দুবাইয়ে ৫৩২ বাংলাদেশির সম্পত্তি
![](https://dainiksylhet.com/images/icon.jpg)
দৈনিকসিলেটডেস্ক
সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) দুবাইয়ের আবাসন খাতে ৫৩২ জন বাংলাদেশির সম্পত্তি রয়েছে। দুবাই শহরে প্রস্তুত বা অপ্রস্তুত আবাসন সম্পত্তি কিনেছেন এমন বাংলাদেশির সংখ্যা ২০২২ সালে ছিল ৫৩২। ওই বছর তাঁরা মোট ৩৭ কোটি ৭৪ লাখ ডলারের সম্পত্তি কিনেছেন। ফাঁস হওয়া তথ্য ও নিজস্ব অনুসন্ধানভিত্তিক ধারণার ভিত্তিতে সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে এমন দাবি করেছে ফ্রান্সভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইইউ ট্যাক্স অবজারভেটরি (ইউট্যাক্স)।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ বিদেশে পাচার করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এখনই পদক্ষেপ না নিলে এই পাচারের পরিমাণ আরো বাড়বে।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক কমিশনার (তদন্ত) মো. জহুরুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিষয়টি নতুন। তথ্যগুলো সম্পর্কে আরো বিস্তারিত খোঁজখবর নিতে হবে।
এরপর দুদকের উদ্যোগ বা করণীয় সম্পর্কে বলা যাবে।’
ইইউ ট্যাক্স অবজারভেটরির (ইউট্যাক্স) প্রতিবেদনে ফাঁস হওয়া সম্পত্তির তথ্যের সঙ্গে নিজেদের আনুমানিক হিসাবও দিয়েছে ইইউ ট্যাক্স অবজারভেটরি। এ জন্য ফাঁস হওয়া তথ্যের সঙ্গে ফাঁস না হওয়া তথ্যও আমলে নিয়েছে গবেষণা সংস্থাটি। তবে এসব সম্পত্তির মালিক কারা, তা প্রতিবেদনে জানানো হয়নি।
ইউট্যাক্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, দুবাই শহরে প্রস্তুত বা অপ্রস্তুত আবাসন সম্পত্তি কিনেছেন এবং তথ্য ফাঁস হয়েছে এমন বাংলাদেশির সংখ্যা ২০২২ সালে ছিল ৩৯৪। ওই বছর তাঁরা ৬৪১টি সম্পত্তি কেনেন, যার দাম ২২ কোটি ৫৩ লাখ ডলার। আর ২০২০ সালে শহরটিতে প্রস্তুত ও অপ্রস্তুত আবাসন সম্পত্তি কেনা ৪০৫ জন বাংলাদেশির তথ্য ফাঁস হয়েছে। ওই বছর তাঁদের কেনা ৬৫৭টি সম্পত্তির মূল্য ছিল ২১ কোটি ১২ লাখ ডলার। অর্থাৎ ২০২০ সালের তুলনায় ২০২২ সালে কমসংখ্যক সম্পত্তি কিনলেও বাংলাদেশিদের সম্পত্তির মূল্য ছিল বেশি।
তবে ইউট্যাক্সের আনুমানিক হিসাবে ফাঁস হওয়া ঘটনার সঙ্গে ফাঁস না হওয়া সম্ভাব্য ঘটনাও আমলে নেওয়া হয়েছে। সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী, ২০২২ সালে ৫৩২ জন বাংলাদেশি দুবাইয়ে আবাসন সম্পত্তি কিনেছেন, যার দাম ছিল ৩৭ কোটি ৭৪ লাখ ডলার। অন্যদিকে ২০২০ সালে সম্পত্তি কিনেছেন ৫৬২ জন বাংলাদেশি, যার দাম ছিল ৩৭ কোটি ৫৩ লাখ ডলার।
প্যারিস স্কুল অব ইকোনমিকসের সঙ্গে যুক্ত ইউট্যাক্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে বসবাস ও ব্যবসা করতে চাওয়া বিদেশিদের জন্য একটি খোলা দরজা নীতি অনুসরণ করছে দেশটি। তুলনামূলক কম কর, মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল, তুলনামূলক কম কঠোর বিধি-নিষেধ, সম্পত্তির উদার বাজার ও কম খরচে আবাসন খাতে বিনিয়োগের সুযোগ থাকায় বিদেশিদের চাহিদার তালিকায় শীর্ষে রয়েছে এই আকাশচুম্বী অট্টালিকার আমিরাত। ফলে দুবাই এখন বিদেশিদের শহরে পরিণত হয়েছে। শহরটির ৩০ লাখের বেশি বাসিন্দার মাত্র ৮ শতাংশ আমিরাতের নাগরিক।
দুবাইয়ে বিদেশি নাগরিকদের মালিকানাধীন সম্পত্তির তথ্য পর্যালোচনা করে ইউট্যাক্স বলছে, ২০২০ সালে সেখানে আবাসন খাতে বিদেশিদের মালিকানাধীন সম্পত্তি ছিল ৯ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের। ২০২২ সালে তা বেড়ে ১২ হাজার ১০০ কোটি ডলারে উঠেছে। বর্তমানে দুবাই শহরের আবাসন খাতের ৪৩ শতাংশের মালিক বিদেশিরা, যা বিশ্বের যেকোনো শহরের চেয়ে বেশি।
ফাঁস হওয়া তথ্য ও ট্যাক্স অবজারভেটরির আনুমানিক হিসাব অনুযায়ী, সামগ্রিকভাবে দুবাইয়ে আবাসন সম্পত্তি কেনার তালিকায় সবার ওপরে রয়েছে ভারত। ২০২২ সালে দুবাইয়ে ৪০ হাজার ৭৯২ জন ভারতীয় দুই হাজার ৯০৫ কোটি ডলারের সম্পত্তি কিনেছেন। আর ২০২০ সালে ৩৮ হাজার ৪৬৭ জন ভারতীয় কিনেছেন দুই হাজার ৩৬৬ কোটি ডলারের সম্পত্তি।
তালিকায় পাকিস্তানিরাও বেশ ওপরে আছে। ২০২২ সালে দেশটির ২২ হাজার ২৪৫ জন নাগরিক দুবাইয়ে এক হাজার ৬৮ কোটি ডলারের সম্পত্তি কিনেছেন। ২০২০ সালে ২৩ হাজার ৯০২ জন পাকিস্তানি এক হাজার ৬৬ কোটি ডলারের সম্পত্তি কিনেছেন।
প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব, ইরান, জর্দান, সিরিয়া, মিসর, চীন, কানাডা—এমনকি ইয়েমেন ও সুদানের মতো অনুন্নত দেশ ও ফিলিস্তিনের কিছু ব্যক্তির সম্পত্তি কেনার কথাও রয়েছে।
অর্থনীতিবিদ এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে নজরদারি করা বেসরকারি সংগঠন ও নাগরিক সমাজের মতে, দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে বৈদেশিক রিজার্ভ চুরি, টাকা পাচার, হুন্ডি ইত্যাদি। এসব বন্ধ করতে হবে। অন্যদিকে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার প্রতিনিধিরা বলছেন, পানামা পেপারস কেলেঙ্কারির রিপোর্ট প্রকাশের পর তাঁরা অনুসন্ধান করে কোনো সত্যতা পাননি। তাই এখন একটু ‘যাচাই-বাছাই করে’ কাজ করবেন। এত টাকা পাচারের কথা বলা হলেও বিনিয়োগের অনুমতি দেওয়া হয়েছে মাত্র ৬৯.৫ মিলিয়ন ডলার।
‘পাচারের খবরে দুদকের নজর রয়েছে’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুর্নীতি দমন কমিশনের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, দুদক তার শিডিউলভুক্ত অপরাধের অনুসন্ধান ও তদন্ত করবে। বিদেশে অর্থপাচারের যেসব তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে, কমিশনের সেদিকে নজর রয়েছে। কমিশন অনুমোদন দিলে শিগগিরই এ বিষয়ে অনুসন্ধানের জন্য টিম গঠন করা হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিদেশে অর্থপাচারের অনুসন্ধান কাজ বেশ জটিল ও সময়সাপেক্ষ। তবে সব সংস্থার সমন্বয় থাকলে তা দ্রুত সম্পন্ন করা সম্ভব। দুদক বিদেশ থেকে পাচারের টাকা ফেরত আনার নজির এর আগেই স্থাপন করেছে।
‘তছরুপের সুযোগ থাকলে পাচার হবেই’
এ প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, বাংলাদেশ থেকে অনেকেই টাকা নিয়ে চলে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে দুটি বিষয় রয়েছে—একটি গ্রুপ দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ পাচার করে দিচ্ছে। আরেকটি গ্রুপ বিদেশে যাওয়ার পরে ফিরে আসছে না। দুর্নীতি বন্ধ না হলে দেশে থাকার মতো পরিবেশ তৈরি হবে না। এ কারণে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বিদেশে পাড়ি জমাবে। দেশের প্রতি আগ্রহ তৈরি করতে হলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এভাবে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ তছরুপ করার সুযোগ থাকলে দুবাইসহ অনেক দেশেই অর্থ চলে যাবে।
সবাই মিলে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে : সাবেক গভর্নর
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘টাকা পাচার, হুন্ডি ইত্যাদি বন্ধ না করে বারবার ডলারের রেট কমিয়ে-বাড়িয়ে বাজার স্থিতিশীল করা যাবে না। এখানে ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট আছে, অ্যান্টি করাপশন ইউনিট আছে, কাস্টমস আছে। সবাই মিলে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। এসব কাজে দেরি করলে চলে না।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক জানান, বাংলাদেশ ব্যাংক এ পর্যন্ত ২০টি প্রতিষ্ঠানের ২৪টি ভেঞ্চারে মোট ৬৯.৫ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের অনুমতি দিয়েছে। এর মধ্যে ৪৫.৪৫ মিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স হিসেবে গেছে। এ ছাড়া কোনো ব্যক্তিকে বিদেশে বিনিয়োগের অনুমতি দেওয়া হয়নি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেলের (সিআইসি) একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা পত্রিকায় বিষয়টা দেখেছি। এটা নিয়ে এখনো কোনো সভা হয়নি। এর আগে যখন পানামা পেপারস কেলেঙ্কারির রিপোর্ট হলো, আমরা কাজ করেছি। তখন কাজ করার পর নির্ভরযোগ্য কিছু পাইনি। এ জন্যই আমরা একটু যাচাই-বাছাই করে কাজ করব। এটা একটা ভালো সোর্স, এখানে কাজ করার যথেষ্ট সুযোগ আছে। কাজ করব, তবে একটু দেখে-বুঝে।’
সূত্র: কালের কণ্ঠ