শিলবুনিয়া ঝরনায় আমরা ১১ নারী এবং একটা ঘণ্টা
বান্দরবানের আলীকদম থেকে ঢাকার বাসে ওঠার আগে আমাদের হাতে সময় ছিল ঘণ্টা দুয়েক। আমরা ১৩ জন নারী মেঘচূড়া পাহাড়ে ট্রেকিং করে একটা রাত জুমঘরে থেকে নিচে নেমে জিরোচ্ছিলাম। এর মধ্যে দুজন আবার কক্সবাজার চলে যাবেন, আমাদের সঙ্গে ঢাকায় ফিরবেন না।
তাঁদের বিদায় দিয়ে বাকি দুই ঘণ্টা উসুল করতে আমরা গুগল ম্যাপ খুলে বসলাম। বাহ্, শিলবুনিয়া ঝরনাটা তো বেশ কাছে! যাওয়াই যায়। স্থানীয় লোকেরা জানালেন, হ্যাঁ, অটোরিকশা বেশ খানিকটা এগিয়ে দেবে। এরপর বড়জোর ২০-৩০ মিনিট হাঁটাপথ। তবে একদম সমতল রাস্তা।
হঠাৎ সিদ্ধান্তে শিলবুনিয়া
আমাদের দলে ছিলেন বিভিন্ন বয়সের নারী। ডালিয়া আপু যেমন ষাটোর্ধ্ব, পা মচকে গেছে তাঁর। নাসিমা আপু আল্টাসনোগ্রাফির অধ্যাপক। কিন্তু এখানে এসে তিনিও ‘আপু’। চিকিৎসক সমাজে আমি তাঁর অনেক ছোট। উনি যখন পাস করে বের হয়েছেন, আমার তখন জন্মও হয়নি। বয়স হলেও আপু বেশ ফিট।
খালেদা আপুর ওজন বেশি হলেও মানসিক শক্তি প্রবল। এদিকে মৌসুমী আপুর বয়স কম, ওজনের সমস্যা না থাকলেও উচ্চতা ভীতি আছে। একটু উঁচু–নিচু জায়গায় পা ফেলতে ভয় পান। এমনিতে আয়েশি ট্যুরের নাম করে তাঁদের ট্রেক করিয়ে মেঘচূড়া পাহাড়ে উঠিয়েছি। তারপরও সহজ যাতায়াত শুনে ভাবলাম, যাওয়াই যায়।
দলের বাকিদেরও কোনো দ্বিমত ছিল না, তাই আমরা অটোরিকশায় চেপে এগিয়ে গেলাম। অটোরিকশা যেখানে থামাল, সেখান থেকে হাঁটাপথ। অটোরিকশাচালক সাইফকে অনুরোধ করে নিয়ে গেলাম আমাদের সঙ্গে। পাহাড়ে সন্ধ্যা তাড়াতাড়ি নামে, তাই ভাবলাম, স্থানীয় কেউ সঙ্গে থাকলে ভালো।
ঝিরিপথ দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। প্রায় ১ ঘণ্টা আগেই তুমুল বৃষ্টি হয়েছে, তাই ঝিরিপথেও বেশ পানি। বেড়াতে গিয়ে আমার আবার রাস্তা দিয়ে আরামে হেঁটে যেতে ভালো লাগে না। একটু কাদাপানি মাড়িয়ে যাব, অন্যদের গায়ে পানি ছিটাতে ছিটাতে যাব—এটাই বেশি মজার।
আমরা এগিয়ে যাচ্ছি ঝিরিপথ ধরে। আমাদের দলের মারিয়াসহ কয়েকজন বেশ তরতর করে এগিয়ে গেলেও ডালিয়া আন্টি, খালেদা আপু, নাসিমা আপুরা বেশ পেছনে।
খুব বেশি অপেক্ষা করতে হলো না আমাদের। প্রায় ৩০ মিনিট পর ঝরনার কলকল শব্দ কানে এল। সামনে গিয়েই ঝরনার পানিতে দুই দিনের সব ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে।
ঝরনার কাছে গিয়ে বাদ সাধল ৮ ফুট উঁচু একটা দেয়াল। এটাকে কি কালভার্ট বলব? বুঝতে পারছি না। বড় একটা পাইপ দেখে ধারণা করলাম, হয়তো আশপাশে পানির প্রবাহপথ এটা। এই অংশের পরই ঝরনা, তিন–চারদিক থেকে পানি পড়ছে।
ছোট এই ঝরনায়ও বেশ ভালো পরিমাণে পানি পেলাম। প্রাকৃতিক ঝরনাটির পানি আবার এই দেয়ালের কাছে এসে আরেকটা কৃত্রিম ঝরনার মতো তৈরি করেছে।
এখন আসল ঝরনায় যেতে হলে আগে কয়েকটা বড় পাথরে পা রেখে দেয়ালের কাছে গিয়ে একটা জায়গায় দাঁড়াতে হবে। তারপর ডান পা বাঁকিয়ে পাহাড়ের একটা খাঁজে রেখে দেয়ালের ওপরের একটা লোহা দুই হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরতে হবে।
এরপর শরীরের সব শক্তি দিয়ে নিজেকে টেনে তুলতে হবে। একজন যদি পা পিছলে নিচে পড়ে, পাথরে তো ব্যথা পাবেই, বেকায়দায় পড়লে আরও খারাপ কিছু হতে পারে।
এখন মারিয়া, ফারহানা আপুরা ঢ্যাং ঢ্যাং করে উঠে গেলেও সমস্যা হলো ৩-৪ জনের। হোস্ট হিসেবে আমি আমার গুরুদায়িত্ব পালনে এগিয়ে গেলাম। আগে নিজে উঠলাম। এরপর একেকজনকে মোটিভেশন দিয়ে, গাইড করে টেনে তুললাম।
এরপর তো শান্তি আর শান্তি। ঝরনার পানির নিচে মাথাটা রেখে শুয়ে থাকার যে আনন্দ, এর কাছে জগৎ-বিভুঁইয়ের সবই যেন বৃথা। কিছুক্ষণ আনন্দে চিৎকার করলাম। কিছুক্ষণ ঝরনার পানির তলে বসে রইলাম। দেখলাম হালকা অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে, যে করে হোক পুরো দল নিয়ে ভালোয় ভালোয় ফিরতে হবে। আর এখান থেকে নামাটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
নামার পালা
তাড়া দিলাম সবাইকে। আগে নামল মারিয়া আর তুলি। তুলি সবার ব্যাগ নিজের কাঁধে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। ডালিয়া আন্টি বললেন, ‘সাকিয়া, তুমি আগে নেমে আমাদের ধরো।’ মারিয়াকে বললাম, ‘আমাকে ধরিস, জাস্ট ইন কেইস…।’সে–ও মাথা দুলিয়ে ‘হ্যাঁ’ বলল। তবে নামতে খুব একটা বেগ পেতে হলো না।
এবার বাকিদের নামানোর পালা। সবাইকে উল্টো দিকে ঘুরতে বললাম। একেকজন পা যখন নিচে নামাচ্ছিলেন, হাতে ধরে পাহাড়ের খাঁজে পা–টাকে সেট করে দিচ্ছিলাম; সঙ্গে দিচ্ছিলাম সাহস।
মোটিভেশন পেয়ে সবাই ধীরে ধীরে নেমে গেলেন। কিন্তু আমার কাঁধে ভর দিয়ে খালেদা আপুও যখন ভালোভাবে নেমে গেলেন, তখন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। চারদিক কুচকুচে অন্ধকার হয়ে যাওয়ার আগেই আমরা অটোরিকশা পর্যন্ত পৌঁছে গেলাম।






