মহানবী (সা.)-এর চিঠি পেয়েছিলেন যাঁরা
জাওয়াদ মাহবুব
মহানবী (সা.) তাঁর সাহাবি, তাঁর নিয়োগকৃত প্রশাসক, বিভিন্ন গোত্রের অধিপতি ও রাজা-বাদশাহর উদ্দেশে চিঠি লিখেছিলেন। প্রেরিত চিঠিতে তিনি ঈমান ও ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন এবং মানুষকে শরিয়তের বিধি-বিধান শিক্ষা দিয়েছেন। অর্থাৎ তাঁর প্রেরিত চিঠিপত্রও ছিল দ্বিন প্রচারের মাধ্যম।
লিখতে জানতেন না তিনি
মহানবী (সা.) একাধিক ব্যক্তির কাছে চিঠি প্রেরণ করলেও তিনি নিজে লিখতে জানতেন না।
তিনি ছিলেন উম্মি বা অক্ষর জ্ঞানহীন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনিই উম্মিদের মধ্যে একজন রাসুল পাঠিয়েছিলেন তাদের মধ্য থেকে, যে তাদের কাছে আবৃত্তি করে তাঁর আয়াতগুলো, তাদেরকে পবিত্র করে এবং শিক্ষা দেয় কিতাব ও হিকমত; এর আগে তারা ছিল ঘোর বিভ্রান্তিতে।’ (সুরা : জুমা, আয়াত : ২)
যাঁরা চিঠি লিখে দিতেন
আল্লামা ইবনুল কায়্যিম জাওজি (রহ.) বলেন, সিরাত গবেষকদের মতে, নিম্নোক্ত সাহাবিরা রাসুল (সা.)-এর চিঠি ও ওহি লিপিবদ্ধ করতেন। তাঁরা হলেন আবু বকর সিদ্দিক, ওমর ইবনুল খাত্তাব, উসমান, আলী, জুবায়ের ইবনুল আওয়াম, আমের বিন ফুহাইরা, আমর ইবনুল আস, উবাই বিন কাআব, আবদুল্লাহ বিন আরকাম, সাবেত বিন কায়েস, হানজালা বিন রাবি, মুগিরা বিন শোবা, আবদুল্লাহ বিন রাওয়াহা, খালিদ বিন ওয়ালিদ, খালিদ বিন সাঈদ, মুয়াবিয়া ও জায়েদ বিন সাবিত (রা.)।
(জাদুল মাআদ : ১/১১৭)
প্রেরিত চিঠির সংখ্যা
মহানবী (সা.)-এর প্রেরিত চিঠির সংখ্যা সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তবে মিসরীয় ইতিহাস গবেষক ড. হামিদুল্লাহর মতে, প্রিয় নবী (সা.) যাঁদের কাছে চিঠি পাঠিয়েছিলেন তাঁদের সংখ্যা ২০০ থেকে ২৫০।
(দৈনিক কালের কণ্ঠ, ১ ডিসেম্বর ২০১৭)
নবীজি (সা.)-এর চিঠির প্রাপকদের ভেতর ১০ জন শাসক ও পাঁচজন আঞ্চলিক প্রশাসক বা গোত্রপতি ছিলেন। তাঁদের উদ্দেশে লেখা চিঠিগুলোরই বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়।
ছিল নিজস্ব সিলমোহর
মহানবী (সা.) তাঁর রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সিলমোহর হিসেবে একটি আংটি ব্যবহার করতেন, যা তাঁর পরবর্তী দুই মহান খলিফার ব্যবহার করেছিলেন। অতঃপর উসমান (রা.)-এর সময় তা হারিয়ে যায়। আনাস বিন মালিক (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আংটি ছিল রুপার তৈরি এবং তাঁর নাগিনাও ছিল রুপার।
(সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫৮৭০)
আংটিতে অঙ্কিত তিনটি শব্দের মধ্যে সবার ওপরে ‘আল্লাহ’, এর নিচে ‘রাসুল’ এবং তার নিচে মুহাম্মদ লেখা ছিল। নিচ থেকে পড়লে হয় মুহাম্মদ রাসুলুল্লাহ।
(সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ১৭৪৭)
কেমন ছিলেন পত্রবাহকরা
সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভি (রহ.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পত্রবাহকদের সম্পর্কে লেখেন, ‘তিনি প্রত্যেক সম্রাটের জন্য এমন সব দূত নির্বাচিত করেন যাঁরা তাঁদের সম্মান ও মর্যাদা মোতাবেক কথাবার্তা বলতে পারেন এবং সেখানকার ভাষা, তা ছাড়া দেশের অবস্থা সম্পর্কে ওয়াকিফহাল।’
(নবীয়ে রহমত, পৃষ্ঠা ২৮৮)
যাঁরা চিঠি পেয়েছিলেন
সিরাত ও হাদিসের গ্রন্থগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায় নবী করিম (সা.) মোট পাঁচ শ্রেণির লোকের উদ্দেশে চিঠি লেখেন। তাঁরা হলেন—
এক. সাধারণ সাহাবি : রাসুলুল্লাহ (সা.) কখনো কখনো সাধারণ সাহাবিদের উদ্দেশ্যে চিঠি লিখেছেন। যেসব চিঠিতে তিনি তাঁদের প্রয়োজনীয় উপদেশ দান করেছেন বা শরিয়তের কোনো বিধান বর্ণনা করেছেন। যেমন—মুয়াজ (রা.)-এর ছেলে মারা গেলে নবীজি (সা.) তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে চিঠি লেখেন। চিঠিতে তিনি তাঁকে ধৈর্য ধারণের উপদেশ দেন এবং তাঁর জন্য উত্তম প্রতিদানের দোয়া করেন।
(হুলয়াতুল আউলিয়া : ১/২৪৩)
দুই. প্রশাসক সাহাবি : রাসুলুল্লাহ (সা.) যেসব সাহাবিকে বিভিন্ন অঞ্চলের প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন, তাঁদের উদ্দেশেও কখনো কখনো চিঠি লিখেছিলেন। মুনজির বিন সাবি বিন আখনাস (রা.), যিনি বাহরাইন অঞ্চলের শাসক ছিলেন, তিনি নবীজি (সা.)-এর আহ্বানে ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলাম গ্রহণের পর তাঁর গোত্রের যারা ইসলাম প্রত্যাখ্যান করেছে, তাদের সঙ্গে কেমন আচরণ করা হবে তা জানতে চান। নবীজি (সা.) চিঠির উত্তরে লেখেন, যারা কালেমায় বিশ্বাসী ও মুসলমানদের কিবলার অনুসারী তাদের মুসলিম হিসেবে গণ্য করে নিতে। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ৬/৪২৭)
তিন. গোত্র বা সম্প্রদায় : ইবনুল কায়্যিম জাওজি (রহ.) রাসুলুল্লাহ (সা.) ইয়ামানবাসীর উদ্দেশে এক দীর্ঘ চিঠি লেখেন। চিঠিতে জাকাত, দিয়ত, কবিরা গুনাহ, তালাক, দাসমুক্তি, একই কাপড়ে নামাজ আদায়, কোরআন স্পর্শ করা ইত্যাদি বিষয়ের বিধান বর্ণিত হয়েছিল।
(জাদুল মাআদ, পৃষ্ঠা ৭৬)
চার. গোত্রপ্রধান ও আঞ্চলিক প্রশাসক : নবীজি (সা.) একাধিক গোত্রপ্রধান ও আঞ্চলিক প্রশাসকের উদ্দেশে চিঠি লেখেন। যেমন—
১. বনু হানিফ গোত্রের সরদার হাওজা বিন আলী হানাফির কাছে সালিত বিন আমর আমেরি (রা.)-এর মাধ্যমে চিঠি পাঠানো হয়। হাওজা পারস্য সম্রাট কিসরার পক্ষ থেকে নজদের ইয়ামামা শাসন করতেন।
২. ওমানে বসবাসকারী জাহরান গোত্রের দুই নেতা জায়ফা ও আবদের কাছে আমর ইবনুল আস (রা.)-এর মাধ্যমে চিঠি পাঠান। তাঁরা জালান্দারের দুই ছেলে।
৩. আলা ইবনে হাদরামি (রা.)-এর মাধ্যমে মুনজির বিন সাবি বিন আখনাস (রা.)-এর কাছে চিঠি পাঠান। যিনি বাহরাইন অঞ্চলের শাসক ছিলেন এবং নবীজি (সা.)-এর আহ্বানে ইসলাম গ্রহণ করেন।
৪. মুহাজির ইবনে উমাইয়া মাখজুমি (রা.)-এর মাধ্যমে রাসুলুল্লাহ (সা.) ইয়েমেনের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা হারেস ইবনে আবদে কিলাল হিময়ারি (রহ.)-এর কাছে পত্র পাঠান। তিনি নবীজি (সা.)-এর আহ্বানে ইসলাম গ্রহণ করেন।
৫. ইয়েমেনের অপর দুই প্রভাবশালী নেতা জুলকিলা ও জুলআমরের কাছেও নবীজি (সা.) চিঠি পাঠান। তাঁদের কাছে চিঠি নিয়ে যান জারির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.)।
(আর রাহিকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা ৩৬৫-৩৬৯)
পাঁচ. রাজা ও সম্রাট : প্রায় ১০ জন রাজা, বাদশাহ ও শাসকের কাছে ইসলামের আহ্বান জানিয়ে চিঠি লেখেন। যেমন—
১. দিহয়াতুল কালবি (রা.)-এর মাধ্যমে রোম সম্রাট কায়সারের কাছে চিঠি পাঠান।
২. আবদুল্লাহ ইবনে হুজাফা সাহমি (রা.)-এর মাধ্যমে পারস্য সম্রাট কিসরার কাছে পত্র পাঠান।
৩. আমর বিন উমাইয়াম দামেরি (রা.)-এর মাধ্যমে হাবশার বাদশাহ নাজ্জাসির কাছে পত্র পাঠান।
৪. হাতেব ইবনে আবি বালতাআ (রা.)-এর মাধ্যমে ইস্কান্দারিয়ার (মিসর) শাসক মুকাওকিসের কাছে পত্র প্রেরণ করেন।
৫. সালিত ইবনে আমর (রা.)-এর মাধ্যমে ইয়ামার শাসক সুমামা বিন উসালের কাছে পত্র পাঠান।
৬. সুজা বিন ওয়াহাব আসদি (রা.)-এর মাধ্যমে শামের শাসক হারিস বিন আবি শামার গাসসানির কাছে পত্র পাঠান।
৭. হারেস বিন উমায়ের আজদি (রা.)-এর মাধ্যমে বসরার শাসকের কাছে পত্র প্রেরণ করেন।
৮. মুয়াজ বিন জাবাল (রা.)-এর মাধ্যমে ইয়েমেনের শাসক আবদে কিলালের তিন ছেলে হারিস, শুরাহবিল ও নুআইমের কাছে পত্র প্রেরণ করেন। (আর রাহিকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা ৩৬৫-৩৬৯; আস সিরাতুন নাবাবিয়্য লি-ইবনে হিশাম : ৪/৮০৯)
চিঠির বিষয়বস্তু ও ফলাফল
এসব চিঠিতে রাসুলুল্লাহ (সা.) তাওহিদ ও রিসালাতের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। এর মাধ্যমে পৃথিবীর বেশির ভাগ অঞ্চলে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেন। এর ফলে সভ্য পৃথিবীর সর্বত্র আল্লাহ, তাঁর রাসুল ও ইসলামের পরিচিতি ছড়িয়ে পড়ে এবং বিশ্বময় ইসলামের আলোচনা শুরু হয়। (আর রাহিকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা ৩৬৯)
আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মদ। আমিন।