তারাও তোমাকে ভালোবাসবে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৪১০২)