মুমিনের জীবনে আশা ও ভয়
আল্লামা আশরাফ আলী থানভি (রহ.)
পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের কাছে যা আছে তা নিঃশেষ হবে এবং আল্লাহর কাছে যা আছে তা স্থায়ী। যারা ধৈর্য ধারণ করে আমি নিশ্চয়ই তাদেরকে তারা যা করে তা থেকে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার দান করি।’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ৯৬)
এ আয়াতে আল্লাহ আমাদের একটি বড় কাজের শিক্ষা দিয়েছেন। যার মাধ্যমে আমাদের সব পেরেশানি অবসান হয়ে যাবে।
বিষয়টি অত্যন্ত স্পষ্ট ও সরল। তা হলো দুনিয়ার অস্থায়িত্ব সব সময় চিন্তার খোরাকরূপে সামনে রাখা আবশ্যক। কখনো তা থেকে অমনোযোগী হওয়া উচিত নয়। কেননা বাস্তবিকপক্ষে দুনিয়া কখনো স্থায়ী নয়, বরং খুবই ক্ষণস্থায়ী।
তাই তার অস্থায়িত্ব ভুলে দুনিয়াতে মগ্ন হওয়া মহাভুল।
কোনো বাদশাহ যখন কোষাধ্যক্ষের হাতে কোষাগার অর্পণ করে দেন এবং কোষাধ্যক্ষের জানা থাকে যে কোষাগার বাদশাহ আমানত হিসেবে অর্পণ করেছেন, তখন তাঁর দায়িত্ব হলো আমানত রক্ষার বিষয়টি স্মরণে রাখা। এখন যদি কোনো কোষাধ্যক্ষ যদি কোষাগারকে নিজের সম্পদ মনে করে প্রকৃত মালিকের মতো তা ব্যয় করে, তবে সবাই তাকে বোকা বলবে। একইভাবে দুনিয়ার অস্থায়িত্ব ভুলে যাওয়া মানুষের জন্য মহাভুল।
স্বভাব চায় মানুষ তা ভুলে থাকুক। কেননা দুনিয়ার অস্থায়িত্ব বারংবার দেখে মানুষ তাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। আর যে বস্তু অভ্যাসে পরিণত হয়, স্বভাব তা থেকে অমনোযোগী ও অসতর্ক হয়ে পড়ে। শরিয়ত বিবেক ও স্বভাবের মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করেছে। ইসলামী শরিয়ত বলে, দুনিয়ার অস্থায়িত্বের প্রতি অমনোযোগ ততক্ষণ দূষণীয় নয়, যতক্ষণ তা আল্লাহ ও তাঁর বিধান থেকে মানুষকে উদাসীন করে তোলে।
প্রকৃতপক্ষে দুনিয়ার অস্থায়িত্ব থেকে কিছুমাত্র অমনোযোগী না হলেও মানুষ সম্পূর্ণরূপে বেকার হয়ে যাবে। কেননা যার সামনে সব সময় মৃত্যু দাঁড়িয়ে থাকে সে কোনো কাজই করতে পারে না। কিন্তু অমনোযোগিতারও একটি সীমা আছে। সীমাটা হলো, পার্থিব জীবনকে স্বাভাবিকভাবে যাপন করতে যতটুকু অমনোযোগ দরকার ততটুকুই। কিন্তু তা করতে গিয়ে বিবেকের দাবিকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করা যাবে না। সেটা হলো দুনিয়ার মোহে এমনভাবে আচ্ছন্ন হওয়া, যাতে মনে হয় সে চিরদিন দুনিয়ায়ই থাকবে। এমন ব্যক্তিকে সেই পথিকের সঙ্গে তুলনা করা যায় যে হোটেল বা সরাইখানার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে সেখানে সুরম্য অট্টালিকা ও উদ্যান রচনা শুরু করে দেয়। এমন ব্যক্তিকে মানুষ বোকাই বলবে। কেননা সে অস্থায়ী আবাসে স্থায়ী বাসস্থান নির্মাণ করছে। অন্যদিকে যে ব্যক্তি সেখানে এক রাত থাকার জন্য প্রয়োজনীয় আসবাব সংগ্রহ করে, এর থেকে অতিরিক্ত কিছু করা থেকে বিরত থাকে তাকে বোকা বলা হবে না।
আখিরাতের স্থায়িত্ব চোখে দেখার বিষয় নয়, তা মানুষের ঈমান ও বিশ্বাসের বিষয়। ঈমানের বিষয়গুলোর প্রতি অন্তরের অটল বিশ্বাস স্থাপন করা অপরিহার্য। কিন্তু আমাদেরকে যদি বলা হয়—‘তুমি মারা যাবে, আল্লাহর সামনে উপস্থিত হবে, কবরে প্রশ্নোত্তর হবে, কিয়ামতের দিন আমলনামা সামনে হাজির করা হবে, তখন তা আমাদের কাছে স্বপ্ন বলে মনে হয়। অথচ বিষয়গুলো স্বপ্ন নয়, বরং বাস্তবতার মতো অন্তরে দৃঢ় থাকার কথা ছিল। এ জন্য পরকাল বিষয়ে উপদেশ দিলে কেউ কেউ বলে, এখন তো আরামেই আছি, পরকালের পরিণাম আল্লাহই ভালো জানেন।
আবার কেউ কেউ বলেন, আল্লাহ দয়ালু ও ক্ষমাশীল। তিনি আমাদের ক্ষমা করে দেবেন। তাদের কথা শুনলে মনে হয়, পরকালে আল্লাহর নানামুখী ক্ষমতার মধ্যে কেবল এক দিকই প্রকাশ পাবে। অর্থাৎ শুধু ক্ষমাই করবেন, ক্ষেত্রবিশেষ কাউকে শাস্তি দেবেন। তারা আল্লাহর দয়ার প্রতি খেয়াল রাখে, আল্লাহর শাস্তিদানের ক্ষমতার প্রতি উদাসীন। কেন বন্ধু! যখন আপনি আশা করছেন, আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করে দেবেন, তখন কেন মনে ভয় আসে না যে আল্লাহ অপরাধেরও শাস্তি দেবেন? তাহলে জাহান্নাম কাদের জন্য সৃষ্টি হয়েছে? এটা তো সম্ভব নয় যে আল্লাহ ক্ষমাও করবেন আবার জাহান্নামেও নিক্ষেপ করবেন।
আল্লাহ আমাদের অন্তরে তাঁর ভয় দান করুন। আমিন।
ভাষান্তর: আলেমা হাবিবা আক্তার