হিংস্র প্রাণী ও মানুষের লড়াইয়ের স্মৃতিচিহ্ন
একটা সময় ছিল যখন ইতালির রোম শহরে হিংস্র প্রাণীর সঙ্গে মানুষের লড়াই দেখতে প্রায় গোলাকার ছাদবিহীন মঞ্চ কলোসিয়ামে জড়ো হতেন হাজার হাজার মানুষ। বিশ্ব ঐতিহ্যের ওই স্থাপনাটি দেখতে বর্তমানে প্রতিদিন সেখানে বিভিন্ন দেশের ২০ হাজারের বেশি মানুষ জড়ো হন। তবে এখন আর সেখানে হিংস্র প্রাণীর সঙ্গে মানুষের লড়াই হয় না। স্থাপনাটি বিশ্বের নতুন সপ্তাশ্চর্যের একটি।
এই কলোসিয়ামে একটা সময় একসঙ্গে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ গ্ল্যাডিয়েটরদের (দাসযোদ্ধা) সঙ্গে হিংস্র পশুর রোমাঞ্চকর লড়াই উপভোগ করতেন। ঐতিহাসিক এই স্থাপনাটি প্রায় দুই হাজার বছর আগে নির্মাণ করেছিলেন রোমান সম্রাটরা। ৪০০ বছর সেখানে মানুষের সঙ্গে পশুর খেলা এবং মৃত্যুদণ্ড পাওয়া বন্দিদের হিংস্র প্রাণী দিয়ে নৃশংসভাবে হত্যার খেলা চলার পর বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর কেটেছে এক হাজার ৬০০ বছর।
ওই কলোসিয়াম এখনো দাঁড়িয়ে আছে সেই ঐতিহ্যের স্মারক নিয়ে। ভূমিকম্পে স্থাপনাটি ক্ষতিগ্রস্তও হয়। পরে অবশ্য সেটি সংস্কার করা হয়। স্থাপনাটি দেখতে বর্তমানে বছরে অন্তত আড়াই লাখ মানুষ যায়।
গড়ে প্রতিদিন ২০ হাজারের বেশি। এই দর্শনার্থীদের বেশির ভাগ বিভিন্ন দেশের পর্যটক। স্থানীয়রা জানান, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর—এই দুই মাস চমৎকার আবহাওয়া থাকায় সর্বাধিক পর্যটক কলোসিয়ামটি পরিদর্শনে আসেন। এই সময়টায় প্রতিদিন গড়ে ৩০ থেকে ৪০ হাজার দর্শনার্থী স্থাপনাটি পরিদর্শনে আসেন। প্রবাসী বাংলাদেশিরা জানান, একসময় হিংস্র খেলা দেখে ইতালীয়রা আনন্দ পেলেও বর্তমানে তাঁরা ভীষণ মানবিক।
গত ১৮ অক্টোবর কলোসিয়ামটি পরিদর্শনের সুযোগ মেলে। সেখানে গিয়ে দেখা গেছে বিভিন্ন দেশের পর্যটকরা টিকিট কেটে লাইন ধরে ভেতরে প্রবেশ করছেন। তারপর ঘুরে ঘুরে দেখছেন বিশাল আকৃতির কলোসিয়ামের গঠন কৌশল। রোমে এরই মধ্যে শীত পড়া শুরু হয়েছে। হালকা এই শীতের মিষ্টি রোদে দাঁড়িয়ে পর্যটকরা ছবি ছবি তুলছেন, গল্প করছেন। সেখানে কজন বাংলাদেশিরও দেখা পাওয়া গেল। অবশ্য তাঁরা রোমপ্রবাসী। কলোসিয়ামটির ভেতরে-বাইরে দর্শনার্থীদের ভিড় দেখার মতো।
কলোসিয়ামের ইতিহাস : রোম সাম্রাজ্যের সম্রাটদের একজন ছিলেন নিরো। তিনি ছিলেন প্রবলভাবে ক্ষমতালোভী। সিংহাসনে বসার ক্ষেত্রে তাঁর আপন ভাই ব্রিটানিকাস বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেন—এই অনুমান থেকে তিনি তাঁর ভাইকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করেন। পরে তিনি ঝামেলায় জড়িয়ে আপন মাকেও হত্যা করেন। কিন্তু তাঁর অত্যাচারী শাসনে রোমের সিনেট এক পর্যায়ে তাঁকে জনগণের শক্র হিসেবে আখ্যায়িত করলে তিনি প্রাসাদ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। মাত্র ৩০ বছর বয়সে আত্মহননে তাঁর জীবনাবসান ঘটে। সম্রাট নিরোর শাসনামলে তীব্র জনরোষ থেকে বেশ কটি গৃহযুদ্ধ বাধে। নানা চড়াই-উতরাই পাড়ি দিয়ে শেষ পর্যন্ত ভেসপাসিয়ান নামে এক ব্যক্তি রোম সাম্রাজ্য শাসনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সম্রাট নিরোর পরিণতি থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন সম্রাট ভেসপাসিয়ান রোমান জনগণের সন্তুষ্টি অর্জন ও সাম্রাজ্যের হারানো খ্যাতি ফিরিয়ে আনতে বেশ কিছু স্থাপনা তৈরির ঘোষণা দেন।
এসবের মধ্যে একটি ছিল এমন একটি বিনোদন স্থান তৈরি করা, যেখানে হাজার হাজার মানুষ একত্রে উপভোগ করতে পারবে। সম্রাট নিরোর তৈরি ‘গোল্ডেন প্যালেস’-এর সামনে বিশাল জায়গাজুড়ে বাগান ও নহর ছিল। সোনালি প্রাসাদের সামনে বাগানের জায়গাটিই প্রস্তাবিত কলোসিয়াম তৈরির স্থান হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। এরপর এক হাজার ৯৫৩ বছর আগে কলোসিয়ামের নির্মাণকাজ শুরু হয়। স্থাপনাটিতে প্রবেশের জন্য ৮০টি দরজা নির্মাণ করা হয়। এর মধ্যে ৭৬টি দরজা দিয়ে সাধারণ মানুষ প্রবেশ করতেন। বাকি চারটি দরজার মধ্যে দুটি ছিল সম্রাটের জন্য সংরক্ষিত, একটি দিয়ে বিজয়ী সৈন্যরা কলোসিয়াম ত্যাগ করতেন, অন্যটি দিয়ে হিংস্র পশুর মৃতদেহ কিংবা পরাজিত বা নিহত সৈন্যদের লাশ সরিয়ে ফেলা হতো।
সম্রাট ভেসপাসিয়ানের সময় নির্মাণকাজ শুরু হলেও তাঁর সন্তান সম্রাট টিটাসের সময় নির্মাণকাজ শেষ হয়। টানা ১০০ দিন বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজনের মধ্য দিয়ে এই স্থাপনাটির রাজকীয় উদ্বোধন করা হয়।
কলোসিয়ামের সামনে সম্রাট নিরোর একটি মূর্তি প্রায় ৪০০ বছর টিকে ছিল। কলোসিয়ামের জন্য হিংস্র পশু আনা হতো আফ্রিকা থেকে। গ্ল্যাডিয়েটরদের সামনে হিংস্র পশু, যেমন—লেপার্ড, গন্ডার, সিংহ কিংবা হাতি ছেড়ে দেওয়া হতো। যাঁরা এসব হিংস্র পশুর আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারতেন, তাঁরা সমাজে বীরের মর্যাদা পেতেন।
মানুষের রুচি ও সময়ের পরিবর্তনের ফলে সম্রাট অনারিয়াস কলোসিয়ামটি বন্ধ ঘোষণা করেন। ইতালিতে রেনেসাঁ শুরু হলে এটি আবার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। পর্যটকরা ইতালির বিভিন্ন স্থাপনা পরিদর্শনের পাশাপাশি এই কলোসিয়ামটিও পরিদর্শন করেন। ইতালির বিভিন্ন সময়কার সরকার বিশ্ব ঐতিহ্যের এই স্থাপনাটি সংরক্ষণে রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যোগ নেয়। ১৯৯০ সালে এটিকে সংস্কারের মাধ্যমে আরো দর্শনীয় করে তোলা হয়। এটি বিশ্বের নতুন সপ্তাশ্চর্যের একটি হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
যেভাবে যাবেন : রোম শহরে মেট্রো রেলে চলাচল সবচেয়ে সহজ। বাংলাদেশ থেকে উড়োজাহাজে রোমের লিউনার্দো দ্য ভিঞ্চি এয়ারপোর্ট (এফসিও) থেকে প্রথমে বাসে থারমিনি এলাকায় যেতে পারেন। খরচ হবে ৯ ইউরো। ট্যাক্সিতে গেলে ৫০ ইউরো। থারমিনি থেকে দেড় ইউরো দিয়ে মেট্রো রেলে সহজে কলোসিয়াম স্টেশন বা পাশের চিরকু মাছিমু স্টেশনে নেমে পৌঁছে যাওয়া যায় ঐতিহাসিক স্থাপনায়। কলোসিয়ামের ভেতরে প্রবেশ করতে ১৬ ইউরো দিয়ে টিকিট কাটতে হয়। তবে ১৮ বছরের নিচে শিশুদের ফ্রি প্রবেশের সুযোগ রয়েছে।








