মুসলিম ইতিহাসের দানবীর নারীরা
মানবকল্যাণে আত্মনিয়োগ করা ইসলামের মৌলিক শিক্ষাগুলোর একটি। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘মানুষের ভেতর সে-ই আল্লাহর অধিক প্রিয় যে মানুষের অধিক উপকার করে।’ (তাবারানি, হাদিস : ১৩৬৪৬)
এ জন্য ইসলামের সূচনাকাল থেকে মুসলিমরা মানবকল্যাণে নিজেদের জীবন ও সম্পদ উৎসর্গ করে আসছে। মুসলিম সমাজে জনকল্যাণের একটি স্থায়ী বন্দোবস্ত হচ্ছে ওয়াক্ফ। ওয়াক্ফর মাধ্যমে মুসলিমরা দ্বিন ও মানুষের কল্যাণে স্থাবর সম্পদ চিরস্থায়ীভাবে দান করে থাকে। শরিয়ত ওয়াক্ফকে সদকায়ে জারিয়ার (এমন দান, যার সওয়াব চলমান থাকে) মর্যাদা দান করেছে। স্থাবর সম্পদ ওয়াক্ফ করার ক্ষেত্রে পুরুষের মতো নারীরাও ছিল অগ্রগামী। মুসলিম নারীদের বদান্যতায় মুসলিম ইতিহাসের অনেক বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে।
যেমন—ফাতেমা আল ফিহরির অর্থায়নে মরক্কোর কারাউইন বিশ্ববিদ্যালয় এবং শাহজাদি ফাতেমা ইসমাইলের অর্থায়নে মিসরের কায়রো বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।
কল্যাণমূলক কাজে নারীদের অংশগ্রহণ
জনকল্যাণমূলক কাজে মুসলিম নারীদের অংশগ্রহণের সূচনা হয়েছিল উম্মাহাতুল মুমিনিনদের মাধ্যমে। যার পরম্পরা আজ পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে। শাসনকালের বিচারে আইয়ুবীয় রাজবংশের নারীরা ওয়াক্ফ বা স্থায়ী দানে সবচেয়ে অগ্রগামী ছিলেন।
তাঁদের পরে মামলুক ও উসমানীয় রাজবংশের নারীরা সম্পদ ওয়াক্ফ করার ক্ষেত্রে অগ্রগামী ছিলেন। তবে মুসলিম ইতিহাসের এমন কোনো মুসলিম রাজবংশের সন্ধান পাওয়া যাবে না, যার নারী সদস্যরা ওয়াক্ফ তথা জনকল্যাণে সম্পদ দান করেননি। আইয়ুবীয় শাসনামলে মানুষের দানশীলতার ব্যাপারে ঐতিহাসিক ইবনে জুবায়ের বলেন, ‘দামেস্ক এমন এক শহর, ওয়াক্ফ যেন তার সবকিছুকে গ্রাস করে নেবে।’ (রিহলাতু ইবনে জুবায়ের, পৃষ্ঠা-২৭৭)
মুসলিম ইতিহাসে দানবীর নারীরা
মুসলিম ইতিহাসে কয়েকজন বিখ্যাত দানবীর নারীর পরিচয় তুলে ধরা হলো, যাঁরা জনকল্যাণে তাঁদের সম্পদ ওয়াক্ফ করেছিলেন।
১. নবীজি (সা.)-এর স্ত্রীরা : মহানবী (সা.)-এর সম্মানিত স্ত্রীদের ভেতর আয়েশা (রা.) দুটি ছিন্নমূল পরিবারের জন্য ভূমি ওয়াক্ফ করেন, উম্মে হাবিবা (রা.) মুক্তিপ্রাপ্ত দাসদের জন্য এবং সাফিয়্যা (রা.) বনি আবদানের জন্য সম্পদ ওয়াক্ফ করেন।এ ছাড়া উম্মে সালামা (রা.)-ও মানুষের কল্যাণে সম্পদ ওয়াক্ফ করেছিলেন। (আহকামুল আওয়াক, পৃষ্ঠা-১৩ ও ১৪)
২. নারী সাহাবি : মহানবী (সা.)-এর সম্মানিত নারী সাহাবিরাও জনকল্যাণে সম্পদ ওয়াক্ফ করেছিলেন। যেমন—আসমা বিনতে আবু বকর (রা.) তাঁর বাড়িটি এই শর্তে সদকা করে দেন যে তা বিক্রি করা হবে না, তা দান করা হবে না এবং তা উত্তরাধিকার সূত্রে কেউ লাভও করবে না। (আহকামুল আওয়াক, পৃষ্ঠা-১৩)
৩. রানি জুবায়দা : আব্বাসীয় খলিফা হারুনুর রশিদের স্ত্রী জুবায়দা বিনতে মানসুর তাঁর দানশীলতার জন্য কিংবদন্তি হয়ে আছেন। তিনি মক্কা নগরীর পানির সংকট দূর করতে দীর্ঘ ৪০ মাইল খাল খনন করেন। এর মাধ্যমে তিনি ওয়াদি নাখলা ও ওয়াদি হুনাইফা থেকে মক্কা, মিনা, মুজদালিফা ও আরাফায় পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করেন। এ ছাড়া তিনি বাগদাদ থেকে মক্কা পর্যন্ত রাস্তায় হাজিদের বিশ্রামের জন্য অসংখ্য সরাইখানা ও পানির কূপ খনন করেন।
৪. দাইফা খাতুন : দাইফা খাতুন (রহ.) ছিলেন মিসরের আইয়ুবীয় শাসক সুলতান আল আদিলের কন্যা এবং আলেপ্পোর আমির জাহের আল গাজির স্ত্রী। তিনি আলেপ্পোর সর্বপ্রাচীন ধমীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘মাদরাসাতুল ফিরদাউস’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১২৩৫ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত মাদরাসাটি এখনো পাঠদান কার্যক্রম অব্যাহত আছে। তিনি এই প্রতিষ্ঠানের জন্য বিপুল পরিমাণ সম্পদ ওয়াক্ফ করেন।
৫. হুররম সুলতান : তিনি ছিলেন সুলতান সুলাইমানের স্ত্রী। তুর্কিরা তাঁকে একজন পুণ্যবান নারী ও প্রজাদের সেবক হিসেবেই স্মরণ করে। তিনি ইস্তাম্বুলে একটি মসজিদ, দুটি মাদরাসা এবং নারীদের জন্য একটি বিশেষায়িত হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন, যা বর্তমানে হাসেকি সুলতান কমপ্লেক্স নামে পরিচিত। হুররেম সুলতান ১৫৫২ খ্রিস্টাব্দে জেরুজালেমে ‘হাসেকি সুলতান ইমারেত’ প্রতিষ্ঠা করেন। এটা মূলত একটি লঙ্গরখানা, যেখান থেকে প্রতিদিন ৫০০ অসহায় ব্যক্তিকে খাবার দেওয়া হতো। তিনি এই কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বিপুল পরিমাণ সম্পদও ওয়াক্ফ করেন। মক্কায়ও তিনি অনুরূপ একটি লঙ্গরখানা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ফিলিস্তিনে প্রতিষ্ঠিত হাসেকি সুলতান ইমারেতের অধীনে একটি মাদরাসা, একটি মসজিদ, আস্তাবল ও একটি বিশ্রামাগারও পরিচালিত হতো। ফিলিস্তিনে তাঁর প্রতিষ্ঠিত লঙ্গরখানা এখনো টিকে আছে এবং প্রতিদিন অভুক্ত মানুষ সেখান থেকে খাবার গ্রহণ করছে।
৬. রাবেয়া খাতুন : রাবেয়া খাতুন বিনতে আইয়ুব (রহ.) ছিলেন আইয়ুবীয় রাজবংশের বিখ্যাত রাজকন্যা। তিনি বহু কল্যাণমুখী কাজ করেছেন। তিনি কাসিয়ুনে মাদরাসাতুস সাহিবাহ প্রতিষ্ঠা করেন এবং মাদরাসা পরিচালনার জন্য বিপুল পরিমাণ সম্পদ ওয়াক্ফ করেন। সিরিয়ায় মাদরাসাটি এখনো টিকে আছে। রাবেয়া বিনতে আইয়ুব (রহ.) শুধু হাম্বলি মাজহাবের অনুসারীদের জন্য মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেননি, বরং তিনি শাফেয়ি ও হানাফি মাজহাবের অনুসারীদের জন্য পৃথক মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন।
৭. তিজকার খাতুন : রাজকুমারী তিজকার খাতুন ছিলেন সুলতান রোকনুদ্দিন বাইবার্সের কন্যা। যিনি তাঁর ধন-সম্পদ সাধারণ মানুষের কল্যাণে উৎসর্গ করেছিলেন। ৬৮৪ হিজরিতে সুলতান বাইবার্স ইন্তেকাল করার পর রাজকুমারী তিজকার খাতুন জনকল্যাণে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর জনকল্যাণমূলক কাজগুলোর শীর্ষে ছিল নিরাশ্রয়, অসহায় ও বৃদ্ধা নারীদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করা। তারা তালাকপ্রাপ্তা হওয়া, অভিভাবক বা স্বামীর নিরুদ্দেশ ও মৃত্যু—যে কারণে পরিবারহীন হোক না কেন, এই আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই পেত। ঐতিহাসিকরা তাঁর আশ্রয়কেন্দ্রকে ‘রিবাত’ নামে উল্লেখ করেছেন। নারীদের আশ্রয়কেন্দ্র পরিচালনার জন্য বিপুল পরিমাণ সম্পদ ওয়াক্ফ করেন তিজকার খাতুন। আর তিনি তা করেছিলেন যেন তাঁর মৃত্যুর পরও আশ্রয়কেন্দ্রটি যথানিয়মে পরিচালিত হয় এবং আশ্রয় নেওয়া নারীরা আশ্রয়হীন হয়ে না পড়ে।
৮. আসমা বিনতে মোস্তফা : তিনি ছিলেন খোরাসানের একজন আল্লাহভীরু ও দানবীর নারী। তিনি বিপুল পরিমাণ সম্পদ মানবকল্যাণে ব্যয় করেন এবং কল্যাণমূলক কাজের জন্য ওয়াক্ফ করে যান। তাঁর ওয়াক্ফকৃত সম্পত্তির মধ্যে বুস্তানে শোকর ও বুস্তানেন উম্মে ইনাব বিখ্যাত। এ ছাড়া তিনি বিপুল পরিমাণ কৃষিজমি ওয়াক্ফ করে যান। তিনি শর্তারোপ করেন এসব ভূমি থেকে উৎপাদিত ফসল থেকে ২৫০ কিরশ (প্রাচীন যুগের একটি পরিমাপ) বাগদাদের দরিদ্র ও অসহায় মানুষের জন্য ব্যয় করা হবে।
তথ্যঋণ : ইসলাম অনলাইন ডটনেট, ইসলামওয়ে ডটনেট ও আল মুসলিম ডটনেট







