ছয় গুণধারীর জন্য জান্নাতের নিশ্চয়তা
মানুষের জীবন যেন এক অজানা যাত্রার পথিক। দুনিয়ার কোলাহলে সে অনেক সময় তার গন্তব্য ভুলে যায়। অথচ মহান আল্লাহ্ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে— তাঁর ইবাদত করা, তাঁর বিধান মানা এবং আখেরাতের চিরস্থায়ী সফলতা অর্জন করা। সেই সফলতার পরিণতি হলো জান্নাত।
জান্নাত— যেখানে নেই মৃত্যু, নেই ভয়, নেই দুঃখ কিংবা ক্ষুধা। যেখানে চিরন্তন শান্তি, অপরিসীম আনন্দ আর অমর সুখ। এই জান্নাতের নিশ্চয়তা দিয়েছেন আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.)। তবে এর জন্য তিনি ছয়টি শর্ত বেঁধে দিয়েছেন, তা মানুষের চরিত্র ও সমাজ নির্মাণের মূল চাবিকাঠি।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন: «اِضْمَنُوا لِي سِتًّا مِنْ أَنْفُسِكُمْ أَضْمَنْ لَكُمُ الْجَنَّةَ: اِصْدُقُوا إِذَا حَدَّثْتُمْ، وَأَوْفُوا إِذَا وَعَدْتُمْ، وَأَدُّوا إِذَا اؤْتُمِنتُمْ، وَاحْفَظُوا فُرُوجَكُمْ، وَغُضُّوا أَبْصَارَكُمْ، وَكُفُّوا أَيْدِيَكُمْ»
‘তোমরা আমাকে তোমাদের পক্ষ থেকে ছয়টি জিনিসের নিশ্চয়তা দাও, আমি তোমাদের জন্য জান্নাতের নিশ্চয়তা দিচ্ছি। (১) যখন কথা বলবে সত্য বলবে, (২) যখন ওয়াদা করবে তা পূর্ণ করবে, (৩) যখন আমানত দেওয়া হবে তা ফিরিয়ে দেবে, (৪) তোমাদের লজ্জাস্থান হেফাযত করবে, (৫) দৃষ্টি সংযত করবে, (৬) হাতকে (অন্যায় ও অত্যাচার থেকে) বিরত রাখবে।” (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস: ২২৪০৯; আল-মুস্তাদরাক, হাদিস: ৭৮৭৫)
এই হাদিসে মহানবী (সা.) ছয়টি গুণ ব্যক্তির মধ্যে ধারনের জন্য আহবান জানিয়ে বলেছেন যে, যদি এগুলো ধারণ করতে পারো তাহলে আমি তোমাদের জন্য জান্নাতের জামিনদার হবো। চলুন আমরা সেই ছয়টি বিষয়ের বিশদ আলোচনা করি।
১. সত্যবাদিতা: নৈতিকতার প্রথম ধাপ
মিথ্যা মানেই অন্ধকার। মিথ্যার আঁধারে আস্তে আস্তে সমাজ অচল হয়ে পড়ে। তাই নবী (সা.) প্রথমেই বলেছেন, “যখন কথা বলবে, সত্য বলবে।” সত্য শুধু একটি শব্দ নয়, এটি বিশ্বাসের আলো, হৃদয়ের দৃঢ়তা। কোরআনে নির্দেশ এসেছে—
﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَكُونُوا مَعَ الصَّادِقِينَ﴾“হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সঙ্গী হও। ” (আত-তাওবা, আয়াত : ১১৯)
২. ওয়াদাপূরণ : আস্থার ভিত্তি
মানবিক সম্পর্ক টিকে থাকে আস্থার উপর। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলে তা ভেঙে পড়ে। নবী (সা.) বলেছেন, “যখন ওয়াদা করবে, তা পূর্ণ করবে।” পবিত্র কোরআনও ঘোষণা করেছে—
وَأَوْفُوا بِالْعَهْدِ إِنَّ الْعَهْدَ كَانَ مَسْؤُولاً
“প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করো; নিশ্চয়ই প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।” (আল-ইসরা, আয়াত: ৩৪)
৩. আমানতের হেফাজত: দায়িত্বশীলতার পরিচয়
ধন-সম্পদ, পদ, দায়িত্ব, এমনকি ব্যক্তিগত গোপনীয়তাও এক ধরনের আমানত। মহানবী (সা.) বলেছেন, “যখন তোমাদের আমানত দেওয়া হবে, তা ফিরিয়ে দেবে।” পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন—
﴿إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تُؤَدُّوا الْأَمَانَاتِ إِلَى أَهْلِهَا﴾
“নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের আদেশ দেন যে, তোমরা আমানত তার হকদারের কাছে পৌঁছে দাও।” (আন-নিসা, আয়াত : ৫৮)
৪. পবিত্রতা: চরিত্রের সৌন্দর্য
আধুনিক পৃথিবীতে অশ্লীলতার ঝড় বইছে। কিন্তু ইসলাম শিখিয়েছে— “তোমরা লজ্জাস্থান হেফাজত করবে।” পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে—
وَالَّذِينَ هُمْ لِفُرُوجِهِمْ حَافِظُونَ
“যারা তাদের লজ্জাস্থান সংরক্ষণ করে।” (আল-মুমিনুন, আয়াত: ৫) লজ্জাশীলতা হলো ঈমানের অলঙ্কার, আর চরিত্রের আসল সৌন্দর্য।
৫. দৃষ্টি সংযম: হৃদয়ের জানালা রক্ষা
মানুষের চোখ হলো হৃদয়ের দরজা। কারণ মানুষ যা দেখে, তা-ই তার অন্তরে প্রভাব ফেলে। মহানবী (সা.) বলেছেন, “তোমরা দৃষ্টি সংযম করবে।” পবিত্র কোরআনের নির্দেশনাও ঠিক এমনি—
قُلْ لِلْمُؤْمِنِينَ يَغُضُّوا مِنْ أَبْصَارِهِمْ
“মুমিন পুরুষদের বল, তারা যেন দৃষ্টি সংযত করে।” (আন-নূর, আয়াত : ৩০) অশ্লীল দৃশ্যের দিকে তাকানো শয়তানের জন্য অন্তরে প্রবেশের সহজতম পথ।
৬. হাত সংযম: অন্যের নিরাপত্তা
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “তোমরা হাতকে (অন্যায় থেকে) বিরত রাখবে।” কারণ মুসলিম সেই, যার হাত ও জিহ্বা থেকে অন্য মুসলিম নিরাপদ থাকে। যা সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিমে বর্ণিত বিখ্যাত হাদিস। হাত হলো শক্তির প্রতীক। শক্তি যদি অন্যায় রোধে ব্যবহৃত হয়, তবে তা আলোকিত সমাজ গড়ে; কিন্তু যদি তা অত্যাচারে ব্যবহৃত হয়, তবে সমাজে নেমে আসে ধ্বংস।
এই ছয়টি গুণ শুধু ব্যক্তিগত নৈতিকতা নয়; এগুলো হলো পারিবারিক বন্ধন, সামাজিক ন্যায় ও রাষ্ট্রীয় শান্তির আসল ভিত্তি। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, এগুলোর নিশ্চয়তা দিলে জান্নাত নিশ্চিত। অথচ আমরা যদি গভীরভাবে চিন্তা করি, দেখব এই ছয়টি বিষয়ই আজকের দুনিয়ার সবচেয়ে বড় সংকট। মিথ্যা রাজনীতিকে কলুষিত করছে, ওয়াদাভঙ্গ পরিবার ভাঙছে, আমানত খিয়ানত রাষ্ট্রকে দুর্বল করছে, অশ্লীলতা সমাজকে গ্রাস করছে, দৃষ্টি ও হাতের বেপরোয়া ব্যবহার মানবতাকে বিপন্ন করছে। তাহলে সমাধান একটিই—মহানবী (সা.)-এর বাতলে দেয়া এই ছয় শিক্ষা জীবন ও সমাজে প্রতিষ্ঠিত করা। এর মাধ্যমেই আমরা পেতে পারি দুনিয়ার শান্তি আর আখেরাতের জান্নাত।
আল্লাহ আমাদের সকলকে নববী শিক্ষার আলোকে আমল করার তাওফিক দান করুন। আমীন।