অফিস-আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার

দৈনিকসিলেট ডেস্ক :
সারা রাত গোলাগুলির পর ৮ ডিসেম্বর ১৯৭১ সূর্যোদয়ের আগে যখন কুমিল্লা শহরের মানুষ বিজয়ধ্বনি দিতে দিতে রাস্তায় নেমে এলো, তখন আমাদের আর বুঝতে বাকি রইল না শহরটি শত্রুমুক্ত হয়েছে। আমি এবং আমার আশ্রয়দাতা ভিক্টোরিয়া কলেজের অর্থনীতির তরুণ প্রভাষক সৈয়দ আকমল মাহমুদ, আমার আত্মীয়, স্থির করলাম আর এক মুহূর্ত দেরি না করে ঠাকুরপাড়ার ওই ছোট টিনশেড থেকে বের হয়ে আমার আরেক আত্মীয় এসডিও (সাউথ) জনাব মইনুদ্দিনের বাসায় চলে যাব। আমার লাকশাম রোডের এডিসির (জেনারেল) দোতলা বাসা ছেড়ে আগের দিন সন্ধ্যাবেলা স্ত্রী-পুত্র-কন্যা নিয়ে মইনুদ্দিন সাহেবের বাসায়ই চলে গিয়েছিলাম কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে মেজর আওয়ালের টেলিফোন পেয়ে : ‘আমাদের এখানে বোমা পড়ে পানি সরবরাহের লাইন নষ্ট হয়ে গেছে। এক্ষুনি তোমাদের লোকজন পাঠাও, তা না হলে আমার লোকেরা যাবে তোমাকে নিয়ে আসতে।
যা হোক, বিজয়োল্লাসের মধ্যে সকাল ১০টার দিকে অফিসে অর্থাৎ কালেক্টরেটে গেলাম। অফিসে তখন কর্মকর্তা-কর্মচারী অনেকেই এসে গেছেন। তার আগে বিমানবন্দরে গিয়ে ক্যাপ্টেন আইনুদ্দিন ও তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে দেখা করলাম। শহরে তখন পুরোপুরি বিশৃঙ্খল অবস্থা।
মিছিলটিছিল বের হয়েছে, চারদিকে স্লোগান, হৈচৈ। এবং দুঃখজনক হলেও সত্যি, এরই মধ্যে অনেকেই দোকানপাটে লুটপাট চালাচ্ছে। আমাদের ডিসি এবং এসপি সাহেব দুজনই পালিয়ে গিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে ছিলেন। আমি তখন পুলিশ নিয়ে আমার জিপে চড়ে মাইকে জনগণকে অভিনন্দন জানানোর পাশাপাশি শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে এবং লুটপাট বন্ধ করতে অনুরোধ করতে লাগলাম।
সেই সঙ্গে ক্যাপ্টেন আইনুদ্দিনের নির্দেশমতো সবার অস্ত্রশস্ত্র থানায় জমা দিতে বললাম।
অফিসে ঢুকতে গিয়ে দরজার মাথায় আমার নেমপ্লেটের দিকে চোখ পড়ল। ইংরেজিতে আমার নাম ও পদবি লেখা। সঙ্গে সঙ্গে আমার পিএ জলিল সাহেবকে বললাম, নাজির মাজেদ মিয়াকে বলুন এই নেমপ্লেট বদলিয়ে বাংলা নেমপ্লেট লাগাতে। দুপুরের মধ্যে কাজটা হয়ে গেল।
আমি এডিসির (জেনারেল) পরিবর্তে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) পদবি লিখিয়ে নিলাম। ওই দিন অর্থাৎ ৮ ডিসেম্বর ১৯৭১ থেকে এই ‘সার্বিক’ কথাটা চালু হয়ে গেল। কুমিল্লার আগে আর কোনো জেলা বোধ হয় স্বাধীন হয়নি। কাজেই সার্বিক কথাটা আমারই আবিষ্কার এটা বোধ হয় দাবি করতে পারি। তবে পাছে কেউ ভুল বোঝেন সে জন্য সবিনয়ে বলতে চাই—এটা কোনো বাহাদুরি জাহির করার জন্য এখানে উল্লেখ করিনি। নিতান্তই ঘটনা পরম্পরায় সার্বিক শব্দটির উল্লেখ।
যা হোক, এই ঘটনার ঠিক চার মাস পর ৮ এপ্রিল ১৯৭২ আমি পদোন্নতি পেয়ে ঢাকায় চলে এলাম। নৌপরিবহন ও বিমান মন্ত্রণালয়ের উপসচিব হয়ে। নবগঠিত সংস্থা এয়ার বাংলা ইন্টারন্যাশনাল (বাংলাদেশ বিমানের প্রথম নামকরণ এভাবেই হয়), ১৯৭২ সালের ৪ জানুয়ারি একটি প্রেসিডেনশিয়াল অর্ডারের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে। তখন মন্ত্রণালয়গুলোতে অফিসারের সংখ্যা ছিল খুবই কম। ফলে একেকজন অফিসারকে একাধিক বিভাগ ও সংস্থার দায়িত্ব পালন করতে হতো। আমাকে দেওয়া হলো বাংলাদেশ বিমান, বেসামরিক বিমান চলাচল, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সব ধরনের পরিকল্পনা, উন্নয়ন, প্রশাসন ও সমন্বয়ের দায়িত্ব। আমাদের মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ছিলেন জেনারেল এম এ জি ওসমানী। তাঁর মতো দেশপ্রেমিক, সৎ ও ন্যায়পরায়ণ মানুষ আমার চাকরিজীবনে কমই দেখেছি। তাঁর একমাত্র দুর্বলতা ছিল তিনি ইংরেজি ভাষা বলা ও লেখায় যতটুকু পারদর্শী ছিলেন বাংলা ভাষার ব্যবহারে ছিলেন ততটুকু অদক্ষ। এর কারণ তিনি লেখাপড়া করেছিলেন ইংরেজি মাধ্যমে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং চাকরি করেছেন ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আর্মিতে। ফলে স্বাধীনতার পর যখন সরকারি নথিপত্রে বাংলা ভাষা ব্যবহারের ফরমান জারি হলো তখন মন্ত্রী মহোদয়ের জন্য যথেষ্ট অসুবিধাই হলো। তবু বাংলায় নথিপত্র লিখতে তিনি চেষ্টার ত্রুটি করতেন না।
কিন্তু সরকারি কর্মকর্তাদের অনেকের মধ্যেই তখন বাংলায় চিঠিপত্র, ফাইলের নোট ইত্যাদি লিখতে এক ধরনের জড়তা, কারো কারো রীতিমতো অনীহা লক্ষ করেছি। এরা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি মাধ্যমে লেখাপড়া করার কারণেই যে এমনটি করতেন তা নয়, আসলে তাঁদের মানসিকতাই ছিল এমন যেন ইংরেজি ভাষা ব্যবহার না করলে তাঁরা যে উচ্চশিক্ষিত তা লোকে জানবে না (আহা, কী লজ্জা!)।
ওই সময় নথিপত্রে বাংলা ভাষার ওপর ‘নির্যাতন’ হতো তা উল্লেখ করতেই হবে, বিশেষ করে বাংলা বানানের বেলায়। হ্রস্ব ইকার দীর্ঘ ইকার, শ স ষ, ন ণ ইত্যাদি সবার মধ্যে কোনো ভেদাভেদ না রেখে সবাইকে এক সমতলে নিয়ে এসে কাউকে কাউকে বলতে শোনা গেল : ‘আজকাল একটা হলেই চলে, হ্রস্ব ইকার দীর্ঘ ইকার সব সমান।’ আমার আবার এ ধরনের গায়ের জোরে চাপিয়ে দেওয়া বক্তব্যে চিরকালই বিবমিষা হয়। আমি স্কুলের পণ্ডিত মশাইয়ের মতো নথিতে এগুলো শুদ্ধ করে অধস্তন কর্মকর্তা-কর্মচারীটিকে ডেকে সবক দিতাম। দুঃখের বিষয়, আজ অর্ধশতাব্দী পরেও বাংলা বানানের ব্যাপারে এ ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা অব্যাহত আছে।
অফিস-আদালতের কাজে বাংলা ভাষার ব্যবহার চালু করতে গিয়ে প্রধানত দুটি বাস্তব বাধা লক্ষ করা গেল। এক. পরিভাষা। ইংরেজি যেসব শব্দ যুগ যুগ ধরে ব্যবহৃত হওয়ার ফলে এক প্রকার থিতু হয়ে গিয়েছিল তাদের হটিয়ে দিয়ে পরিভাষার বই ঘেঁটে যথোপযুক্ত বাংলা প্রতিশব্দ বসাতে গিয়ে দেখা গেল এগুলো একেবারে অচেনা। কোনো কোনোটি শ্রুতিকটুও বটে। সরকারিভাবে বাংলা পরিভাষার বই বের হলো ঠিকই কিন্তু তা খুব একটা জনপ্রিয়তা পেল না। অনেকে ঠাট্টা করে বলল, এটা বাংলা ‘পরিভাষা’ নয়, ‘পরীভাষা’ অর্থাৎ পরীদের ভাষা। ফলে কার্যত দেখা গেল বাংলা হরফে ইংরেজি শব্দটিই ব্যবহৃত হচ্ছে।
দ্বিতীয় বড় অসুবিধা ছিল বাংলায় চিঠিপত্র টাইপ করা নিয়ে। যদিও অচিরেই দেশে বাংলা টাইপরাইটারের আবির্ভাব হলো, কিন্তু সেগুলো ব্যবহার করার জন্য পর্যাপ্তসংখ্যক টাইপিস্ট সরকারি কার্যালয়ে ছিল না বললেই চলে। যা হোক, এভাবে সরকারি কাজকর্মে বাংলা ভাষার ব্যবহার চলতে লাগল খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। আর এর পাশাপাশি ব্যক্তিমালিকানার প্রতিষ্ঠানগুলোতে বাংলা ভাষা ব্যবহারের গরজ তেমন একটা লক্ষ করা গেল না। ফলে স্বাধীনতার পর সত্তরের দশকে এ ব্যাপারে খুব একটা অগ্রগতি হয়নি।
স্বাধীনতার আগে দোকানপাট ও সরকারি-বেসরকারি অফিসের সাইনবোর্ড সবই লেখা হতো ইংরেজিতে। সত্তরের দশকে দু-একবার রীতিমতো জিহাদি মনোভাব নিয়ে এগুলো বাংলায় লেখার উদ্যোগ নেওয়া হয়। তারপর? তারপর আর কী—যথা পূর্বং তথা পরং। এখন বাংলায় লেখা সাইনবোর্ড হারিকেন জ্বালিয়ে খুঁজতে হবে!
উদাহরণ আর না বাড়িয়ে এবার উপসংহারে শুধু একটা কথাই বলতে চাই! শুধু মুখে মুখে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ নয়, ভালোবাসা ধারণ করতে হবে অন্তরে। তবেই আচার-আচরণে, চলনে-বলনে বাঙালিয়ানা স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশ পাবে। আরেকটি কথা। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার, তথা জ্ঞান আহরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হচ্ছে উচ্চশিক্ষা। সোজা কথায়, উচ্চ মাধ্যমিক ও বিশেষ করে তার পরবর্তী পর্যায়ে জ্ঞান-বিজ্ঞান আহরণের যে সোপানগুলো আছে সেখানে মাধ্যম হিসেবে বাংলা ভাষার অনুপস্থিতি আবহমানকালের। যে পুথিপুস্তক পাঠ করে একজন শিক্ষক তাঁর ছাত্রছাত্রীকে বিদ্যাদান করেন এবং শিক্ষার্থীরা যেগুলো ধর্মগ্রন্থের মতো পবিত্র ও পাঠনীয় মনে করে মস্তিষ্কের কোটরে প্রবিষ্ট করে পরীক্ষা-বৈতরণি পার হয় সেগুলো কোনোটিই বাংলা ভাষায় লিখিত নয়। ফলে পরবর্তীকালে কর্মজীবনে ওই শিক্ষার্থীর যখন অধীত বিদ্যা প্রয়োগের প্রয়োজন হয় তখন বাংলা নয়, বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজের শিক্ষার মাধ্যমেই কাজে লাগে। কেন আজ অর্ধশতাব্দী পরও উচ্চশিক্ষার মাধ্যম বাংলা হলো না তার জবাব কে দেবে? এত দিন পর এই স্বাধীন দেশেও এ ব্যাপারে কোনো ফলপ্রসূ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে মনে হয় না। তার মানে কি এটা আমাদের বিধিলিপি যে আমরা না চাইলেও বিদেশি ভাষার দাসত্ব করেই যাব, যত দিন না আরেকটা ‘জুলাই অভ্যুত্থান’ এই আধমরা জাতিকে ঘা মেরে বাঁচাবে।