মা, তোমার ছেলে এখন গুগলে

দৈনিকসিলেট ডেস্ক :
নরসিংদীর নানাবাড়িতে জন্ম হলেও বেড়ে উঠেছি রাজধানীর মিরপুরে। বাবা ব্যাংকার, মা গৃহিণী। শৈশব কেটেছে আনন্দে। মুনলাইট ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে পড়াশোনার হাতেখড়ি।
এরপর প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হই মনিপুর স্কুলে। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছা জাগে। তবে বায়োলজি ভালো না পারায় স্বপ্ন বদলে প্রকৌশলী হওয়ার পণ করলাম। গণিতের মারপ্যাঁচ ভালো বুঝতাম।
জিপিএ ৫ পেয়ে এসএসসি পাস করি। এরপর ভর্তি হলাম নটর ডেম কলেজে। এখানকার পরিবেশ আমার জীবন বদলে দেয়। তখন ব্রিলিয়ান্টডটওআরজি ওয়েবসাইটে টুকটাক গণিত বা পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ক সমস্যার সমাধান করতাম।
পড়াশোনার পাশাপাশি প্রগ্রামিং
এইচএসসির পর ইচ্ছা ছিল বুয়েটে পড়ার। সুযোগ মেলেনি। ভর্তি হলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে। প্রথম সেমিস্টারে সি প্রগ্রামিংয়ের কোর্স দিয়ে প্রগ্রামিংয়ের হাতেখড়ি। তখন থেকেই চেষ্টা ছিল প্রতিযোগিতামূলক প্রগ্রামিংয়ে নাম লেখানোর।
প্রথমবার ন্যাশনাল কনটেস্টে অংশ নেওয়ার সুযোগ মেলে তৃতীয় বর্ষে ওঠার পর। ঢাকা আইসিপিসি রিজিওনালে অংশ নিয়েছিলাম। খুব একটা ভালো করতে পারিনি। চতুর্থ বর্ষে এসে আবার আইসিপিসিতে অংশ নিলাম। রিজিওনাল রাউন্ডে এবার আমাদের দল দশম হয়। চূড়ান্ত পর্বে সেবার ভারতের কেরালায় মোট ২৭০টি দলের মধ্যে ১৮তম হয়েছিলাম আমরা। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরুর দিকে বন্ধুরা মিলে সহশিক্ষাডটকম নামে ওয়েবসাইট তৈরি করি। এখানে নিয়মিত বিজ্ঞান, প্রগ্রামিং এবং দর্শনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লেখালিখি করতাম। সিজিপিএ ৩.৩০ পেয়ে স্নাতক সম্পন্ন করলাম।
এবার চাকরি
স্নাতকের পর স্যামসাংয়ে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যোগদান করি। চাকরির পাশাপাশি ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশে প্রগ্রামিং ইনস্ট্রাক্টর হিসেবে ক্লাস নিতাম। এ ছাড়া ডেভ স্কিলে (Dev skill) প্রতিযোগিতামূলক প্রগ্রামিংয়ের ওপর বেশ কিছু লাইভ কোর্স করিয়েছি। ইঞ্জিনিয়ারিং এবং শিক্ষকতা—দুটিই উপভোগ করতাম। বছর দুয়েকের মাথায় সফটওয়্যার ডেভেলপার হিসেবে যোগদান করি পেন্টা গ্লোবাল লিমিটেডে। পেশাগত জীবনে সবচেয়ে বেশি শেখার এবং কাজের সুযোগ মেলে এখানে।
গুগল-মাইক্রোসফটে চাকরির পণ
সব সময় নিজের বিষয়সংশ্লিষ্ট ফিল্ডে ভালো কিছু করার স্বপ্ন ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ক্লাসে বিভাগের বাইরের দেয়ালে ‘গুগল ইন্টারভিউ’-এর একটি ব্যানার ঝুলছিল। তখন মনে মনে ভেবেছিলাম, আমার পক্ষে এ রকম প্রগ্রামে অংশ নেওয়া সম্ভব? বাবা প্রায়ই পত্রিকায় প্রকাশিত গুগল-মাইক্রোসফটে চাকরির খবরগুলো পড়তেন। মায়ের সঙ্গে এসব নিয়ে আলাপ করতেন। তাঁর ইচ্ছা ছিল, আমি যেন জীবনে বড় কিছু করি। একদিন এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘সাকিব, তোমার এসবে চাকরিবাকরির সুযোগ আছে?’ সেদিন বাবাকে সদুত্তর দিতে পারিনি। তবে সে রাতেই পণ করলাম, সবটুকু উজাড় করে চেষ্টা করব।
যেভাবে গুগলে
গুগল, মাইক্রোসফটের মতো টেক জায়ান্ট কম্পানির জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকলাম। বিভিন্ন ওয়েবসাইটে সমস্যার সমাধান এবং সহকর্মী, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে মক ইন্টারভিউয়ের চর্চা করতাম। ২০২১ সালের শুরুতে লিংকডইনে গুগলের রিক্রুটারের মেসেজ, ‘আর ইউ ইন্টারেস্টেড ইন ইন্টারভিউয়িং’। একবাক্যেই রাজি হয়ে গেলাম। মার্চে প্রথম রাউন্ড ইন্টারভিউ হয়। তখন দুটি সমস্যা সমাধান করতে দেওয়া হয়। নির্ধারিত সময়ের ১০ মিনিট আগেই সমাধান করে ফেললাম। সপ্তাহ তিনেকের ব্যবধানে এ রকম আরো চারটি রাউন্ড অনুষ্ঠিত হয়। কয়েক সপ্তাহ বাদে রিক্রুটার জানান, আমার সব ইন্টারভিউয়ের ফিডব্যাক পজিটিভ, খুব দ্রুতই আমার প্যাকেজটি টিম ম্যাচিংয়ের জন্য পাঠাবে! তিন-চারটি টিম ম্যাচিং রাউন্ড হয়।
হঠাৎ এক দুপুরে মেইলে অফার লেটার এলো। অফিসেই ছিলাম। অফিস থেকে বেরিয়ে আম্মাকে ফোন দিলাম—‘মা, তোমার ছেলে এখন গুগলে।’ বাবা বেঁচে থাকলে কী যে খুশি হতেন! ২০১৭ সালে তিনি চলে গেছেন জীবন নদীর অন্য পারে। কিছুই দেখে যেতে পারলেন না। এখন অন্য দুনিয়া থেকে নিশ্চয়ই খুশি হয়েছেন, তাঁর ছেলে গুগলে কাজ করছে।
বাবার জীবদ্দশায় কখনো রোদের তীব্রতা টের পাইনি! জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়ে ২০১৮ সাল থেকে। তখন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি আমি। কেবল চতুর্থ বর্ষে পড়ি। সারা দিন ক্লাস-ল্যাব, টিউশনি করে বাসায় এসে ক্লান্ত হয়ে পড়তাম। গড়ে তিন ঘণ্টার বেশি ঘুম হতো না কোনোভাবেই। দিনগুলোর কথা মনে হলে এখনো আঁতকে উঠি।
গুগলে কী কাজ
গুগলে তাইওয়ান ব্রাঞ্চে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে প্রায় তিন বছর ধরে কাজ করছি। এখানে কাজের অভিজ্ঞতা বেশ ভালো। প্রথম প্রথম খাপ খাওয়াতে বেগ পেতে হতো, পরে মানিয়ে নিয়েছি। এখন কাজ করছি ChromeOS ODML (On-Device Machine Learning) টিমে। গুগলের টিমটি নতুন। আমাদের কাজ মূলত গুগল ক্রোমবুক ল্যাপটপ নিয়ে। ক্রোমবুক ল্যাপটপগুলোতে চ্যাটজিপিটি, জেমিনির মতো মডেলগুলো ইন্টারনেট ছাড়া কিভাবে চালানো যায়, মূলত তা নিয়েই কাজ। গেল বছর বেশ কিছু চমৎকার ফিচার নিয়ে কাজ করেছি। অচিরেই ক্রোমবুকে ফিচারগুলো রিলিজ পাবে