এশিয়ার কালো টাকার প্রধান আস্তানা কেন লন্ডন?

সম্প্রতি দক্ষিণ-পুর্ব এশিয়া ‘আন্দোলনের সূতিকাগারের’ তকমা পেয়েছে। শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ এবং সর্বশেষ নেপালে গণবিক্ষোভের মুখে সরকার পতন হয়েছে। মালয়েশিয়া এবং ফিলিপাইনেও বিক্ষোভ চলছে। অস্থিরতার লক্ষণ দেখা দিয়েছে এশিয়ার অন্যান্য দেশেও। এসব গণআন্দোলনের পেছনে মূল কারণ ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতি। সেক্ষেত্রে, এসব দুর্নীতির অর্থের বেশির ভাগই স্থানান্তর করা হয়েছে যুক্তরাজ্যে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ক্লেপ্টোক্রাটস বা পাচারকারীদের অর্থের আস্তানায় পরিণত হয়েছে লন্ডন। সম্প্রতি চীনের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট পাচারের অর্থে যুক্তরাজ্যে সম্পত্তি গড়ে তোলার ঘটনা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
সোমবার (২২ সেপ্টেম্বর) সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের সেই প্রতিবেদনে বলা হয়, লন্ডন কীভাবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও আশপাশের অঞ্চলের দুর্নীতির অর্থের নিরাপদ ঠিকানা হয়েছে- তা নতুন করে আলোচনার টেবিলে উঠে আসে মালয়েশিয়ার একটি তদন্ত শুরুর পর।
সম্প্রতি, মালয়েশিয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মাহাথির মোহাম্মদের লন্ডনভিত্তিক সম্পত্তির উৎস নিয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে। যদিও মাহাথির দাবি করেছেন, এগুলো কোনো অবৈধ সম্পত্তি নয়।
তবে চলতি বছরের জুন মাসে মালয়েশিয়ার দুর্নীতি দমন কমিশনের (এমএসিসি) অনুরোধে প্রয়াত ধনকুবের ও মাহাথিরের ঘনিষ্ঠ সহযোগী দাইম জায়নুদ্দিনের প্রায় ১৮ কোটি ডলার মূল্যের সম্পত্তি ফ্রিজ করে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ। জব্দ হওয়া সম্পত্তির মধ্যে রয়েছে, লন্ডন সিটি এলাকার দুটি বাণিজ্যিক ভবন, মেরিলেবোন ও বেইজওয়াটার এলাকার বিলাসবহুল বাড়ি ও অ্যাপার্টমেন্ট।
মালয়েশিয়া থেকে যুক্তরাজ্যের রিয়েল এস্টেট খাতে অর্থ পাচারের ঘটনা নতুন কিছু নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অবৈধ অর্থ প্রায়ই বৈধ সম্পদের সঙ্গে মিশে যায়। শেল কোম্পানি ও অফশোর কাঠামোর মাধ্যমে এই অর্থ এমনভাবে সরানো হয় যে, উৎস জানার উপায় থাকে না।
২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্ জানায়, ওয়ানএমডিবি নামে মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ তহবিল থেকে যুক্তরাজ্যে প্রায় ৩৪ কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের সম্পত্তি কেনা হয়েছে। ব্রিটিশ ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জের মাধ্যমে এসব অর্থ যুক্তরাজ্যে আসে। এই দ্বীপপুঞ্জ বিশ্বে ‘ট্যাক্স হেভেন’ নামে পরিচিত। যেখানে করের হার প্রায় শূন্য এবং খুব কঠোরভাবে গ্রাহদের আর্থিক গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়। শুধু মালয়েশিয়াই নয়, যুক্তরাজ্যে অর্থ পাচারের তালিকায় নাম রয়েছে বাংলাদেশেরও।
গত মে মাসে যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি (এনসিএ) প্রায় ৯ কোটি পাউন্ড মূল্যের বিলাসবহুল সম্পত্তি জব্দ করে। সন্দেহ করা হচ্ছে এই সম্পত্তি বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের।
পরে যুক্তরাজ্যের ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল তদন্ত করে প্রায় ৪০ কোটি পাউন্ড মূল্যের সম্পত্তি পায়। জানা যায়, সেগুলোও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে যুক্ত। এর মধ্যে আছে, মে ফেয়ার ম্যানশন, সারে কাউন্টির এস্টেট ও মার্সিসাইডের ফ্ল্যাট।
এক বিবৃতিতে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল জানায়, বছরের পর বছর ধরে অলিগার্ক ও স্বৈরশাসকদের জন্য আমরা লাল গালিচা বিছিয়ে রেখেছি। যাতে তারা তাদের সম্পদ নিয়ে এ দেশে আসতে পারে।
এশিয়াজুড়ে এমন আরও নানান ঘটনার উদাহরণ আছে। গত বছর সিঙ্গাপুরে ২ দশমিক ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মানি লন্ডারিংয়ের ঘটনায় এক চীনা নাগরিককে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এতে অভিযুক্তদের মধ্যে দুজন অফশোর কোম্পানি ব্যবহার করে লন্ডনের অক্সফোর্ড স্ট্রিটে ৫৬ মিলিয়ন ডলারের সম্পত্তি কেনেন।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, ক্যারিবীয় সাগরের পাঁচটি অঞ্চল যেমন—কেম্যান দ্বীপপুঞ্জ ও ব্রিটিশ ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জ এখনও বৈশ্বিক মানি লন্ডারিং চক্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। গত ৩০ বছরে এসব অঞ্চলের মাধ্যমে ৭৯টি দেশ থেকে প্রায় ২৫০ বিলিয়ন পাউন্ড অবৈধ অর্থ পাচার হয়েছে।
আন্তর্জাতিক চাপ সত্ত্বেও বহু দশক ধরে লন্ডন অজানা উৎসের অর্থের নিরাপদ বিনিয়োগস্থল বা ‘লন্ড্রোম্যাট’ (কালোটাকা সাদা করার মেশিন) হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। নিয়মিত এমন অভিযোগ উঠলেও যুক্তরাজ্য বেশ ধীর গতিতে আইনি ব্যবস্থা নিয়েছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের মতে, ক্যারিবীয় অঞ্চলের পাঁচটি ব্রিটিশ ওভারসিজ টেরিটরি (যার মধ্যে কেম্যান আইল্যান্ডস এবং ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডস অন্তর্ভুক্ত) এখনো বৈশ্বিক অর্থ পাচারের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। এই অঞ্চলগুলো দিয়ে গত ৩০ বছরে ৭৯টি দেশ থেকে প্রায় ২৫০ বিলিয়ন পাউন্ডের অবৈধ অর্থ পাচার হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। সূত্র: সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট







