সম্রাট আকবরের রাজস্বনীতি

দৈনিকসিলেট ডেস্ক :
সম্রাট আকবর ভারতে কৃষি ও শিল্পের উন্নয়নে অনবদ্য অবদান রেখে গেছেন। আকবরের রাজস্ব সংস্কার ও অর্থব্যবস্থা ছিল কৃষি উন্নয়নের সহায়ক। জমির উৎপাদিকাশক্তির ওপর রাজস্বের পরিমাণ নির্ধারণ করা ছিল আকবরের রাজস্ব সংস্কারের বিজ্ঞানসম্মত নীতি। আকবরের রাজস্বনীতি তিনটি প্রধান বৈশিষ্ট্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল।
এ তিন বৈশিষ্ট্যগুলো হচ্ছে :
১. জমি জরিপ ও পরিমাণ নির্ধারণ
২. জমির শ্রেণিবিভাগ এবং
৩. রাজস্বের হার নির্ধারণ।
তিনি সমগ্র জমি জরিপ করে জমির উর্বরতা এবং কতকাল যাবৎ জমিতে চাষাবাদ করা হচ্ছে, এসব ভিত্তিতে সমগ্র চাষের জমিকে চার ভাগে বিভক্ত করেন।
যেমন—
১. পোলাজ জমি : যেসব জমিতে প্রতিবছরই চাষাবাদ করা যেত, স্বল্প সময়ের জন্যও তা অকর্ষিত রাখার প্রয়োজন ছিল না।
২. পরাউতি জমি : যেসব জমির উর্বরতা রক্ষার জন্য মাঝেমধ্যে পতিত রাখা হতো।
৩. চাচর জমি : যেসব জমি তিন বা চার বছর পর পর আবাদ হতো।
৪. বনজার জমি : যেসব জমি পাঁচ বছর বা ততোধিককাল অনাবাদি পড়ে থাকত।
জমির প্রকরণভেদে রাজস্বের পরিমাণ নির্ধারণ
পোলাজ ও পরাউতি জমিকে আবার উৎপন্ন ফসলের পরিমাণের ভিত্তিতে উত্তম, মধ্যম ও অধম—এ তিন ভাগে ভাগ করা হয়। এ তিন প্রকারের জমির উৎপন্ন শস্যের গড় নির্ধারণ করে রাজস্ব নির্ধারিত হতো।
টোডরমলে তিন প্রকার জমির মোট উৎপন্ন ফসলের এক-তৃতীয়াংশ রাজস্ব হিসেবে ধার্য করেন। চাচর ও বনজার জমির রাজস্ব উৎপাদনের পরিমাণের ওপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হত। ফসল ওঠার মৌসুমে রাজস্ব বিভাগের কর্মচারীরা গ্রামে গিয়ে জরিপের মাধ্যমে জমির পরিমাণ নির্ণয় ও উৎপাদিত শস্যের পরিমাণ ধার্য করতেন। নগদ অর্থ অথবা উৎপন্ন ফসলে রাজস্ব আদায় করা হতো। তবে আকবর নগদ অর্থই বেশি পছন্দ করতেন।
রাজস্ব আদায়ের পদ্ধতি
প্রশাসন ও রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্য সমগ্র মোগল সাম্রাজ্য কতকগুলো সুরা বা প্রদেশে, প্রদেশ কতকগুলো সরকার বা বিভাগে, পরগনা বা জেলায় বিভক্ত ছিল। প্রতিটি পরগনা আবার কতকগুলো মৌজা বা গ্রামের সমন্বয়ে গঠিত ছিল। রাজস্ব আদায়ের জন্য পরগনা ছিল একক (Unit).
রাজস্ব বিভাগের কর্মচারীবৃন্দ
পরগনার রাজস্ব আদায়কারী কর্মকর্তাকে আমলগুজার বলা হতো। তিনি রাজস্ব আদায়ে তার সহকারীরা ছাড়াও গ্রামে নিযুক্ত বেসরকারি মুকাদ্দাম হিসেবে গণ্য হতো। (গ্রামের প্রধান) ও পাটোয়ারী উপাধিধারী প্রধানদের সাহায্য নিতেন। রাজস্ব আদায়সংক্রান্ত ব্যাপারে অন্য যেসব সাহায্যকারী কর্মচারী নিযুক্ত ছিল তারা হচ্ছেন আমিন বা জরিপকারী, কারকুন বা রাজস্ব ধার্যকারী, কানুনগো-দেয় রাজস্বের হিসাব রক্ষাকারী, পোদ্দার বা জেলা কোষাধ্যক্ষ। প্রদেশে রাজস্ব আদায়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা দেওয়ান আদায়কৃত রাজস্ব হতে শাসনকার্যের প্রয়োজনীয় ব্যয় সংকুলানের জন্য অর্থ সুবাদারকে দিতেন এবং উদ্বৃত্ত অর্থ কেন্দ্রীয় রাজকোষে প্রেরণ করতেন।
গণকল্যাণমূলক রাজস্ব ব্যবস্থা
আকবরের সময়ে রাজস্ব আদায়ে সতর্কতা অবলম্বন করা হয় এবং কোনো রকম অতিরিক্ত পাওনা আদায় করা হতো না। সম্রাট অহরহ রাজস্ব আদায়কারী কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে অতিরিক্ত আদায় হতে বিরত থাকতে এবং নাগরিকদের দুঃখ-কষ্ট লাঘব করতে নির্দেশ জারি করতেন। ছোটখাটো কর্মচারীদের মধ্যে কোথাও অবৈধ লাভের প্রবণতা থাকলেও কর্মকর্তাদের মধ্যে উন্নতমানের ক্ষমতা পরিলক্ষিত হতো। পাশ্চাত্য ও উপমহাদেশীয় ঐতিহাসিকরা আকবরের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। কেননা উক্ত ব্যবস্থা চাষিদের আদায়কারী কর্মকর্তাদের অথবা বারানি থেকে নিরাপদ করে। সম্রাট রায়তদের তথা কৃষকদের স্বার্থ রক্ষায় অত্যন্ত যত্নবান ছিলেন এবং অতিবৃষ্টি ও অনাবৃষ্টির দরুন দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে রায়তদের খাজনা প্রদানের সামর্থ্য না থাকলে তিনি খাজনা মওকুফ করে দিতেন। এরূপ কল্যাণমূলক রাজস্ব ব্যবস্থায় চাষিরা ভূমির উন্নতি বিধানে আগ্রহী হয়ে ওঠে।