জিডিপি-বেকারত্ব-কর্মসংস্থান

দৈনিক সিলেট ডট কম
আনু মুহাম্মদ : বিশ্বব্যাংকের যে মানদণ্ড ব্যবহার করে দারিদ্র্য পরিমাপ করা হয়, তা মানদণ্ড হিসেবে খুবই দুর্বল, খণ্ডিত এবং সামান্য পরিবর্তন করলেই দারিদ্র্যরেখার নিচের মানুষের অনুপাত তাৎপর্যপূর্ণভাবে বেড়ে যায়।
বাংলাদেশের ওপর বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুসারে, যদি আমরা দৈনিক মাথাপিছু আয় ১ দশমিক ৯ ডলারকে দারিদ্র্যরেখা বলে ধরি, তাহলে দারিদ্র্যে থাকা মানুষের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ। কিন্তু দৈনিক মাথাপিছু আয়কে বাড়িয়ে ১ দশমিক ২৫ ডলার করলে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৩ দশমিক ৩ শতাংশে, আর ২ ডলারের ভিত্তিতে করলেই এটা বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ৭৫ দশমিক ৮ শতাংশে। নিজেদের করা দারিদ্র্যরেখা পরিমাপের সীমাবদ্ধতা স্বীকার করে নিলেও এই মাপকাঠির ওপর ভিত্তি করেই বিশ্বব্যাংক সিদ্ধান্ত নিয়ে চলেছে।
একটি সমীক্ষা দেখাচ্ছে যে, গ্রামীণ বাংলাদেশের ৫৭ শতাংশ পরিবার ভূমিহীন আর গ্রামীণ জনসংখ্যার সব মিলিয়ে ৮২ শতাংশকে বলা যায় সম্পদের মালিকানার দিক থেকে দরিদ্র। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ দারিদ্র্য বিমোচনবিষয়ক তৎপরতা, বিশেষত ক্ষুদ্রঋণ ও এনজিও কর্মসূচি নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচিত। কিন্তু সাফল্যের তুলনামূলক অবস্থানে দেখা যাচ্ছে ভিন্ন চিত্র। সরকারি নথিতেও স্বীকার করা হয়েছে যে, গোটা দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে দারিদ্র্যরেখার নিচে বাস করা মানুষের অনুপাতে বাংলাদেশ এখনও শীর্ষস্থানে। যখন সরকারি দারিদ্র্যরেখার নিচে বাংলাদেশে ৩১.৫ শতাংশ মানুষ, তখন প্রতিবেশী দেশগুলোর অনুপাত নিম্নরূপ : ভারতে ২৯.৮ শতাংশ, নেপালে ২৫.২ শতাংশ, ভুটানে ২৩.২ শতাংশ, পাকিস্তানে ২২.৩ শতাংশ আর শ্রীলংকায় ৮.৯ শতাংশ। ক্ষুদ্রঋণ আর এনজিওদের ‘ব্র্যান্ড’ বলে খ্যাত দেশ অন্যদের থেকে দারিদ্র্য বিমোচনে কেন এত পিছিয়ে আছে, তার কোনো ব্যাখ্যা মূলধারার অর্থশাস্ত্র থেকে পাওয়া যাচ্ছে না!
উচ্চ দারিদ্র্যসীমার নিচে জনসংখ্যার অনুপাত সর্বশেষ ২৪.৩ শতাংশ দেখালেও আঞ্চলিক বৈষম্যও ব্যাপকভাবে লক্ষণীয়। দারিদ্র্যসীমার নিচে ৩০ শতাংশের কম মানুষ আছে- এ রকম জেলা আছে, আবার ৬০ শতাংশের বেশি এ রকমও জেলা আছে। জাতীয় গড় ২৪ হলেও প্রচলিত দারিদ্র্যসীমার নিচেই কুড়িগ্রামে প্রায় ৭১ শতাংশ মানুষ বাস করে। বস্তুত বাংলাদেশের জিডিপি ও মাথাপিছু আয়ের স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধির পেছনে বড় অবদান হচ্ছে প্রবাসী আয়ের। এ ছাড়া আছে গার্মেন্ট ও কৃষি। অথচ এই তিন ক্ষেত্রে যুক্ত শ্রমজীবী মানুষের আয় এবং জীবনের দুটিই ঝুঁকিপূর্ণ, অনিশ্চিত। জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে তাদের অবদান মুখ্য হলেও এতে তাদের অংশ ক্রমেই কমছে।
প্রাণ প্রকৃতি বিনাশ করে এত যে জিডিপির প্রবৃদ্ধি, চোরাই কোটিপতিদের এত যে জৌলুস, তার একটা বড় যুক্তি কর্মসংস্থান সৃষ্টি। কিন্তু খুব যুক্তিসঙ্গত কারণেই এই প্রবৃদ্ধি সুস্থ মর্যাদাপূর্ণ কর্মসংস্থানের সুযোগ তো নয়ই, অতি সাধারণ কাজের সুযোগও চাহিদা অনুযায়ী বৃদ্ধি করতে পারছে না। কাজের সন্ধানে তাই তরুণদের অসহায়ত্ব আর অস্থিরতা বাড়ছেই। কিছুদিন আগে কোটা সংস্কার আন্দোলন ব্যাপক আকার নিয়েছিল। কাজের খোঁজে তরুণদের হতাশা, ক্ষোভ ও তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকেই।
সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশের বেকারত্বের হার বেশ কম, শিল্পোন্নত দেশগুলো থেকেও কম। সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৬-১৭ অনুযায়ী দেশে বেকারত্বের হার ৪ দশমিক ২ শতাংশ। তারপরও দেখা যাচ্ছে, গত বছরের তুলনায় বেকারের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ২৭ লাখ। কাজ পেতে আগ্রহী কেউ সপ্তাহে এক ঘণ্টা কাজ করলেই তাকে কর্মরত বলে ধরে নেওয়া হয়। সে হিসাবে বরং বলা যায়, বাংলাদেশ এখন পূর্ণ কর্মসংস্থান স্তরে আছে! কারণ বাংলাদেশে প্রকৃতপক্ষে কর্মসন্ধানী সবাই কিছু না কিছু উপার্জনমুখী বা উপার্জন বিকল্প কাজ করে। সাধারণত কর্মসময় ১৫ বছর বয়স থেকে ৬৫ বছর ধরা হলেও বাংলাদেশে একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের কাজ শুরু হয় ৫-৭ বছর থেকেই, আর তা অব্যাহত থাকে (যদি বেঁচে থাকতে পারেন) ৬৫ বছরের পরও। এ দেশে যারা নিজেদের শৈশবকে শৈশব হিসেবে পার করতে পেরেছেন, তারা বিশেষ সুবিধাভোগী। বেকারত্বের এ রকম সংকীর্ণ সংজ্ঞা দিয়ে কর্মসংস্থান মাপা তাই খুবই বিভ্রান্তিকর। তা ছাড়া কর্মঘণ্টা, ধরন, আয়, কাজের নিশ্চয়তা- এগুলোও বিবেচনায় নিতে হবে। ৮ ঘণ্টা কাজ করে বাঁচার মতো মজুরি পাওয়া এখনও অসম্ভব চাওয়া বলেই বিবেচনা করা হয়। বেঁচে থাকতে গেলেও পরিবারের দু-তিন সদস্যের দিনে ১০-১২ ঘণ্টা কাজ করতে হয়।
প্রবাসে বাংলাদেশের এক কোটিরও বেশি নারী-পুরুষ কাজ করেন। তারপরও দেশে কাজের পরিমাণগত ও গুণগত অবস্থা ভালো নয়। কৃষি খাতের অনুপাত কমেছে, কর্মসংস্থানেও। কিন্তু শিল্প কারখানা খাতের অনুপাতের তুলনায় অনেক বেশি বেড়েছে পরিসেবা খাত। সেখানে স্থায়ী নিরাপদ কাজের সুযোগ খুবই কম। তাই অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজ, স্বকর্মসংস্থানেই বেশিরভাগ মানুষের নির্ভরতা। সরকারি সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশে মোট কর্মজীবী মানুষের সংখ্যা ৫ কোটি ৮১ লাখ, এর মধ্যে অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মে নিয়োজিত ৮৭ শতাংশ। মাত্র ১৩ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক কাজে যুক্ত। স্বনিয়োজিত মানুষের সংখ্যাই দুই কোটি ৩৬ লাখ।
এসব ক্ষেত্রে কাজের কোনো স্থিরতা নেই, আয় তুলনামূলকভাবে অনেক কম, নিরাপত্তাও কম। পুলিশ-মাস্তানদের চাঁদা দিয়ে, অনিশ্চয়তা নিয়ে এসব কাজে টিকে থাকা খুবই দুরূহ। তবুও স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষা নিয়েও অনেককে এ ধরনের কাজই খুঁজতে হচ্ছে। দোকান, মোবাইল, ইলেকট্রনিক জিনিসপত্র, মোবাইল ব্যাংকিং, টিউশনি, কোচিং সেন্টার, অনলাইন বিভিন্ন সার্ভিস, কুরিয়ার, পরিবহন, বিক্রয় প্রতিনিধিসহ এজেন্ট হিসেবে কাজ- এগুলোই এখন শিক্ষিত তরুণদের কাজের এলাকা।
অর্থনীতির ধরনের কারণে সারাদেশেই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের আয়তন ক্রমাগত বাড়ছে। ঢাকা তার কেন্দ্র। ঢাকার রিকশা, ছোট দোকান, হকার, নির্মাণ কাজ- এসবই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বিত্তহীন শ্রমজীবী নারী-পুরুষের কাজের ক্ষেত্র। ঢাকার জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার তাই দেশের গড় হারের দ্বিগুণেরও বেশি। প্রায় ৪০ শতাংশই বড়-ছোট বস্তিবাসী। এই দরিদ্র জনগোষ্ঠী সম্পর্কে শহরের বিত্তবান বা মধ্যবিত্তের খুবই অস্বস্তি। অস্বস্তি দূর করতে তাদের উচ্ছেদ অভিযান প্রায়ই চলে। কিন্তু তা স্থায়ী হয় না। কেননা এদের ছাড়া কারও চলে না, শহর অচল হয়ে যায়। কিন্তু এই সদা পরিশ্রমী মানুষদের জীবন ঘিরে থাকে অবৈধ বসতি, অবৈধ গ্যাস, বিদ্যুৎ, অবৈধ পানির অনিশ্চয়তা। তাদের অর্থ দিতে হয় সবটাতেই, হারও বেশি। কিন্তু তা বৈধতা পায় না এবং সে কারণে নিরাপত্তাও পায় না কখনও। অন্যদিকে প্রায় ক্ষেত্রেই মেধা বা যোগ্যতার সঙ্গে কাজ পাওয়ার সম্পর্ক নেই। বহু প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ এখন প্রত্যক্ষভাবে লেনদেন বাণিজ্যের বিষয়। কাজ এখন কিনতে হয়।
অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
সমকাল