হবিগঞ্জের অর্ধেকের বেশি নদীর অস্তিত্ব নেই
হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ পৌরসভার বুক চিরে বয়ে গেছে শাখা বরাক নদী। একসময়ের খরস্রোতা এই নদী দিয়ে লঞ্চ-স্টিমার চলাচল করত। কিন্তু এখন এটি সরু খাল হয়ে কোনোরকম টিকে আছে। দখল হওয়া নদীর দুই পাশে শত শত স্থাপনা দাঁড়িয়ে গেছে। অথচ, এই নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা জেলেপল্লি এখনো আছে, তবে নতুন পরিচয়ে। নতুন প্রজন্মের কাছে নদীর অতীত সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই।
স্থানীয় আনমনু গ্রামের ষাটোর্ধ্ব অনু মিয়া বলেন, ‘শৈশবে নদীর দুই পাড়ে নৌকার ভিড় লেগে থাকত। এখন যেখানে আনমনু গ্রাম, সেখানে বড় খাদ ছিল। এখানে নদীর ঘূর্ণিতে কত বাঁশের মাচা ডুবেছে, তার হিসাব নেই। শত শত লঞ্চ, স্টিমার, জাহাজ এই নদী দিয়ে চলত।’
নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা আনমনু গ্রামের আরেক বাসিন্দা নাবেদ মিয়া বলেন, ‘এই নদী দিয়ে লঞ্চ, স্টিমার, জাহাজ চলাচল করত, সেটা আমাদের জানা ছিল না। এত বড় নদী এখন একটা খাল হয়ে গেছে। ভাবতেই অবাক লাগে।’
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলা হবিগঞ্জ একসময় ছিল নদীঘেরা। হাওর অধ্যুষিত এই জেলার জীবন-জীবিকা ও বাণিজ্যের প্রধান মাধ্যম ছিল নদী। হবিগঞ্জ জেলাশহরসহ প্রতিটি উপজেলা গড়ে ওঠে নদীকে কেন্দ্র করে।
নদী নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠন ও পরিবেশকর্মীদের দাবি, সত্তরের দশকে জেলায় নদীর সংখ্যা ছিল ৫০টিরও বেশি। আর সরকারি হিসাবে বর্তমানে জেলার নদীর সংখ্যা মাত্র ২২টি। অর্থাৎ অর্ধেকের বেশি নদীর চিহ্নও এখন নেই। সেই সঙ্গে বিলীন হয়েছে নদীর সঙ্গে যুক্ত অসংখ্য খালও।
এদিকে, একসময়কার খরস্রোতা কুশিয়ারা, কালনী, খোয়াই, ধলেশ্বরী, রত্মা ও করাঙ্গীর মতো বড় নদীগুলোও আজ প্রবাহ হারিয়েছে। কোথাও স্রোত নেই, কোথাও পানিই থাকে না। বর্ষাকাল ছাড়া সারা বছর নদী খুঁজে পাওয়া দায়। অনেক নদীর পাড় দখল হয়ে সেখানে গড়ে উঠেছে ঘরবাড়ি, দোকানপাট, এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মসজিদ-মন্দির। দীর্ঘদিন ড্রেজিং না হওয়ায় অনেক নদী ভরাট হয়ে সমতল জমির মতো দেখায়।
বাহুবলের করাঙ্গী, মাধবপুরের সোনাই, হবিগঞ্জ শহরের খোয়াই, রত্মা ও সুতাং নদী- সবগুলোই একই সংকটে। কোথাও দখল, কোথাও শিল্পবর্জ্য দূষণ, কোথাও আবার ব্যক্তিমালিকানার খপ্পর। শুঁটকি নদী তো পুরোপুরি চলে গেছে বেসরকারি মালিকানায়।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের ২০২১ সালের জরিপে জেলার ২২টি নদী ও ৬৩টি খালের অস্তিত্ব নথিভুক্ত করা হয়। তাদের দাবি, এখন মূলত নদীগুলোকে বাঁচাতে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। কয়েকটি নদীতে ড্রেজিং ও খননকাজ করা হয়েছে।
তাদের তথ্যমতে, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ৫৭৩ কোটি টাকায় ‘হবিগঞ্জ জেলার বিবিয়ানা বিদ্যুৎকেন্দ্রের সম্মুখে কুশিয়ারা নদীর উভয় তীরের ভাঙন রোধ’ নামে একটি প্রকল্প হাতে নেয় তারা। এই প্রকল্পের আওতায় কুশিয়ারা ছাড়াও বেশ কিছু নদী ও খাল খনন করা হয়।
স্থানীয়দের অভিযোগ, এসব প্রকল্প নদী রক্ষার পরিবর্তে নদীকে আরও সংকুচিত করছে। কোটি কোটি টাকা ব্যয় হলেও নদী তার স্বাভাবিক রূপ ফিরে পাচ্ছে না। নবীগঞ্জের বিজনা নদী খনন প্রকল্পের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলা হয়েছে। করাঙ্গী নদীর খননে অনিয়মের অভিযোগ এনে স্থানীয়রা আন্দোলন করেও ফল পাননি। সবগুলো প্রকল্পে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এমনকি সংসদীয় উপকমিটিও দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) হবিগঞ্জ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল সোহেল মনে করেন, ‘দখল-দূষণ রোধে সরকারি কর্মকর্তাদের ব্যর্থতাই নদীর এই দুর্দশার মূল কারণ। প্রতিবার সরকারের বিভিন্ন সংস্থা নদী রক্ষার নামে প্রকল্প নেয়, কিন্তু সেগুলোতে জনসম্পৃক্ততা নেই। কিছুদিন হইচই করে আবার থেমে যায়।’
তিনি বলেন, ‘একসময় জেলায় ৫০টির বেশি নদী ছিল। কিন্তু এখনো পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে জেলায় নদীর সংখ্যা ২২টি। তার মানে অর্ধেকের বেশি নদী হারিয়ে গেছে। যেভাবে নদীর ওপর অত্যাচার চলছে, এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই হবিগঞ্জ মানচিত্র থেকে বাকি নদীগুলোও হারিয়ে যাবে। তখন হুমকিতে পড়বে প্রকৃতি-পরিবেশ ও জীবন-যাত্রা।’
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শামীম হাসনাইন মাহমুদ বলেন, ‘ইতোমধ্যে জেলার নদী দখলমুক্ত করতে ৫০০টির বেশি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। আরও স্থাপনা উচ্ছেদের জন্য তালিকা তৈরি করে জেলা প্রশাসনের কাছে পাঠানো হয়েছে। তবে হাইকোর্টে মামলা থাকায় কিছু স্থাপনা সরানো যাচ্ছে না।’