শেখ হাসিনাকে যতদিন দরকার রাজনৈতিক আশ্রয়ে রাখবে ভারত: বিক্রম মিশ্রি
ভারতে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সংবাদদাতা সমিতির (ডিক্যাব) একদল প্রতিনিধির সঙ্গে সোমবার (৬ অক্টোবর) মতবিনিময় করেছেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি।
সেখানে তিনি মন্তব্য করেন, শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশ তাদের হাতে তুলে দেওয়ার যে অনুরোধ এসেছে সেটি একটি আইনগত বা বিচারিক বিষয়। ভারত এটি বিবেচনা করছে এবং যথাযথ প্রক্রিয়ায় এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে।
এ সময় বিক্রম মিশ্রি আরও জানান, বাংলাদেশের জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে যে রাজনৈতিক সরকারই ক্ষমতায় আসুক, তাদের সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত ভারত। যদিও বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ-বিহীন অন্তর্ভুক্তিমূলক ও অংশগ্রহণমূলক (ইনক্লুসিভ ও পার্টিসিপেটরি) নির্বাচনকে তারা কতটা গ্রহণযোগ্য বলে মনে করবে, সে প্রসঙ্গ বিক্রম মিশ্রি এড়িয়ে যান।
বিক্রম মিশ্রির কথা থেকে অনেকেই এই উপসিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে, ভারত বাংলাদেশের রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপে খুব শিগ্গিরই আওয়ামী লীগের প্রত্যাবর্তন ঘটছে না এবং আগামী নির্বাচনেও তাদের অংশগ্রহণের কোনও সম্ভাবনা নেই- এই বাস্তবতা মেনে নিচ্ছে।
পাশাপাশি অনেকে এমনটাও মনে করছেন, শেখ হাসিনাকে বন্দী প্রত্যর্পণ চুক্তির আওতায় হস্তান্তরের সম্ভাবনাও ভারত এখন হয়তো পুরোপুরি নাকচ করতে চাচ্ছে না।
এছাড়া, চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে নিউ ইয়র্ক সফরে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ডিজিটাল সংবাদমাধ্যম জিটিও-র মেহদি হাসানের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে ভারতের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, ‘তারা বোধহয় এখনও আশা করছেন যে উনি (শেখ হাসিনা) পূর্ণ গৌরবের সঙ্গে বাংলাদেশে ফিরে আসবেন, একজন বিজয়ী নেতার বেশে ফিরবেন!’
শেখ হাসিনাকে নিয়ে বাংলাদেশের সরকার-প্রধান এবং ভারতের সর্বোচ্চ কূটনীতিকের এই দুই আনুষ্ঠানিক বক্তব্য সম্পূর্ণ বিপরীত তাতে কোনও সন্দেহ নেই! শেখ হাসিনাকে নিয়ে ভারতের পরিকল্পনা এবং বাংলাদেশ বিষয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গির বিস্তর পার্থক্য আছে। কিন্তু দিল্লিতে শেখ হাসিনাকে কেন্দ্র করে এই মুহূর্তে চিন্তাভাবনাটা আসলে কী?-এ প্রশ্নের উত্তরে দিল্লির একাধিক শীর্ষস্থানীয় সরকারি কর্মকর্তা, সাবেক কূটনীতিবিদ ও থিংকট্যাংক ফেলো প্রায় একই রকম মন্তব্য করেছেন। আর তা হলো : শেখ হাসিনা ভারতকে একটা ‘ক্যাচ টোয়েন্টি টু’ সিচুয়েশনে ফেলেছেন। অর্থাৎ তাকে এখন দিল্লি না পারছে গিলতে, না পারছে উগরাতে!
কিন্তু তার মানে কখনোই এও নয় যে, ভারত তাকে সংকটের মুহূর্তে একাকী ত্যাগ করতে চাইছে।
ভারতের সাবেক শীর্ষস্থানীয় কূটনীতিবিদ টিসিএ রাঘবন বলেন, ‘আজ যদি ভারত তাদের এত বছরের পরীক্ষিত বন্ধু শেখ হাসিনার পাশে না দাঁড়ায়, তাহলে ভবিষ্যতে দক্ষিণ এশিয়ার কোনও দেশে কখনেও কোনেও নেতাই ভারতের বন্ধুত্বে আস্থা রাখতে পারবে না। ফলে আমরা চাই বা না-চাই, শেখ হাসিনাকে আমরা কিছুতেই ফেলতে পারব না!’
ভারতের সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী বিক্রমজিত ব্যানার্জি বলেছেন, ‘বাংলাদেশে গত অগাস্টের পালাবদলের পর যেভাবে ঢালাও মিথ্যা মামলার ধূম পড়েছে এবং আদালত প্রাঙ্গণেও সাবেক নেতা-মন্ত্রীদের হেনস্তা হতে হচ্ছে তাতে ভারত এটা মনে করতেই পারে যে শেখ হাসিনাকে হস্তান্তর করা হলেও তিনি আদৌ সুষ্ঠু বিচার পাবেন না। শুধু এই যুক্তিতেই প্রত্যর্পণের অনুরোধ খারিজ করা সম্ভব।’
বিজেপির ঘনিষ্ঠ ফরেন পলিসি এক্সপার্ট শুভ্রকমল দত্তর কথায়, ‘ভারত তার আতিথেয়তা, নিরাপত্তা বা সুরক্ষার দায়িত্ব নিয়েছে, অত্যন্ত সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে তার এদেশে থাকার ব্যবস্থা করেছে – কিন্তু বাংলাদেশে তার রাজনৈতিক পুনর্বাসনের কোনও দায়িত্ব নেয়নি।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমি যতদূর জানি বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যদি কখনও শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তনের অনুকূল হয় এবং তিনি নিজে মনে করেন দেশে ফিরে যাবেন তাহলে অন্য কথা – কিন্তু সেটা না হলে ভারত তাকে ‘প্যারাড্রপ’ করে বাংলাদেশে বসিয়ে দিয়ে আসবে বলে ভাবছে, এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা।’
ফলে ‘শেখ হাসিনা বীরের বেশে বাংলাদেশে ফিরবেন বলে ভারত এখনও ভাবছে’ বলে সম্প্রতি ড: ইউনূস যে মন্তব্য করেছেন সেটাকেই খন্ডন করছেন ভারতের পর্যবেক্ষকরা।
ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাই কমিশনার পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, ‘আমার তো মনে হচ্ছে ওনাকে এখন বেশ লম্বা সময় এখানেই থেকে যেতে হবে। চট করে অন্য কোথাও যাওয়ার তো কোনও সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।’
তিনি বলেন, ‘বিদেশি নেতা-নেত্রীদের আশ্রয় দেওয়ার ঐতিহ্য আছে ভারতের। তিব্বতি ধর্মগুরু দালাই লামা আজ ছেষট্টি বছরের ওপর ধরে ভারতে আছেন। সাবেক আফগান প্রেসিডেন্ট মহম্মদ নাজিবুল্লাহ’র পরিবারও এদেশে আছেন তিরিশ বছরের ওপর। আমি নিশ্চিত শেখ হাসিনাকেও ভারত যতদিন দরকার হবে রাখবে এবং তার প্রাপ্য সম্মান দিয়েই রাখবে।’
ফলে শেখ হাসিনাকে বিচারের জন্য বাংলাদেশের হাতে তুলে দেওয়ার যেমন কোনও বাস্তবসম্মত সম্ভাবনা নেই – তেমনি ভারত নিজে হাতে করে তাকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করার চেষ্টা করবে এমন কোনও লক্ষণও নেই।







