ইসলামের ইতিহাসে সিরিয়ার ঘটনাপ্রবাহ

মাওলানা মিজানুর রহমান
মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশের নাম সিরিয়া। ইসলামের ইতিহাসেও বিশাল অংশ জুড়ে আছে সিরিয়া। বর্তমান সিরিয়া বৃহত্তর শামভূমির অংশ। ইতিহাসবিদদের মতে, নবী হজরত নুহ (আ.)-এর সময়ে সংঘটিত মহাপ্লাবনের পর তার তিন পুত্র হাম, শাম, ইয়াফেসের মাধ্যমে পৃথিবীতে মানবসভ্যতার পুনর্জাগরণ ঘটে। নুহ (আ.)-এর পুত্র শামের নামে গড়ে ওঠে শামদেশ ও সেমেটিক সভ্যতা। প্রাচীন সেমেটিক সভ্যতার সেই শামদেশ বর্তমানে ভেঙে চারটি দেশÑসিরিয়া, জর্ডান, লেবানন, ফিলিস্তিন-ইসরায়েল এবং আরও চারটি দেশÑইরাক, তুরস্ক, মিশর, সৌদি আরবের অংশবিশেষ জুড়ে বিস্তৃত ও বিভক্ত। ইসলামে এই অখণ্ড শামকে বলা হয়েছে ‘বরকতময় ভূমি’। কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘পবিত্র ও মহিমাময় তিনি, যিনি তার বান্দাকে রাতে ভ্রমণ করিয়েছেন মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত। যার পরিপার্শ্বকে আমি করেছি বরকতময়, তাকে আমার নিদর্শন দেখানোর জন্য; তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা’ (সুরা বনি ইসরাইল: ১)। রাসুল (সা.) এক সাহাবিকে বলেছেন, ‘তুমি শামদেশে গিয়ে বসবাস করবে। কেননা তা আল্লাহর অন্যতম পছন্দনীয় ভূমি। সেখানে তিনি তার সর্বোৎকৃষ্ট বান্দাদের একত্র করবেন।’ (আবু দাউদ, হাদিস: ২৪৭৬)। কেয়ামতের পর যখন হাশরের ময়দানে পৃথিবীর সব মানুষকে সমবেত করা হবে, তখন তার কেন্দ্রস্থল হবে এই শামভূমি। সাহাবি আবু জর গিফারি (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘শাম হলো সমাবেশ ও পুনরুত্থানের ভূমি।’ (মুসনাদে আহমাদ: ২০০৪৩)। পৃথিবীর ইতিহাসের শুরু-শেষ এবং মহাপ্রলয় শেষে পুনরুত্থানের পরও বহু ঘটনার সাক্ষী এই শামভূমি।
সিরিয়া শামের প্রাচীন ও প্রধান অংশ হওয়ায় ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয়ভাবে এর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। অনেক নবী-রাসুল, সাহাবায়ে কেরাম ও বুজুর্গদের ভূখণ্ড হিসেবে প্রসিদ্ধ এই দেশ। শেষ যুগে শামকে ইসলামের পুনর্জাগরণ ও সংঘর্ষের কেন্দ্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাই ওই ফেতনার সময় নবীজি (সা.) শামে অবস্থান করার কথা বলেছেন। হজরত সালিম ইবনে আবদুল্লাহ তার পিতা আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কেয়ামতের আগে হাজরামাওত (কিংবা হাজরামাওতের সমুদ্রের দিক থেকে) থেকে অবশ্যই একটি আগুন বের হবে এবং লোকদের একত্র করবে। সাহাবিরা বলেন, তখন আমাদের কী করার নির্দেশ দেন, হে আল্লাহর রাসুল? তিনি বলেন, তখন তোমরা শাম অঞ্চলকে দৃঢ়ভাবে ধরে রাখো।’ (তিরমিজি: ২২১৭)। হাদিসে আরও বলা হয়েছে, শামে যদি দুর্যোগ হয়, তাহলে এটি পুরো বিশ্ববাসীর জন্য অশনিসংকেত এবং শামে সর্বদা আল্লাহতায়ালার একটি দল সাহায্যপ্রাপ্ত হবে। হজরত মুয়াবিয়া ইবনে কুররা তার পিতা কুররা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘শামবাসীরা যখন খারাপ হয়ে যাবে তখন আর তোমাদের কোনো মঙ্গল নেই। আমার উম্মতের মধ্যে একদল সবসময় বিজয়ী থাকবে, তাদের যারা লাঞ্ছিত করার চেষ্টা করবে তারা কেয়ামত সংঘটিত হওয়া পর্যন্ত তাদের কোনো ক্ষতি সাধন করতে পারবে না।’ (তিরমিজি: ২১৯২)।
সিরিয়া অসংখ্য নবী-রাসুলের বিচরণভূমি। হজরত ইব্রাহিম (আ.) নিজ সম্প্রদায়ের বিরোধিতার মুখে পড়ে আল্লাহর আদেশে সিরিয়া ভূমিতে হিজরত করেছিলেন। এখানে জন্মগ্রহণ করেন হজরত ইসা (আ.)। হজরত মুসা (আ.) হিজরত করে আগমন করেছিলেন এখানে। শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)ও নবুয়ত প্রাপ্তির আগে বাণিজ্যের প্রয়োজনে শাম ও সিরিয়ায় সফর করেছিলেন। পৃথিবীর শেষ সময়ে সিরিয়া হবে পৃথিবীর মানুষের ভাগ্যের কেন্দ্র। কেয়ামতের পরও এই শামভূমিতেই স্থাপিত হবে হাশরের ময়দানের প্রধান কেন্দ্র। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, হিজরতের পর আরেকটি হিজরত শিগগিরই সংঘটিত হবে। তখন ভূপৃষ্ঠের সর্বোৎকৃষ্ট মানুষ হবে তারাই, যারা ইব্রাহিম (আ.)-এর হিজরত ভূমিতে (শামদেশে) অবস্থান করবে। আর গোটা পৃথিবীতে সর্বনিকৃষ্ট মানুষরাই বাকি থাকবে। তাদের ভূমিগুলো তাদের নিক্ষেপ করবে। আল্লাহ তাদের অপছন্দ করবেন। তাদের ফিতনার আগুন বানর ও শূকরের সঙ্গে মিলিয়ে রাখবে। তাদের দুশ্চরিত্রের কারণে তারা যেখানেই যাবে, সেখানেই ফিতনা লেগে থাকবে।’ (আবু দাউদ: ২৪৮২)।
কেয়ামতের আগে সিরিয়ায় ভয়াবহ এক মহাযুদ্ধ সংঘটিত হবে বলে হাদিসে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে। হজরত আবু দারদা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘শেষ জামানায় মহাযুদ্ধের সময় মুসলিমদের সেনাক্যাম্প হবে ‘গোতা’ শহরে, যা দামেস্ক শহরের পাশে অবস্থিত। এটি শামের উৎকৃষ্ট শহরগুলোর একটি।’ (আবু দাউদ, হাদিস: ৪২৯৮)। আরেক হাদিসে নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘অচিরেই তোমরা শাম বিজয় করতে পারবে, যখন তোমাদের সেখানে বসবাসের এখতিয়ার দেওয়া হবে, তোমরা দামেস্ক নগরীকে বাসস্থান বানাবে, কেননা তা যুদ্ধবর্তীকালীন মুসলিমদের আশ্রয়স্থল হবে আর তাদের ছাউনি হবে সে দেশের একটি ভূমি, যাকে ‘গোতা’ বলা হয়। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস: ১৭৪৭০)। সিরিয়াতেই যুদ্ধ চলাকালে আবির্ভাব ঘটবে ইমাম মাহদির। কেয়ামতের আগে তিনি খেলাফত গ্রহণ করবেন এবং মুসলমানদের নেতৃত্ব দেবেন। হজরত উম্মে সালামা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘মুসলমানদের একজন খলিফার ইন্তেকালের পর মতানৈক্য হবে। তখন মদিনাবাসীদের একজন ব্যক্তি (মতানৈক্য এড়িয়ে যাওয়ার জন্য) মক্কায় চলে আসবেন। অতঃপর মক্কাবাসী অনেক লোক তার কাছে আসবে এবং তাকে তার অনিচ্ছা সত্ত্বেও ঘর থেকে বের করে এনে মাকামে ইব্রাহিম ও হাজরে আসওয়াদের মধ্যবর্তী স্থানে তার হাতে বাইয়াত হবে। (তিনিই হলেন ইমাম মাহদি) তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য শামবাসীদের থেকে একটি (বাতিল) দলকে পাঠানো হবে। তবে তারা মক্কা-মদিনার মধ্যবর্তী বাইদা নামক স্থানে পৌঁছলে ভূমিধসে আক্রান্ত হবে। যখন মানুষ তা দেখবে, তখন তার কাছে শামের আবদালরা ও ইরাকবাসী উৎকৃষ্ট মানুষের দল আসবে। অতঃপর তারা মাকামে ইব্রাহিম ও হাজরে আসওয়াদের মধ্যবর্তী স্থানে তার হাতে বাইয়াত হবে। অতঃপর কুরাইশ বংশের জনৈক ব্যক্তির উদ্ভব হবে, কালব গোত্র হবে তার মাতুল গোত্র। সে তাদের মোকাবিলায় একটি বাহিনী পাঠাবে। যুদ্ধে মাহদির অনুসারীরা কালব বাহিনীর ওপর বিজয়ী হবে। এ সময় যারা কালবের গনিমত নিতে উপস্থিত হবে না, তাদের জন্য আফসোস! মাহদি গনিমতের সম্পদ বণ্টন করবেন ও নবী করিম (সা.)-এর সুন্নত অনুযায়ী মানুষের মধ্যে কার্যপরিচালনা করবেন আর ইসলাম সারা পৃথিবীতে প্রসারিত হবে। অতঃপর তিনি সাত বছর অবস্থান করার পর মারা যাবেন। আর মুসলিমরা তার জানাজার সালাত পড়বে।’ (মাজমাউজ জাওয়ায়েদ: ৭/৩১৩-৩১৪; মুসতাদরাকে হাকেম: ৪/৫৫৮)।
এই সিরিয়াতেই দাজ্জালের উত্থান ঘটবে এবং হজরত ইসা (আ.) আসমান থেকে অবতরণ করবেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘দাজ্জাল ইরাক ও শামের মধ্যবর্তী এলাকা থেকে বের হবে এবং ডানে-বাঁয়ে গোটা পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি করতে থাকবে। তাই হে আল্লাহর বান্দারা! তোমরা ইমানের ওপর অটল থাকবে।’ দীর্ঘ হাদিস বর্ণনার একপর্যায়ে নবী করিম (সা.) বলেন, দীর্ঘ ৪০ দিন ধরে দাজ্জালের অনিষ্টতার পর আল্লাহ ইসা ইবনে মারিয়াম (আ.)-কে পৃথিবীতে পাঠাবেন। তিনি দামেস্কের পূর্ববর্তী এলাকার শুভ্র মিনারের কাছে আসমান থেকে দুজন ফেরেশতার কাঁধে চড়ে অবতরণ করবেন। তখন তার শ্বাস-প্রশ্বাস যে কাফেরের গায়ে লাগবে, সে মারা যাবে আর তার দৃষ্টিসীমার শেষ প্রান্তে গিয়ে তার শ্বাস-প্রশ্বাস পড়বে। তিনি দাজ্জালকে তালাশ করবেন, অতঃপর শামের বাবে লুদ নামক স্থানে তাকে হত্যা করবেন।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৯৩৭)।
লেখক: ইমাম ও খতিব