লোকমুখে প্রচলিত ‘খনার বচন’

দৈনিকসিলেট ডেস্ক :
‘ষোল চাষে মুলা,
তার অর্ধেক তুলা;
তার অর্ধেক ধান,
বিনা চাষে পান।’
১৬টি চাষ দিয়ে মুলা বপন করলে অধিক ফলন পাওয়া যায়। তুলা চাষ করতে হলে দরকার এর অর্ধেক চাষ অর্থাৎ আটটি। ধান রোপণে এত চাষের প্রয়োজন নেই, মূলার অর্ধেক অর্থাৎ চারটি চাষই যথেষ্ট।
অন্যদিকে পান উৎপাদন করলে কোনো চাষেরই প্রয়োজন পড়বে না। কৃষিনির্ভর সমাজে খনার এই শিক্ষা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জনশ্রুতি অনুযায়ী খনা ছিলেন প্রাচীন বাংলার এক জ্ঞানী নারী, যিনি কৃষি, আবহাওয়া ও দৈনন্দিন জীবনের নানা বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করতেন। খনা ছিলেন রাজা বিক্রমাদিত্যর সভার জ্যোতিষী বরাহমিহিরের পুত্রবধূ।
তবে তাঁর জীবনকাল নিয়ে মতভেদ আছে। অনেকে অনুমান করেন ৮০০ থেকে ১১০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যের সময়কালে তাঁর বসবাস ছিল। তবে বরাহমিহিরের জীবনকাল ৫০৫ থেকে ৫৮৭ খ্রিস্টাব্দ। তাঁরা দুজন যদি পুত্রবধূ-শ্বশুর সম্পর্কের হয়ে থাকেন তাহলে তাঁদের জীবনকালের মাঝে ৩০০ বছরের ব্যবধান হবে না।
তবে তিনি যে সময়েরই হোন না কেন তাঁর জ্ঞানের গভীরতা এতটাই বিস্তৃত ছিল যে, বরাহমিহিরও অনেক সময় তাঁর কথার সঙ্গে দ্বিমত করতে পারতেন না। জনশ্রুতি আছে, খনার ভবিষ্যদ্বাণীগুলো রাজদরবারে অতিরিক্ত প্রভাব ফেলত, যার ফলে তাঁকে অনেক সমস্যায় পড়তে হয়ে। তবে তাঁর বলা কথাগুলো কৃষকদের মুখে মুখে তত দিনে ছড়িয়ে পড়ে এবং এগুলোই খনার বচন নামে পরিচিত হয়।
খনার বচন আসলে বাংলার কৃষকদের বাস্তব অভিজ্ঞতার ফসল। প্রকৃতি, ঋতু পরিবর্তন, চাষাবাদের সময়, বৃষ্টিপাত—সব কিছুর ওপর ভিত্তি করেই এই বচনগুলো তৈরি হয়েছে।
যেমন—
“আষাঢ়ে ধান, কার্তিকে মাছ, পৌষে ঘি তেল”
এর মানে, চাষাবাদ ও খাবারের নির্দিষ্ট সময় রয়েছে। আষাঢ়ে ধান রোপণ করতে হবে, কার্তিকে নদীতে প্রচুর মাছ পাওয়া যায়, আর পৌষে গরু-মহিষের দুধ ঘি তৈরির জন্য উপযুক্ত।
খনার বচন শুধু কৃষিতেই নয়, দৈনন্দিন জীবনেও কাজে আসে। যেমন—“দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো”। অর্থাৎ খারাপ সঙ্গ বা ক্ষতিকর কিছু থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির পরও খনার বচনগুলো এখনো অনেক ক্ষেত্রেই সত্যি। কৃষি ও প্রকৃতির নিয়ম বোঝার জন্য এগুলো কাজে আসে। তবে শুধু এই বচনগুলোর ওপর নির্ভর না করে আধুনিক কৃষিবিদ্যার সঙ্গে এগুলোকে মিলিয়ে ব্যবহার করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ।
খনার বচন আমাদের শিকড়ের কথা মনে করিয়ে দেয়। প্রকৃতির নিয়ম মেনে জীবন চললে সেটাই আমাদের জন্য মঙ্গলজনক।