শ্রীমঙ্গলে সার ডিলারদের বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগ
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে সার ডিলারদের বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ব্যবসা পরিচালনা করছেন কতিপয় ডিলার। খাতা কলমে ডিলারশীপ থাকলে, অনেকেই নেই কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। আবার একই পরিবারের একাধিক ব্যক্তির নামে রয়েছে সারের ডিলার। এতে অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট এর মাধ্যমে কৃষকদের জিম্মি করে ফেলেছেন। সচেতন মহলের দাবী সিন্ডিকেট না ভাঙলে কৃষকরা তাদের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন। অভিযোগ আছে, প্রকাশ্যে নিয়মনীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না ডিলারদের বিরুদ্ধে।
জানা যায়, উপজেলার ৯টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভায় বিসিআইসির সারের ডিলারশীল নিয়োগ দেয় তৎকালিন সরকার। তারা হলেন শ্রীমঙ্গল পৌরসভা এলাকার জন্য মোমিনুল হোসেন সোহেলের মালিকানাধীন সোহেল এন্টারপ্রাইজ, ১ নম্বর মির্জাপুর ইউনিয়ন এলাকার জন্য হাজী মস্তান মিয়ার মালিকানাধীন জলি এন্টারপ্রাইজ, ২ নম্বর ভুনবীর ইউনিয়ন এলাকার জন্য সুজিত দেবের মালিকানাধীন ইকো এগ্রিকালচার স্টোর, ৩ নম্বর শ্রীমঙ্গল ইউনিয়ন এলাকার জন্য অনুকুল চন্দ্র দাশের মালিকানাধীন জননী এন্টারপ্রাইজ, ৪ নম্বর সিন্দুরখান ইউনিয়ন এলাকার জন্য পলাশ দেবের মালিকানাধীন মিতালী এন্টারপ্রাইজ, ৫ নম্বর কালাপুর ইউনিয়ন এলাকার জন্য দিপলু আহমদের মালিকানাধীন সায়মা ট্রেডার্স, ৬ নম্বর আশীদ্রোন ইউনিয়ন এলাকার জন্য স্বপন কপালীর মালিকানাধীন মনমোহন ট্রেডার্স, ৭ নম্বর রাজঘাট ইউনিয়ন এলাকার জন্য ওয়াহিদুজ্জামানের মালিকানাধীন জামান ট্রেডার্স, ৮ নম্বর কালিঘাট ইউনিয়ন এলাকার জন্য শান্ত কপালীর মালিকানাধীন উত্তরা ট্রেডার্স এবং ৯ নম্বর সাতগাঁও ইউনিয়ন এলাকার জন্য পরিমল দাশের মালিকানাধীন রাহুল ট্রেডার্স। পরবর্তীকালে ২ নম্বর ভুনবীর ইউনিয়ন এলাকার ডিলার সুজিব দেব মৃত্যুবরণ করলে তার স্ত্রী অর্পনা দেবের নামে এবং ৭ নম্বর রাজঘাট ইউনিয়ন এলাকার ডিলার ওয়াহিদুজ্জামান মৃত্যুবরণ করলে তার স্ত্রী আবিদা সুলতানা চৌধুরীর নামে ডিলারশীপ পরিবর্তন করা হয়। এসব পাইকারী সার ডিলার ছাড়াও নয়টি ইউনিয়ন ও একটি পৌর এলাকায় আরো ৬৪ জনকে খুচরা সার বিক্রেতা হিসেবে ডিলারশিপ প্রদান করা হয়।
অভিযোগ রয়েছে, যে দশজন সারের ডিলারশিপ নিয়োগ পেয়েছেন, তাদের ছাড়া নিয়োগকালে আর কাউকে আবেদনের সুযোগ দেওয়া হয়নি। যারা নিয়োগ পেয়েছিলেন তারা তৎকালীন সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিক জাতীয় পার্টির কর্মী-সমর্থক। ফলে ওই দশজনই উপজেলার ৯টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভায় বিসিআইসির সারের ডিলারশিপ ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছেন। ওই দশ ডিলারের মধ্যে আবার একই পরিবারের একাধিক ডিলারও রয়েছেন। ১ নম্বর মির্জাপুর ইউনিয়নের ডিলার হাজী মস্তান মিয়া, তার ছেলে বদরুল ইসলামের নামে রয়েছে পৌর এলাকায় সাব ডিলার। ৩ নম্বর শ্রীমঙ্গল ইউনিয়ন এলাকার ডিলার অনুকূল চন্দ্র দাশের আপন ভাই পরিমল দাশ ৯ নম্বর সাতগাঁও ইউনিয়ন এলাকার ডিলার এবং অনুকূল চন্দ্র দাশের দুই শালা(অর্থাৎ বৌয়ের ভাই) পান্না লাল দাশ, বকুল দাশের নামে পৌর এলাকায় রয়েছে সাব ডিলার এবং পান্না লাল দাশ নিজে জানেন না তার নামে যে সাব-ডিলার রয়েছে। অপরদিকে ৬ নম্বর আশীদ্রোন ইউনিয়ন এলাকার ডিলার স্বপন কপালী ও ৮ নম্বর কালীঘাট ইউনিয়ন এলাকার ডিলার শান্ত কপালী ভাতিজা (আপন ভাইয়ের ছেলে)। শ্রীমঙ্গল পৌরসভা এলাকার জন্য মোমিনুল হোসেন সোহেলের মালিকানাধীন সোহেল এন্টারপ্রাইজ বর্তমানে তিনি রাজনীতি মামলায় জেলে রয়েছেন তার নামে সার উত্তোলন করেছেন সিন্দুরখানের ডিলার মিতালী এন্টার প্রাইজ এর পলাশ। পরিমল দাশের ও দুই শালা (অর্থাৎ বৌয়ের ভাই) এর ডিলারশিপ পরিচালনা করছেন অনুকূল চন্দ্র দাশ এবং শান্ত কপালীর ডিলারশিপ পরিচালনা করছেন স্বপন কপালী। আবার খুচরা সাব ডিলার অনেকেই করছেন না ব্যবসা, তাদের নামে রয়েছে সাব-ডিলার।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শ্রীমঙ্গল পৌর এলাকার মোমিনুল হোসেন সোহেল শ্রীমঙ্গল উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি । ১ নম্বর মির্জাপুর ইউনিয়নের ডিলার হাজী মস্তান মিয়া ইউনিয়ন জাতীয় পার্টির সভাপতি, ২ নম্বর ভুনবীর ইউনিয়ন এলাকার ডিলার সুজিত দেবের পরিবার আওয়ামী লীগের সমর্থক। সুজিব দেবের স্ত্রী অর্পনা দেবের ছোট ভাই সুব্রত দেব ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। বাকি ডিলারদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি বা সমমনা দলের কর্মী-সমর্থক।
বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশনের (বিসিআইসি) সার ডিলার নিয়োগ ও সার বিতরণ সংক্রান্ত সমন্বিত নীতিমালা-২০০৯ এর ৩ ধারার ৩.২ উপধারায় উল্লেখ রয়েছে ‘নিজ মালিকানায় অথবা ভাড়ায় ইউনিয়ন পরিষদ/পৌরসভায় বিক্রয়কেন্দ্রসহ কমপক্ষে ৫০ মেট্রিক টন ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন গুদাম থাকতে হবে।’ কিন্তু শ্রীমঙ্গলের কোন ইউনিয়নেই কোন বিসিআইসি সার ডিলারের বিক্রয়কেন্দ্র এবং ৫০ মেট্রিক টন ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন গুদাম নেই। প্রায় সব ডিলারেরই বিক্রয়কেন্দ্র ও গুদাম পৌর এলাকায় অবস্থিত। খুচরা বিক্রেতাদের অভিযোগ, সার ডিলার নিয়োগ ও সার বিতরণ সংক্রান্ত সমন্বিত নীতিমালা-২০০৯ উপেক্ষা করে প্রায় সকল ডিলারই তাদের বিক্রয়কেন্দ্র ও গুদাম পৌর এলাকায় স্থাপন করায় তারা (খুচরা বিক্রেতা) পৌর এলাকা থেকে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নে সার নিয়ে প্রান্তিক কৃষকদের কাছে বিক্রি করতে হয়। পৌর এলাকা থেকে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নে সার নিতে পরিবহণ খরচ বহন করতে হয় তাদের। এতে সারের গড়মূল্য বৃদ্ধি পায়। আবার যখন কৃষির মৌসুম তখন কৃত্রিম সঙ্কট দেখিয়ে ডিলাররা তাদেরকে সার সরবরাহ করেন না। ওই সময়ে তারা বাইরে সার অনৈতিকভাবে বিক্রি করেন। ফলে কৃষির মৌসুমে জেলার বাইরে থেকে অধিক মূল্যে তাদেরকে সার ক্রয় করতে হয়। এতে পরিবহন খরচ করে মৌসুমে অনেক সময় ক্ষতির শিকার হন তারা।
কয়েকজন খুচরা বিক্রেতা ও কৃষক অভিযোগ করে বলেন, ‘মূলত ৬৮ হাজার গ্রাম বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে কৃষকদের সুবিধার্থে উপজেলার ৯টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভায় ১০জন বিসিআইসি অনুমোদিত সার ডিলার নিয়োগ দেয়া হয়। প্রতিজন সার ডিলার যে ইউনিয়নের ডিলার ওই ইউনিয়নে সার গুদামে মজুদ রেখে বিক্রয়কেন্দ্রের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের অনুমোদিত খুচরা সার বিক্রেতাদের কাছে বিক্রির কথা থাকলেও গত ১৬ বছর ধরে সরকারের আর্শীবাদপুষ্ট হয়ে কৃষি অধিদফতরের নীতিমালার তোয়াক্কা না করে এক ডিলার একাধিক সাইসেন্সের সার উত্তোলন করে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাজারে কৃৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে চড়া দামে বিক্রি করছে।
১ নম্বর মির্জাপুর ইউনিয়নের বিসিআইসি সার ডিলার হাজী মস্তান মিয়ার ছেলে পৌর এলাকার সাব ডিলার বদরুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের ইউনিয়নের খুচরা সার বিক্রেতাদের সব সময় প্রয়োজনমতো সার সরবরাহ করে আসছি। আমাদের উপর খুচরা ডিলারের কোনো অভিযোগ নেই।
২ নম্বর ভুনবীর ইউনিয়নের বিসিআইসি সার ডিলার অর্পনা দেবের মুঠোফোনে বলেন, আমাদের কোনো ব্যবসা প্রতিষ্টান নেই ভূনবীর ইউনিয়নে। তবে শ্রীমঙ্গল নতুন বাজারের আমাদের দোকান আছে।
৩ নম্বর শ্রীমঙ্গল ইউনিয়নের বিসিআইসি সার ডিলার অনুকুল চন্দ্র দাশ দুটি ডিলারশীপ লাইসেন্স এককভাবে পরিচালনার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, ‘আমার ভাই পরিমল দাশের প্রতিষ্ঠান রাহুল ট্রেডার্সের নামে ৯ নম্বর সাতগাঁও ইউনিয়নের ডিলারশীপ লাইসেন্স রয়েছে। সে কানে কম শুনে। তাই ভাইয়ের সারের ব্যবসাটিও আমি পরিচালনা করি। দুই ইউনিয়নের কোথাও আমাদের গুদাম নেই। শ্রীমঙ্গল ইউনিয়নের সবুজবাগ এলাকায় গুদাম ও বিক্রয়কেন্দ্র করেছিলাম। কিন্তু সার বিক্রি হয় না। তাই আমরা নতুন বাজার এলাকায় সার রাখি। এখান থেকে সহজেই সবাই সার নিতে পারেন। সারের কোন সঙ্কট নেই। যখন যার যতটুকু সার প্রয়োজন তা আমরা সরবরাহ করি।
৪ নম্বর সিন্দুরখান ইউনিয়নের বিসিআইসি সারের ডিলার পলাশ দেব বলেন, ‘সিন্দুরখানে আমার কোন গুদাম ঘর নেই। শ্রীমঙ্গল শহরের ভানুগাছ রোডে আমার সারের দোকান রয়েছে। আমি আমার ইউনিয়নের সব সাব ডিলারকে এখান থেকে দিয়ে দিই। আজও দিছি, আর শ্রীমঙ্গল পৌরসভার বিসিআইসি ডিলার এর নামে উনার স্ত্রী সার উত্তোলন করেছেন । আমি শুধু উনাকে সহযোগীতা করি?
৫ নম্বর কালাপুর ইউনিয়নের বিসিআইসি সারের ডিলার দিপলু আহমদ ফোনে বলেন, আমি এখন ভিজি আছি? আপনাকে পরে ফোন দিবো?
৬ নম্বর আশীদ্রোন ইউনিয়নের বিসিআইসি সারের ডিলার স্বপন কপালী বলেন, ‘আমার আশীদ্রোন ইউনিয়নের কাকিয়াপুলের কাছে আমার গুদাম আছে। সারের কোন সঙ্কট নেই। খুচরা বিক্রেতাদের কাছে সব সময়ই সার সরবরাহ করে আসছি।’ কালিঘাট ইউনিয়নের সার ডিলার শান্ত কপালী তার ভাতিজা বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, ভাতিজা তার ব্যবসা পরিচালনা করেন। অথচ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. মহিউদ্দিন কর্তৃক ২০২৩ সালের ৩১ আগস্ট স্বাক্ষরিত বিসিআইসি সার ডিলারদের নাম ও ঠিকানার তালিকায় স্বপন কপালী ও শান্ত কপালীর সাথে যোগাযোগের একটিই মুঠোফোন নম্বর (০১৭১…..৫০) দেয়া রয়েছে।
এসব ব্যাপারে শ্রীমঙ্গল উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আলাউদ্দিন বলেন, শ্রীমঙ্গল উপজেলায় ১০টি বিসিআইসি সার ডিলার রয়েছে। ৩টি ইউনিয়নে চা বাগান অধ্যুষিত হওয়ার কারনে কৃষি জমির পরিমান কম। এই ৩টি ইউনিয়নের ডিলার ইউনিয়নের পাশাপাশি উপজেলা শহরে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছেন। বাকি ৬টি ইউনিয়নের ডিলারগন নিজ নিজ ইউনিয়নে পাশাপাশি উপজেলা শহরে ব্যবসা করে থাকেন। একই ব্যক্তি নামে একের অধিক ডিলারশীপ নেই। সোহেল এন্টারপ্রাইজের মালিক জেলে রয়েছেন। এটা জানার পর তাকে চিঠি দেয়া হয়েছে। বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহনের কার্যক্রম চলমান আছে। নিয়মিত ব্যবসা না করতে পারলে ডিলারশীপ বাতিলসহ অন্যান্য ব্যবস্থা নেয়া হবে। আর খুচরা সার ডিলার যারা নিয়মিত ব্যবসা করেন না তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহন কর হবে।
শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ইসলাম উদ্দিন বলেন, ‘আমাদের কেউ অভিযোগ করেনি। অভিযোগ পেলে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।