যেভাবে উম্মতকে ভালোবাসতেন নবীজি (স:)
দৈনিকসিলেট ডেস্ক :
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন দয়া-মমতার সাগর। উম্মতের প্রতি ছিল তাঁর গভীর মায়া, সীমাহীন মমতা এবং তাদের কল্যাণ সাধনে ছিলেন সদা ব্যাকুল। কোনও প্রতিদান ছাড়াই উম্মতকে তিনি নিঃস্বার্থ ভালোবাসতেন। তিনি শুধু উম্মতের নাজাত ও সফলতা চাইতেন। উম্মত যেন হেদায়েতের পথ হারিয়ে না ফেলে, আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনো আজব তাদেরকে আক্রান্ত না করে এটাই ছিল তার কামনা।
হজরত আব্দুল্লাহ বিন আমর ইবনুল আস রা. বলেছেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই আয়াত পাঠ করলেন, যেখানে ইবরাহীম আলাইহিস সালামের কথা উল্লেখ আছে,
رَبِّ اِنَّهُنَّ اَضْلَلْنَ كَثِیْرًا مِّنَ النَّاسِ فَمَنْ تَبِعَنِیْ فَاِنَّهٗ مِنِّیْ، وَقَالَ عِيسَى عَلَيْهِ السّلَامُ: اِنْ تُعَذِّبْهُمْ فَاِنَّهُمْ عِبَادُكَ وَ اِنْ تَغْفِرْ لَهُمْ فَاِنَّكَ اَنْتَ الْعَزِیْزُ الْحَكِیْمُ
(অনুবাদ) হে আমার রব! এসব প্রতীমা বহু মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে। সুতরাং যে আমার অনুসরণ করবে সে আমার দলভুক্ত হবে।’ (আর সেই আয়াতও পড়লেন যেখানে ঈসা আলাইহিস সালামের কথা বলা হয়েছে) তিনি বললেন, যদি আপনি তাদেরকে শাস্তি দেন তবে তারা তো আপনারই বান্দা। আর যদি তাদেরকে ক্ষমা করেন তবে নিশ্চয়ই আপনার ক্ষমতাও পরিপূর্ণ এবং হিকমতও পরিপূর্ণ।’
এই আয়াত পাঠ করে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দু’হাত তুলে কেঁদে কেঁদে বললেন,
اللهُمّ أُمّتِي أُمّتِي
‘হে আল্লাহ, আমার উম্মত! আমার উম্মত!!’
তখন আল্লাহ তায়ালা বললেন, হে জিবরাঈল! মুহাম্মাদকে গিয়ে জিজ্ঞাসা কর সে কেন কাঁদে? যদিও তোমার রব তা ভালো জানেন। অতপর জিবরাঈল আলাইহিস সালাম নবীজীর কাছে এসে তা জিজ্ঞাসা করলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সব খুলে বললেন। যদিও আল্লাহ তায়ালা সব জানেন। অতপর আল্লাহ তায়ালা বললেন, হে জিবরাঈল! মুহাম্মাদকে গিয়ে বলো, আমি অচিরেই তোমার উম্মতের ব্যাপারে তোমাকে সন্তুষ্ট করব, ব্যথিত করব না। (সহীহ মুসলিম, হাদীস ২০২)
আরেক হাদিসে নবীজী উম্মতের প্রতি তাঁর দরদকে এভাবে বুঝিয়েছেন,
আমার ও তোমাদের দৃষ্টান্ত সে ব্যক্তির দৃষ্টান্তের মত, যে আগুন জ্বালালো, ফলে ফড়িংদল পতঙ্গরাজি তাতে পড়তে লাগল। আর সে ব্যক্তি তাদের তা থেকে তাড়াতে লাগল। অনুরূপ আমিও আগুন থেকে রক্ষার জন্য তোমাদের কোমর ধরে টানছি, আর তোমরা আমার হাত থেকে ছুটে যাচ্ছ। (সহীহ মুসলিম, হাদীস ২২৮৫)
উম্মতের হেদায়েত লাভে তাঁর দরদ ও আত্মত্যাগের মাত্রা বুঝবার জন্য কুরআন কারীমের এই একটি আয়াতই যথেষ্ট। বর্ণিত হয়েছে, ‘মনে হয় যেন আপনি ওদের পিছনে পরিতাপ করতে করতে স্বীয় প্রাণ নাশ করে ফেলবেন, যদি ওরা এই বাণীর প্রতি ঈমান না আনে’। (সূরা কাহ্ফ, আয়াত, ৬)
এমনকি অকৃতজ্ঞ উম্মতের ধৃষ্টতার সামনেও তাঁর দয়ার বাঁধ ছিল অটল। তায়েফবাসীর কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন তাওহীদের বাণী, হেদায়েতের পয়গাম। তাদেরকে দেখাতে চেয়েছিলেন মুক্তির পথ। কিন্তু চরম ধৃষ্টতা দেখিয়ে তারা নবীজীর উপর চড়াও হল। পাথরের আঘাতে তাঁকে জর্জরিত করল। আঘাতে আঘাতে তাঁকে রক্তাক্ত করে ফেলল। কেঁপে উঠল আল্লাহর আরশ। আল্লাহ তায়ালা পাঠালেন জিবরীল আমীনকে। জিবরীল বললেন,
আপনার জাতি আপনার উদ্দেশে যা বলেছে এবং আপনার সাথে যে আচরণ করেছে আল্লাহ তা দেখেছেন। আপনার আদেশ পালনে পাহাড়ের দায়িত্বে নিয়োজিত ফিরিশতাকে পাঠিয়েছেন। তখন পাহাড়ের ফিরিশতা আমাকে সম্বোধন করে সালাম দিল এবং বলল, আমি পাহাড়ের দায়িত্বে নিয়োজিত ফিরিশতা। হে মুহাম্মাদ! আপনার কওমের বক্তব্য আল্লাহ শুনেছেন। আমাকে পাঠিয়েছেন আপনার আদেশ পালন করতে। আপনি আমাকে কী আদেশ করবেন করুন। আপনি যদি আদেশ করেন তাহলে আমি দুই পাহাড়ের মাঝে এদেরকে পিষে ফেলব।
কিন্তু দয়ার সাগর নবীজী জবাব দিলেন,
(আমি এটা চাই না;) বরং আমি আশা রাখি, আল্লাহ তায়ালা এদের বংশধরদের মাঝে এমন মানুষ বের করবেন, যারা এক আল্লাহ ইবাদত করবে, তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবে না। (সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৭৯৫; সহীহ বুখারী, হাদীস ৩২৩১)
একান্ত জাগতিক বিষয়েও উম্মতের বিপদাপদে নবীজী ছিলেন নিঃস্বার্থ সহযোগিতার আধার। সাহাবী হযরত আবূ হুরাইরা রা. বর্ণনা করেন যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, দুনিয়া ও আখেরাতে আমি প্রত্যেক মুমিনেরই সবচেয়ে ঘনিষ্ঠতর। ইচ্ছা হলে তোমরা এ আয়াতটি তিলাওয়াত কর।
اَلنَّبِیُّ اَوْلٰی بِالْمُؤْمِنِیْنَ مِنْ اَنْفُسِهِمْ
(মুমিনদের পক্ষে নবী তাদের প্রাণ অপেক্ষাও বেশি ঘনিষ্ঠ।) তাই সম্পদ রেখে কোনো মুমিন মারা গেলে আত্মীয়-স্বজন তার ওয়ারিস হবে। আর যদি সে ঋণ কিংবা অসহায় পরিজন রেখে যায়, তবে তারা যেন আমার নিকট আসে। আমিই তাদের অভিভাবক। (সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৭৮১)
অন্যত্র নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমি তোমাদের জন্য পিতৃতুল্য। (সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস ৮০; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ১৪৩১)