পুর্বের আসমানি ধর্মে ইবাদত
মুফতি আতাউর রহমান
ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। মানবজীবনের সব বিষয়ে ইসলামের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা আছে। তবে রাসুলুল্লাহ (সা.) পাঁচটি বিষয়কে ইসলামের মৌলিক বিষয় বা স্তম্ভ ঘোষণা করেছেন। ইসলামের এই পঞ্চস্তম্ভ পূর্ববর্তী উম্মতের জন্যও আবশ্যক ছিল। মৌলিকভাবে সব আসমানি ধর্মের এই অভিন্নতার দিকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় নিম্নোক্ত আয়াতে। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিঃসন্দেহে ইসলামই আল্লাহর কাছে একমাত্র দ্বিন।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১৯)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘নবীরা একে অন্যের বৈমাত্রেয় ভাই। তাঁদের মা ভিন্ন ভিন্ন, কিন্তু দ্বিন এক (অভিন্ন)।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩৪৪৩)
ইসলামের পঞ্চস্তম্ভ : আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘পাঁচটি বিষয়ের ওপর ইসলামের ভিত্তি রাখা হয়েছে : ১. আল্লাহ ব্যতীত প্রকৃত কোনো উপাস্য নেই এবং নিশ্চয়ই মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসুল—এ কথার সাক্ষ্য দেওয়া, ২. নামাজ আদায় করা, ৩. জাকাত আদায় করা, ৪. হজ করা, ৫. রমজানের রোজা রাখা।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৮)
পূর্ববর্তী শরিয়তে ইসলামের পঞ্চস্তম্ভ
কোরআন ও হাদিসের বর্ণনা থেকে জানা যায়, পূর্ববর্তী শরিয়তেও ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের বিধান ছিল। নিম্নে তার বর্ণনা তুলে ধরা হলো :
১. ঈমান : পৃথিবীর সব নবী ও রাসুল মানুষকে আল্লাহর একত্ববাদ ও ইবাদতের আহ্বান জানিয়েছেন। যদিও একদল মানুষ তাদের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেছে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহর ইবাদত করার ও তাগুতকে বর্জন করার নির্দেশ দেওয়ার জন্য আমি তো প্রত্যেক জাতির মধ্যেই রাসুল পাঠিয়েছি।’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ৩৬)
একইভাবে আল্লাহ পূর্ববর্তী নবী-রাসুলদের থেকে মহানবী (সা.)-এর ঈমান ও তাঁর আনুগত্যের অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘স্মরণ করো, যখন আল্লাহ নবীদের অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলেন, যে তোমাদের কিতাব ও প্রজ্ঞা, যা কিছু দিয়েছি অতঃপর তোমাদের কাছে যা আছে তার সমর্থক হিসেবে যখন একজন রাসুল আসবে, তখন তোমরা অবশ্যই তাঁর প্রতি ঈমান আনবে এবং তাঁকে সাহায্য করবে। তিনি বললেন, তোমরা কি স্বীকার করলে? এবং এ বিষয়ে আমার অঙ্গীকার কি তোমরা গ্রহণ করলে? তারা বলল, আমরা স্বীকার করলাম। তিনি বললেন, তবে তোমরা সাক্ষী থাকো এবং আমিও তোমাদের সঙ্গে সাক্ষী থাকলাম।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ৮১)
২. নামাজ : কোরআনের একাধিক আয়াত দ্বারা বোঝা যায়, পূর্ববর্তী শরিয়তেও নামাজের বিধান ছিল। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে আমার প্রতিপালক, আমাকে নামাজ আদায়কারী করুন এবং আমার বংশধরদের মধ্য থেকেও। হে আমার প্রতিপালক, আমার প্রার্থনা কবুল করুন।’ (সুরা ইবরাহিম, আয়াত : ৪)
অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা বলল, হে শোআইব, তোমার নামাজ কি তোমাকে নির্দেশ দেয় যে আমাদের পিতৃ-পুরুষরা যার ইবাদত করত আমাদের তা বর্জন করতে হবে।’ (সুরা : হুদ, আয়াত : ৮৭)
৩. জাকাত : পূর্ববর্তী শরিয়তে জাকাতেরও বিধান ছিল। কোরআনে ঈসা (আ.)-এর ভাষ্যে ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন যত দিন জীবিত থাকি তত দিন সালাত ও জাকাত আদায় করতে।’ (সুরা : মারিয়াম, আয়াত : ৩১)
অন্য আয়াতে ইসমাঈল (আ.) সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘সে তাঁর পরিবারগর্বকে নামাজ ও জাকাতের নির্দেশ দিত এবং সে ছিল তার প্রতিপালকের সন্তোষভাজন।’ (সুরা মারিয়াম, আয়াত : ৫৫)
৪. হজ : কোরআনের ভাষ্য দ্বারা বোঝা যায়, হজের প্রবর্তন করেন মুসলমানদের জাতির পিতা ইবরাহিম (আ.)। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর মানুষের কাছে হজের ঘোষণা করে দাও, তারা তোমার কাছে আসবে পদব্রজ ও সর্বপ্রকার ক্ষীণকায় উটের পিঠে, তারা আসবে দূর-দূরান্তর পথ অতিক্রম করে।’ (সুরা হজ, আয়াত : ২৭)
৫. রোজা : কোরআনের বর্ণনানুসারে পূর্ববর্তী শরিয়তে রোজার বিধান ছিল। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা, তোমাদের জন্য রোজার বিধান দেওয়া হলো, যেমন বিধান তোমাদের পূর্ববর্তীদের দেওয়া হয়েছিল, যাতে তোমরা আল্লাহভীরু হতে পারো।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৮৩)
ভিন্নতা ছিল পদ্ধতিতে : ইসলামের মৌলিক পাঁচ ইবাদতের বিধান পূর্ববর্তী শরিয়তে থাকলেও তা আদায়ের পদ্ধতিতে ছিল ভিন্ন। পবিত্র কোরআনের একটি আয়াত থেকে সেই ভিন্নতার ধারণা পাওয়া যায়। যেমন মারিয়াম (আ.)-এর রোজার ব্যাপারে ইরশাদ হয়েছে, ‘মানুষের মধ্যে কাউকে যদি তুমি দেখো, তখন বলবে, আমি দয়াময়ের উদ্দেশে রোজার মানত করেছি। সুতরাং আজ আমি কিছুতেই কোনো মানুষের সঙ্গে বাক্যালাপ করব না।’ (সুরা : মারিয়াম, আয়াত : ২৬)
আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, উল্লিখিত আয়াত দ্বারা বোঝা যায়, তাদের শরিয়তে রোজাদার ব্যক্তির জন্য পানাহার ও কথা বলা উভয়টি হারাম ছিল। (তাফসিরে ইবনে কাসির)
মিল ও অমিলের ব্যাখ্যা : নবী-রাসুলরা যে অভিন্ন বিধান নিয়ে এসেছিলেন সেটা হলো দ্বিন এবং তা আদায়ের যে ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি বলে দিয়েছেন তা হলো শরিয়ত। পৃথিবীর সব নবী ও রাসুল (আ.) অভিন্ন দ্বিন নিয়ে আগমন করেছিলেন। তবে তাদের শরিয়তে ভিন্নতা ছিল। ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনি তোমাদের জন্য বিধিবদ্ধ করেছেন দ্বিন, যার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি নুহকে, আর যা আমি ওহি করেছি তোমাকে এবং যার নির্দেশ দিয়েছিলাম ইবরাহিম, মুসা ও ঈসাকে—এই বলে যে তোমরা দ্বিনকে প্রতিষ্ঠিত কোরো এবং তাতে মতভেদ কোরো না।’ (সুরা : আশ-শুরা, আয়াত : ১৩)
উল্লিখিত আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয়, আল্লাহ অভিন্ন দ্বিন দিয়ে নবীদের পাঠিয়েছেলেন। তবে তাদের শরিয়তে আছে ভিন্নতা। ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের প্রত্যেকের জন্য শরিয়ত ও স্পষ্ট পথ নির্ধারণ করেছি।’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ৪৮)
অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছি ‘ইবাদত পদ্ধতি’, যা তারা অনুসরণ করে।’ (সুরা : হজ, আয়াত : ৬৭)
আল্লাহ সবাইকে সত্যের অনুসারী হওয়ার তাওফিক দিন। আমিন