৪২৭ কিলোমিটার মহাসড়কে বছরে ৪০৬ দুর্ঘটনা, নিহত ২৯০
ফরিদপুরসহ দক্ষিণাঞ্চলে গত একবছরে বিভিন্ন মহাসড়কে ৪০৬টির মতো দুর্ঘটনা ঘটেছে। আর এসব দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা প্রায় ১০৭৪ জন। এর মধ্যে নিহত হয়েছেন ২৯০ জন ও আহত হয়েছেন ৭৮৪ জন। ফরিদপুর-মাদারীপুর অঞ্চলের আওতাধীন ৪২৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের মহাসড়কগুলোতে এসব দুর্ঘটনা ঘটে।
মাদারীপুর রিজিয়ন (হাইওয়ে পুলিশ) কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, মাদারীপুর রিজিয়নের আওতাধীন ৪২৭ কিলোমিটার মহাসড়ক। এর মধ্যে ৫টি থানা, ১টি পুলিশ ফাঁড়ি, ৩টি ক্যাম্প রয়েছে। ৩৮টি টহল টিম রয়েছে। লোকবলের সংখ্যা ২৫৮ জন। ২০২৪ সালের ১ অক্টোবর থেকে ২০২৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এসব মহাসড়কে ছোট-বড় মিলিয়ে মোট প্রায় ৪০৬টি দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটে। এতে নিহতের সংখ্যা ২৯০ জন এবং এতে আহত হয়েছেন ৭৮৪ জনের মতো।
এদিকে মহাসড়ক ছাড়াও বিভিন্ন আঞ্চলিক সড়ক, উপজেলা ও গ্রামীণ রাস্তায় গত এক বছরে কমপক্ষে কয়েকশ সড়ক দুর্ঘটনায় অন্তত শতাধিক ব্যক্তি প্রাণ হারিয়েছেন বলে জানা গেছে।
কোন শ্রেণির মানুষ বেশি মারা গেছে :
গত এক বছরে ৪০৬টি দুর্ঘটনার মধ্যে লোকাল বাস, ট্রাক, নসিমন, পিকআপ ও মোটরসাইকেলের সংখ্যা বেশি। এসব দুর্ঘটনায় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নিহত হয়েছেন। এরমধ্যে বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালক-আরোহী ও লোকাল বাসের যাত্রীর সংখ্যা বেশি। সেক্ষেত্রে সাধারণ পরিবারের মানুষই দুর্ঘটনায় বেশি নিহত হয়েছেন।
দুর্ঘটনার কারণ
হাইওয়ে পুলিশ, চালক ও যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ফরিদপুর-মাদারীপুর অঞ্চলের আওতাধীন প্রায় ৪২৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ২২টির অধিক মহাসড়কে নছিমন, করিমন, ভটভটি, মাহিন্দ্র, ব্যাটারিচালিত রিকশা, ইজিবাইক ও ভাড়ায়চালিত মোটরসাইকেল চলাচল বন্ধের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কিন্তু এসব অবৈধ যান মহাসড়কে বীরদর্পে অবাধে চলাচল করে। পদ্মা সেতু চালুর পর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে দক্ষিণবঙ্গে আঞ্চলিক ও দূরপাল্লার পরিবহন চলাচল বৃদ্ধি পেয়েছে। মহাসড়কে অবৈধ যান চলাচলের কারণে প্রতিনিয়ত ঘটছে নানা দুর্ঘটনা। এছাড়াও ত্রুটিপূর্ণ সড়ক ব্যবস্থার কারণে দিন দিন দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
মহাসড়কগুলোতে বাঁক থাকার কারণে অনেক চালক দুর্ঘটনা ঘটিয়ে থাকেন। মহাসড়ক-রাস্তার পাশে অবৈধ স্থাপনা, হাট-বাজার স্থাপন এবং ওভারব্রিজ না থাকার কারণে ঘটছে দুর্ঘটনা। এছাড়া অদক্ষ চালক, ওভার ট্রেকিং, বেপরোয়া গতি, চলন্ত গাড়িতে চালকের মোবাইলে কথা বলা, চোখে ঘুম নিয়ে গাড়ি চালানোর কারণেও দুর্ঘটনা ঘটে থাকে।
দুর্ঘটনা রোধে করণীয়
ফরিদপুর গোল্ডেন লাইন পরিবহনের চালক মো. লিয়াকত হোসেন বলেন, রাস্তা খারাপের কারণে দুর্ঘটনা ঘটে। একটানা দীর্ঘক্ষণ গাড়ি চালানোর কারণেও দুর্ঘটনা হয়। অবৈধ যানবাহনগুলো রাস্তায় এলোমেলো চলাচল করে। তাদের বেপরোয়া চলাচলে দুর্ঘটনা ঘটে। রাস্তার ওপর হাটবাজার, রাস্তায় গাড়ি আছে কি-না, তা না দেখেই পারাপার বা পাল্লাপাল্লির কারণেও দুর্ঘটনা হয়। সবদোষই যে চালকদের, তা কিন্তু নয়। অথচ দুর্ঘটনা হলে সব দোষ চাপানো হয় চালকের ওপর। তবে অনেক সময় অদক্ষ চালক ও চোখে ঘুম, ক্লান্ত শরীর নিয়ে গাড়ি চালানোর কারণেও দুর্ঘটনা ঘটে।
বোয়ালমারীর বাসিন্দা শামীম প্রধান বলেন, চালকদের বেপরোয়া গতি, দুর্বল ট্র্যাফিক ব্যবস্থাপনা, সড়কের ওপর অবৈধ হাটবাজার ও স্থাপনা, যত্রতত্র রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, অতিরিক্ত মাল ও যাত্রীবোঝাই প্রভৃতি কারণে যানবাহনের নিয়ন্ত্রণ বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এছাড়া পথচারীদের ফুটপাত, জেব্রা ক্রসিং, ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার না করার ফলেও অনেক সময়ে দুর্ঘটনা ঘটে।
ফরিদপুর শহরের বাসিন্দা ও মুক্ত সমাজের সভাপতি পারভেজ হাসান রাজিব বলেন, বেপরোয়া গতিতে যানবাহন চালানো, অদক্ষ চালক, ভাঙা রাস্তা, উঠতি বয়সী তরুণদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানোর কারণে দুর্ঘটনাগুলো বেশি ঘটে। এছাড়াও বিশেষ করে আমাদের এসব রুটে অন্যান্য পরিবহনের তুলনায় গোল্ডেন লাইন পরিবহনগুলোতে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে। প্রায় দিনই গোল্ডেন লাইন পরিবহন দুর্ঘটনার শিকার হয়। বিশেষ করে তাদের অদক্ষ চালক ও বেপরোয়া গতির কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
পরিবহন সমিতির বক্তব্য
এ বিষয়ে ফরিদপুর জেলা বাস মালিক গ্রুপের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মো. আনিসুর রহমান বলেন, ভাঙাচোরা রাস্তা, পরিবহনগুলোর যান্ত্রিক ত্রুটি, অদক্ষ চালক ও পথচারীদের এলোমেলো চলাচলের কারণে মূলত সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। বিশেষ করে সড়কে অবৈধ যানচলাচল, উঠতি বয়সী মোটরসাইকেল চালকদের বেপরোয়া গতি ও চোখে ঘুম নিয়ে বা অসুস্থ অবস্থায় ক্লান্ত শরীর নিয়ে গাড়ি চালানোর কারণেও দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। আমাদের জায়গা থেকে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে চালকদের সঠিকভাবে গাড়ি চালানোর পরামর্শ দেওয়া হয়।
যা বলছে পুলিশ
ভাঙ্গা হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রোকিবুজ্জামান বলেন, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। তারমধ্যে বেপরোয়া মোটরসাইকেলের চালক, দ্রুতগামী পরিবহনগুলোতে দুর্ঘটনা বেশি ঘটে। সেক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় হতাহতের মধ্যে ১৮ থেকে ৪৫ বছর বয়সী মানুষের সংখ্যা বেশি।
হাইওয়ে পুলিশের মাদারীপুর রিজিয়নের ফরিদপুর কার্যালয়ের পুলিশ সুপার মো. রহমতুল্লাহ বলেন, গতবারের তুলনায় এ বছর সড়ক দুর্ঘটনার পরিমাণ ও হতাহতের সংখ্যা তুলনামূলক কম। আমাদের টিমের সদস্যরা শিফট ভাগ করে রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করে থাকেন। মহাসড়কগুলোতে চলাচলকারী বিভিন্ন ধরনের যানবাহনগুলো হাইওয়ে পুলিশ নজরদারিতে রাখে। এসময় বেপরোয়া চলাচলকারী যানবাহনগুলোকে মামলা ও জরিমানা করা হয়।
তিনি আরও বলেন, মহাসড়কগুলোতে বীরদর্পে বিভিন্ন ধরনের অবৈধ যানবাহন চলাচল করে। তাছাড়া বিআরটিএ শক্তিশালী নয়, আমরা আইন প্রয়োগ করি মাত্র। ওভার ট্রেকিং ও বেপরোয়া গতির কারণে দুর্ঘটনা ঘটে। ৮০ কিলোমিটারের জায়গায় ১২০ কিলোমিটার, আবার ৮০ কিলোমিটারের জায়গায় ধীর গতিতে গাড়ি চালানো হয়। আসলে আমাদের নামেই মহাসড়ক। মহাসড়কের নিয়ম কানুন মানা হয় না। আমাদের জায়গা থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মহাসড়কগুলোতে পুলিশ সদস্যরা কাজ করে থাকেন। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে পুলিশ, পথচারী ও চালকদের সচেতনতার বিকল্প নেই। এক কথায় সবার সচেতনতা ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাই কেবলমাত্র সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করতে পারে।
বিআরটিএর বক্তব্য
বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) ফরিদপুরের সহকারী পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ নাছির উদ্দীন বলেন, বিআরটিএ থেকে চালকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে চালক, সাধারণ মানুষের মাঝে জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। এছাড়া সারা বছর বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থীদের মাঝে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সচেতনতামুলক কার্যক্রম চালানো হয়। ফরিদপুরে চলতি অর্থবছরে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতদের মাঝে দুই কোটি পঁচিশ লাখ টাকা আর্থিক সাহায্য করা হয়েছে। এক্ষেত্রে নিহত ব্যক্তির পরিবার পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত পেয়ে থাকেন।
সচেতন নাগরিকদের মতামত
নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের (নিসআ) ফরিদপুরের সভাপতি আবরাব নাদিম ইতু বলেন, নানা কারণে সড়ক-মহাসড়কে প্রতিনিয়ত সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। চালকরা অনেক সময় ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত অবস্থায় গাড়ি চালাতে বাধ্য হন, ফলে তারা নিজের অজান্তেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেন।
ফরিদপুর জর্জ কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সেলিমুজ্জামান রুকু বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সবার আগে চালকদের সচেতন হতে হবে। অসুস্থ বা ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত অবস্থায় গাড়ি চালানো যাবে না। ওভারটেকিং প্রবণতা কমাতে হবে। সড়কে বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালকসহ যানবাহন চালকদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
ফরিদপুর নাগরিক মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক প্রবীর কান্তি পান্না বালা বলেন, যানবাহন চালকদের অসাবধানতা ও লাইসেন্সবিহীন অদক্ষ চালক, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, রাস্তার স্বল্পতা-অপ্রশস্ততা, পাল্লা দিয়ে গাড়ি চালানো ও ওভারটেকিং, ট্র্যাফিক আইন সম্পর্কে অজ্ঞতা ও ট্র্যাফিক আইন ভঙ্গ করা, পথচারীদের মধ্যে অসচেতনতা, ফুটপাত হকারদের দখলে থাকার কারণে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটছে। এছাড়াও বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু তদন্ত কমিটি তদন্তের পর বাস্তবায়নে কোনো উদ্যোগ নেয় না, যার কারণে দুর্ঘটনা রোধে কোনো ফলাফলও পাওয়া যায় না। সূত্র: জাগো নিউজ