জাদুকরী জেব্রা মাছের গল্প
আমার সাবেক এক জুনিয়র কলিগ ড. শওকত আহমেদ সম্প্রতি জাপানের সিজুওকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করে দেশে ফিরেছেন। তাঁর সঙ্গে কথা হচ্ছিল পিএইচডি গবেষণা নিয়ে। তিনি জানালেন, ছোট মাছকে হরমোন ইনজেকশন না দিয়ে খাবারের সঙ্গে স্টেরয়েড ব্যবহার করে কিভাবে মাছের প্রজনন ঘটানো যায়, এটাই ছিল তাঁর গবেষণার মূল বিষয়বস্তু। এতে হ্যাচারিতে খরচ ও সময়ও বাঁচবে এবং একই সঙ্গে শত শত ছোট মাছকে ইনজেকশন দেওয়ার ঝক্কি-ঝামেলা থেকেও রেহাই মিলবে।
এই গবেষণায় মডেল প্রজাতি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে জেব্রা মাছ (Danio rerio)। আশা করি তাঁর এই গবেষণা অভিজ্ঞতা দেশীয় ছোট মাছ সুরক্ষা ও উন্নয়নে তিনি কাজে লাগাবেন। কিন্তু আমার কাছে যে বিষয়টি বিস্ময়কর মনে হয়, ক্ষুদ্রকায় জেব্রা মাছ বৈজ্ঞানিক গবেষণায় কিভাবে ক্রমেই বিস্তার লাভ করছে এবং মডেল প্রজাতি হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছে। উল্লেখ্য, ষাটের দশকে একজন হাংগেরীয় মলিকুলার বায়োলজিস্ট George Streisinger বিশ্বে প্রথম জেব্রা মাছের ক্লোন করেন এবং গবেষণাগারে জেব্রা মাছ ব্যবহার শুরু করেন।
কালের পরিক্রমায় জেনেটিকস গবেষণা, ওষুধের কার্যকারিতা পরীক্ষণ, ইমমুনোলজি, টক্সিকোলজি ইত্যাদি নানান ক্ষেত্রে বর্তমানে বিশ্বের সহস্রাধিক গবেষণাগারে জেব্রা মাছ ব্যবহৃত হচ্ছে বলে জানা যায়। জেব্রা মাছ যেন এক জাদুকরী প্রাণী। শুধু তাই নয়, এই মাছের নামানুসারে ‘জেব্রা ফিশ’ নামে আন্তর্জাতিক মানের একটি জার্নাল রয়েছে যেখানে শুধু জেব্রা মাছের ওপর পরিচালিত গবেষণা ফলাফল প্রকাশিত হয়। জাদুকরী এই জেব্রা মাছ নিয়ে আজ আমরা এখানে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করতে চাই।
জেব্রা মাছ সাইপ্রিনিডি (Cyprinidae) পরিবারের অন্তর্ভুক্ত মিঠাপানির একটি ছোট প্রজাতির মাছ। এটি লম্বায় সর্বোচ্চ সাড়ে ৪ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। এই মাছকে কোনো কোনো এলাকায় ‘অঞ্জু মাছ’ নামে ডাকা হয়। তবে দেশ-বিদেশে জেব্রা ফিশ নামেই এই মাছটি অধিক পরিচিত। এদের দেহ লম্বা এবং পার্শ্বীয়ভাবে সামান্য চাপা।
ওপরের চোয়াল নিচের চোয়ালের চেয়ে সামান্য বড় এবং মুখে দুই জোড়া স্পর্শী আছে। এদের দেহের উভয় পার্শ্বে লম্বালম্বি ডোরা আছে, যদিও বর্তমানে এদের দাগহীন কিছু কিছু স্ট্রেইন গবেষণাগারে দেখতে পাওয়া যায়। জেব্রা মাছ সর্বভুক শ্রেণির প্রাণী। এরা প্লাংকটন, জলজকীট, পোকামাকড়ের শুককীট, ক্রাশটেসিয়ান্স ইত্যাদি খেয়ে জীবনধারণ করে। এদের আয়ুষ্কাল সাধারণত দুই থেকে তিন বছর; তবে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে। তিন মাস বয়সেই এরা পরিপক্ব হয় এবং বছরজুড়েই, এমনকি পর্যাপ্ত খাবার ও অনুকূল তাপমাত্রা পেলে প্রায় প্রতিদিনই প্রজনন করে থাকে। এ জন্য জেব্রা মাছকে Asynchronous spawner বলা হয়। তবে বর্ষাকাল এদের সর্বোচ্চ প্রজনকাল। পরিপক্ব পুরুষ জেব্রা স্ত্রী জেব্রার চেয়ে দৈর্ঘ্যে লম্বা এবং অধিক বর্ণিল হয়। প্রজননকালে স্ত্রী জেব্রা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলজ উদ্ভিদের ওপর ডিম ছাড়ে। প্রতিবারে ২০০ থেকে ৩০০টি ডিম দেয় এবং ডিম নিষিক্ত হওয়ার দৃই-তিন দিনের মধ্যে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়।
জেব্রা মাছ বৈজ্ঞানিক গবেষণায় সারা বিশ্বে মডেল প্রজাতি হিসেবে সমাদৃত। আগেই বলেছি, এটি ছোট প্রজাতির মাছ হয়েও কিভাবে বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞানীদের নজর কাড়ল এ নিয়ে কৌতূহলের যেন শেষ নেই। এর অন্যতম প্রধান কারণ হলো জেব্রা মাছের বছরব্যাপী প্রজনন ও সহজ প্রাপ্যতা এবং স্বচ্ছ ডিম ও দেহে ভ্রূণের বিকশিত হওয়া, যা বাইরে থেকে দেখতে পাওয়া যায়। ফলে জীববিজ্ঞানের বিভিন্ন গবেষণায় জেব্রা মাছের দেহে ট্রিটমেন্ট ভিত্তিক ফলাফল সহজেই পর্যবেক্ষণ করা যায়। তা ছাড়া, গবেষণায় ইঁদুর কিংবা বানর ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আইনকানুন অনুসরণ ও বিধি-নিষেধের মধ্য দিয়ে যেতে হয়; জেব্রা মাছের ক্ষেত্রে তা লাগে না। সর্বোপরি, জেব্রা মাছের জিন মানবদেহের ৭০ শতাংশ জিনের সঙ্গে সাদৃশ্য। এই কারণে বিজ্ঞানীরা জেব্রা মাছের বিভিন্ন জিনের কার্যকারিতা ও অভিজ্ঞতাকে মানবদেহে ব্যবহার করতে চান।
জেব্রা মাছের মস্তিষ্ক, হৃৎপিণ্ড, লিভার, অগ্ন্যাশয় এবং অন্যান্য অঙ্গ কোনো কারণে ক্ষতবিক্ষত হলে নতুন করে এরা ক্ষতস্থান পূরণ করতে পারে, যা মানুষ পারে না। এর পেছনে দায়ী জেব্রা মাছের এক ধরনের বিশেষ জিন। বর্তমান বিশ্বে হৃদরোগের মৃত্যুঝুঁকি কমাতে গবেষণায় জেব্রা মাছ মডেল প্রজাতি হিসেবে ব্যবহারে সফলতা পাওয়া গেছে। জার্মানির ফ্রাংকফুর্টের গোথে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, একটি বিশেষ জিন কিভাবে জেব্রা মাছের ক্ষতবিক্ষত হৃৎপিণ্ডকে পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠতে সাহায্য করে। এই জিনটির নাম Connective Tissue Growth Factor (CTGF)| মানবদেহের হাজার হাজার জিনের মধ্যে এই জিনটিও বিদ্যমান। তবুও মানবদেহে হৃৎপিণ্ড ক্ষতবিক্ষত (এমআই) হলে এই জিনটি জেব্রা মাছের মতো কাজ করতে পারে না এবং হৃৎপিণ্ডের মাংসপেশির ক্ষতি থেকেই যায়। বিজ্ঞানীরা গবেষণায় দেখেছেন, জেব্রা মাছের CTGF জিনের সক্রিয়তার কারণেই জেব্রার দেহে এক ধরনের প্রোটিন তৈরি হয়, যা CTGF প্রোটিন নামে পরিচিত। যেসব কোষের সাহায্যে হৃদযন্ত্রের সংকোচন ও প্রসারণ হয় সেসব কোষের দ্রুত বিভাজনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এই ঈঞঋে প্রোটিন। দ্রুত বিভাজনের ফলে নতুন নতুন কোষ এগিয়ে যায় ক্ষতস্থানের দিকে এবং এভাবেই ক্ষতস্থান পূরণ হয়ে যায়। জেব্রা মাছ দুই মাসের মধ্যেই নতুন নতুন কোষে ক্ষতস্থান পূরণ করতে পারে। মানুষের বেলায় তা হয় না। এ বিষয়ে জেব্রা মাছ থেকে আমরা কী শিক্ষা নেব, ভবিষ্যৎই তা বলে দেবে।







