গল্প: লাল টি-শার্ট
দৈনিক সিলেট ডট কম
সৈয়দ সাকিব আহমদ: ০১ তারিখ আমার কাজিনের বিয়ে,আমার একমাত্র চাচাতো বোন। আজ ২৮ তারিখ, আর মাত্র ০৩ দিন বাকি। যেভাবেই হোক আজ বাড়িতে যেতেই হবে। বাবা-মা
কালকে যাবেন, বাবা একটা জরুরী কাজে চিটাগাং গেছেন, আজ রাতেই ফিরবেন । এদিকে মা আমাকে একা ছাড়তে নারাজ। বহু কষ্টে মাকে রাজি করালাম। ঘুম থেকে উঠেই তন্ময় কে খবরটা জানালাম,ও যেতে রাজি হচ্ছিলো না, অনেক কষ্টে ওকে রাজি করালাম। তন্ময় আমার বন্ধু, আমাদের ১১ বছরের বন্ধুত্ব। এখন সবকিছুই রেডি,ট্রেনের টিকেট পাইনি,তাই বাসে যেতে হচ্ছে।
তন্ময়ের বাবাই সবকিছু ম্যানেজ করে দিলেন, ৫:০০ টায় বাস। যথারীতি বাসে উঠলাম, মাকে ফোন করতে যাবো এমন সময় দেখি পকেটে মোবাইল টা নেই, মনে হলো বাসায়
ফেলে রেখে এসেছি…!! তন্ময়ের ফোনে Balance নেই, পিছনের সিটে এক আঙ্কেল
বসেছিলেন,ওনার সাথে ৭-৮ বছরের একটি ছোট মেয়ে। আঙ্কেলের কাছে থেকে মোবাইলটা চেয়ে নিয়ে মাকে ফোন করলাম, বললাম কালকে যেনো আসতে মোবাইলটা নিয়ে
আসেন।
প্রায় ২ ঘণ্টা বাসে বসে থাকার পর আমার তন্দ্রা এসেগিয়েছিলো,তন্ময় গান শুনছে। ঝগড়া করে জানালার পাশের সিটটা দখল করে বসে আছে। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ একটা বিকট শব্দ
হলো,সামনের সিটের সাথে প্রচণ্ড একটা ধাক্কা খেলাম,জানালার কাচের টুকরো বুকে এসে লাগলো,তন্ময় সামনের দিকে ছিটকে পড়লো,ওর দেহটা রক্তাক্ত, আমার মাথায় এবং
বুকে প্রচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছিলো, এর পরে আর কিছুই মনে নেই…. জ্ঞান ফেরার পর বুঝতে পারলাম আমি হসপিটালের বেডে শুয়ে আছি,পাশের বেডেই তন্ময় যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলো। বাইরে অনেক পুলিশ এবং মিডিয়ার লোকজন,… আমাদের বাসটার নাকি এক্সিডেন্ট
হয়েছিলো,দুটি ট্রাক দুদিক থেকে চাপা দিয়েছিলো বাসটাকে।
অনেক লোক আহত হয়েছে,ডক্টররা ইতিমধ্যে ৭ জনকে মৃত ঘোষণা করেছেন, অনেকের অবস্থাই আশংকাজনক। ওই আঙ্কেলও মারাগেছেন, সাথে থাকা মেয়েটার অবস্থাও আশংকাজনক। আমার মাথায় এবং বুকে প্রচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছিল। আমার লাল টি-শার্ট টাতে রক্ত লেগে আরো লাল হয়েগিয়েছিলো.. কিছুক্ষণ পর আমাদের ICU তে নিয়ে
যাওয়া হলো,বাইরে মা-বাবা এসেছেন, অনেক কান্নাকাটি করছেন,
কিন্তু ডক্টর এখানে কাউকেই allow করছেন না। ডক্টর তন্ময় কে মৃত ঘোষণা করেছেন,
আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না ‘ তন্ময় মারা গেছে !! ‘ তখন খুবই খারাপ লাগছিলো, অনেক কান্না পাচ্চিলো আমার, কিন্তু আমার কোনো শক্তি ছিলোনা। তন্ময়ের লাশটা নিয়ে যাওয়া হলো,আমি ওকে শেষবারের মতো দেখতেও পারলাম না,ওর কাছে ক্ষমা চাইতে পারলাম না,আজ আমার জন্যই তন্ময় বেচে নেই,আমি যদি ওকে না নিয়ে আসতাম তাহলে হয়তো তন্ময় কে এভাবে অকালে মরতে হতোনা… এখন আমি একা,খুব ভয় করছে,চোখের
সামনে স্পষ্ট মৃত্যু দেখতে পাচ্ছিলাম, হঠাৎ নিজেকে খুব হাল্কা লাগলো,সমস্ত যন্ত্রণা থেমে
গেলো,মাথা আর বুকের যন্ত্রণাটা এখন আর নেই,খুবই ভালো লাগছে এখন… কিছুক্ষণ পর ডক্টর এসে চেক-আপ করে আমার মুখটা ঢেকে দিলেন, বুঝলাম আমি আর বেচে নেই।
বাইরে থেকে তখন কান্নার শব্দ আসছিলো, কন্ঠটা খুবই চেনাচেনা লাগলো,বুঝতে বাকি রইলো না ওনি আমার মা… এরপর আমার লাশটা ICU থেকে বের
করা হলো,মা আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন।
তন্ময়ের লাশটা ওর বাবা-মা ওর বাড়িতে নিয়ে গেছেন, হসপিটালের সব কার্যক্রম শেষ করে
এ্যাম্বুলেন্সে করে আমাকে আমার গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হলো। আমার মনে আছে, প্রায় ১ বছর আগে বাড়িতে এসেছিলাম গত ঈদে । আমার লাশটাকে গোসল দেওয়া
হলো,সাদা কাফনের কাপড় পরিয়ে দেয়া হলো আমাকে। একে একে করে সবাই শেষ দেখা
দেখে গেলো,আমার অনেক বন্ধুরাও এসেছে, মা আমাকে এবার দেখে অজ্ঞান হয়ে পড়লেন, ওনাকে ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো জানাযার নামাজের পরে আমাকে কবরের দিকে নিয়ে যাওয়া হলো, দেখলাম, আমার দাদির কবরের পাশেই আমার কবর খুড়া হয়েছে..বাবা এবং চাচ্চু আমাকে কবরে শুয়ালেন,এর পরে কবর দিয়ে দিলেন, আমি তখন ও সবকিছু দেখতে পারছিলাম !! একে একে করে সবাই চলে গেলো,বাবা রইলেন.. অনেক কান্না
করলেন, চাচ্চু এসে বাবাকে নিয়ে গেলেন। বাবা আবার মধ্যরাতে আসলেন,
আমাকে দুয়া করলেন, এক দৃষ্টিতে অনেক্ষণ আমার কবরের দিকে
তাকিয়ে ছিলেন, ফজরের আযান হতেই চলে গেলেন… এভাবে বাবা প্রতিদিন রাতে আসতেন, এক দৃষ্টিতে আমার কবরের দিকে তাকিয়ে থাকতেন, আবার চলে যেতেন। আমার এখন কোনো কষ্ট নেই,তন্ময়েরও দেখা পেয়েছি, ওর কাছে ক্ষমাও
চেয়েনিয়েছি আমি… এখন শুধু আমার মাকে একটাই কথা
বলতে ইচ্ছা করে ” মা, তুমি আর আমার জন্যে কেদোঁনা,আমি এখানে
ভালোই আছি। আর বাবাকে প্রতিদিন রাতে এখানে আসতে দিও না। আমার লাল টি-শার্ট টা রেখো মা,তন্ময়ের দেয়া ঘড়িটাও রেখো মা। তোমরা সবাই ভালো থেকো মা ”
গল্পটা কাল্পনিক, আমার নিজের লেখা,কিন্তু আমাদের দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটের সাথে গল্পটা অনেক মানানসই। প্রতিদিনই সড়ক দুর্ঘটনার কারণে এভাবে অনেক তন্ময়-সাকিব রা প্রাণ হারাচ্ছে !!
আমাদের সামান্য একটু সচেতনতাই পারে সড়ক দুর্ঘটনা থেকে আমাদের রক্ষা করতে,সকলেই সম্মেলিত প্রচেষ্টাই পারে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা রুধ করতে… তাই আসুন আমরা সবাই এ ব্যাপারে সচেতন হই এবং অন্যকে সচেতন করে
তোলি।
লেখক: সিলেট সরকারি কলেজের একাদশ শ্রেনীর শিক্ষার্থী