সন্তানের সাফল্যে উজ্জ্বল পরিবার
চার ভিন্ন গ্রামে, চার ভিন্ন পরিবারে জন্ম হলেও সংগ্রামের গল্প প্রায় একই। কেউ মায়ের অসুস্থতায় শপিং ব্যাগ সেলাই করেছে, কেউ দিনমজুর বাবার অল্প আয়ে স্বপ্ন বুনেছে। কারও বাবা সংবাদপত্র বিক্রি করে সংসার চালান, আবার কেউ কখনো প্রাইভেট পড়ার সামর্থ্য না রেখেও মনোযোগ আর মেধায় এগিয়েছে। এত প্রতিকূলতার মধ্যেও তারা থেমে থাকেনি।
এবারের এসএসসি পরীক্ষায় তারা প্রত্যেকে জিপিএ–৫ পেয়েছে। সাতক্ষীরা তাজবীহা সুলতানা, সুনামগঞ্জের ফারজানা আক্তার, ফরিদপুরের সামিয়া আক্তার ও কুমিল্লার সাকিবা আক্তারদের স্বপ্ন উচ্চশিক্ষা নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানো।
সেলাইয়ের আয়ে পড়াশোনা
মেয়ের লেখাপড়ার খরচের জন্য কারখানায় শপিং ব্যাগ সেলাইয়ের কাজ নেন গৃহিণী নীলুফা বেগম। কিন্তু হঠাৎ তিনি গুরুত্বর অসুস্থ হয়ে পড়েন। টাকার অভাবে মেয়ের লেখাপড়া বন্ধের উপক্রম হয়। তখন সপ্তম শ্রেণিপড়ুয়া মেয়ে তাজবীহা সুলতানা মায়ের সেই শপিং ব্যাগ সেলাইয়ের কাজ শুরু করে। সময় বের করে প্রতিদিন দেড় থেকে দুই ঘণ্টা শপিং ব্যাগ সেলাই করেও এবারের এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে সে।
তাজবীহাদের বাড়ি একেবারে অজপাড়াগাঁয়ে। সাতক্ষীরা জেলা শহর থেকে ৫২ কিলোমিটার দূরে কালীগঞ্জ উপজেলার দুদলে গ্রামে। সে স্থানীয় ধুলিয়াপুর আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এবার বিজ্ঞান বিভাগে সব বিয়য়ে জিপিএ-৫ পেয়েছে। তাজবীহার বাবা ফারুক হোসেন কৃষিশ্রমিক। তিনি বলেন, কৃষিশ্রমিক হলেও এলাকায় একটা বড় সময় কাজ থাকে না। তখন অভাবের শেষ থাকে না।
তাজবীহা জানায়, বাড়ি থেকে সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরের বিদ্যালয়ে প্রথমে হেঁটে ও পরে সাইকেল চালিয়ে যাতায়াত করেছে। নবম শ্রেণি পর্যন্ত কোনো প্রাইভেট পড়ত না। দশম শ্রেণিতে ওঠার পর প্রাইভেট পড়তে হয়েছে। একজন শিক্ষক টাকা নিতেন না। অন্য শিক্ষকেরা নামমাত্র টাকায় পড়িয়েছেন। সে শপিং ব্যাগ সেলাইয়ের টাকা থেকে এই ব্যয় করছে।
নীলুফা বেগম বলেন, ‘ছোট মেয়েটা লেখাপড়ায় ভালো। তাকে ভালো খাবার তো দূরের কথা, ঠিকমতো খাবার দিতি পারিনে। অসুস্থ অবস্থায় শপিং ব্যাগ সেলাই করেছি ওর লেখাপড়াটা চালিয়ে নেওয়ার জন্যি। ওকে যদি বড় করতে না পারি, সব কষ্ট বৃথা যাবে।’
অভাব দমিয়ে রাখতে পারেনি
বাবা মো. জামাল মিয়া দিনমজুর, মা পারভীন গৃহিণী। সম্পদ বলতে বসতবাড়ির ভিটেতে একটি দোচালা টিনের ঘর। সংসারের অভাব-অনটন যেন নিত্যসঙ্গী। তবে সেই অভাব ফারজানা আক্তার আঁখিকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। সুনামগঞ্জের মধ্যনগর উপজেলার মহিষখলা উচ্চবিদ্যালয় থেকে এবারের এসএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে সে। তার বাড়ি উপজেলার বংশীকুণ্ডা উত্তর ইউনিয়নের সাউদপাড়া গ্রামে।
মহিষখলা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আবদুল মালেক ফকির বলেন, ‘অসচ্ছল পরিবারে জন্ম নিলেও ফারজানা অত্যন্ত মেধাবী। সহযোগিতা পেলে ভবিষ্যতে সে অনেক দূর এগিয়ে যাবে।’
জামাল মিয়ার পরিবারে স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে পাঁচ সদস্য। কখনো কৃষিশ্রমিক, কখনো রাজমিস্ত্রির সহযোগী হয়ে যেটুকু আয় করেন, তা দিয়েই সংসার ও সন্তানের পড়াশোনার খরচ চালাতে হয়। তবু মা-বাবার স্বপ্ন, বড় মেয়ে ফারজানাকে লেখাপড়া করিয়ে একদিন চিকিৎসক বানাবেন।
ফারজানার মা পারভীন বলেন, ‘মাইয়াডা ম্যালা বড় স্বপ্ন দেখছে। হের পড়াশোনার খরচ লইয়া খুউব চিন্তায় আছি। যদি কেউ সাহায্য করত, আমরার সারা জীবন দোয়া থাকত।’
শিক্ষকদের সহযোগিতায়ই ভালো ফল করেছে বলে জানায় ফারজানা। সে বলে, ‘আমাদের পরিবারের যা অবস্থা, তাতে আমার স্বপ্নটা অনেক কঠিন।’
পরিবারের মুখ উজ্জ্বল করেছে
ফরিদপুর শহরের ১ নম্বর হাবেলি গোপালপুর মহল্লার বাসিন্দা সামিয়া আক্তার (১৭)। বাবা শেখ বাবলু (৫৩) একজন সংবাদপত্র বিক্রয়কর্মী। তিনি ৩৬ বছর ধরে ঝড়বৃষ্টি-শীত-গরম উপেক্ষা করে ফরিদপুর শহরের গ্রাহকদের ঘরে ঘরে গিয়ে দৈনিক সংবাদপত্র পৌঁছে দিচ্ছেন। সেই আয়েই চলে পাঁচজনের সংসার। অভাবের মধ্যেই নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে এসএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে সামিয়া।
সে শহরের পুলিশ লাইনস স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী ছিল। বাবলু শেখ ও তাঁর স্ত্রী সীমা আক্তার বেশি দূর পড়াশোনা করেননি। তাই চাননি তাঁদের সন্তান অশিক্ষিত থাকুক। এ দম্পতি খেয়ে না–খেয়ে তিন মেয়েকে পড়াশোনা করাচ্ছেন। বড় মেয়ে সুমাইয়া আক্তার এইচএসসিতে জিপিএ-৪ পেয়ে একটি বেসরকারি নার্সিং ইনস্টিটিউটে পড়াশোনা করছেন। ছোট মেয়ে জান্নাতুল চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী। চলতি বছর মেজ মেয়ে সামিয়া সবার মুখ উজ্জ্বল করা ফল করেছে।
সামিয়া জানায়, ‘চিকিৎসার জন্য আশপাশের গরিব মানুষদের ছটফট করতে দেখেছি। ছোটবেলা স্বপ্ন দেখেছি চিকিৎসক হওয়ার।’
সীমা আক্তার বলেন, ‘নিজে বেশি পড়াশোনা করিনি। তাই মেয়েদের দিকে মনোনিবেশ করেছি, ওরা যেন মানুষের মতো মানুষ হতে পারে।’
প্রাইভেট পড়ার সামর্থ্য ছিল না
‘জীবনে কখনো কোনো শিক্ষকের কাছে টাকা দিয়ে প্রাইভেট পড়ার সামর্থ্য ছিল না। তবে শ্রেণিকক্ষে মনোযোগী ছিলাম। মাঝেমধ্যে অনলাইন কোচিংয়ের ফ্রি ক্লাস দেখেছি।’ কথাগুলো বলছিল কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার নোয়াদ্দা গ্রামের মেয়ে সাকিবা আক্তার। সে স্থানীয় নৈয়াইর ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন উচ্চবিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ–৫ পেয়েছে।
মা-বাবার তিন সন্তানের মধ্যে সাকিবা আক্তার সবার বড়। তার বাবা হানিফ মিয়া কাঠমিস্ত্রির কাজ করতেন। ভাগ্যের পরিবর্তনের আশায় দুবাই পাড়ি জমান। সেখানে অসুস্থ হয়ে পড়েন। মা রোজিনা বেগম গৃহিণী। অনেক কষ্টে তাদের সংসার চলে। এমন পরিস্থিতিতে মেয়ের পড়ালেখা চালু রাখা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন মা-বাবা।
রোজিনা বেগম বলেন, পাঁচ সদস্যের পরিবারে অনেক কষ্ট করে মেয়েটাকে পড়াচ্ছেন। ছোটবেলা থেকেই মেয়েটি লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহী। মেয়েটির চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন। শেষ পর্যন্ত সেটা সম্ভব হবে কি না, জানা নেই। কথা বলতে বলে দুই চোখ বেয়ে অশ্রু নামে তাঁর।
নৈয়াইর ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ফেরদাউস রহমান বলেন, সাকিবা সহায়তা পেলে মেধার বিকাশ ঘটাতে পারবে।