হইকাল ও পরকাল জগতের সফলতা অর্জনে আত্মশুদ্ধি
দৈনিকসিলেট ডেস্ক :
মানুষের আত্মিক উন্নতি, প্রশান্তি ও বিকাশ সাধনের জন্য আত্মশুদ্ধির গুরুত্ব অপরিসীম। আত্মশুদ্ধি মানুষের নৈতিক ও মানবিক গুণাবলির বিকাশ ঘটায় এবং সর্বদা ভালো চিন্তা ও সৎকর্মে উৎসাহিত করে। পক্ষান্তরে যার আত্মা কলুষিত সে নানাবিধ পাপচিন্তা ও অশ্লীল কাজে লিপ্ত থাকে। তখন ভালো-মন্দ ও ন্যায়-অন্যায় পার্থক্য করার অনুভূতি অকার্যকর হয়ে পড়ে। সে অন্যায়-অত্যাচার ও সন্ত্রাস-নির্যাতন করতে দ্বিধাবোধ করে না। ফলে সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলাও বিনষ্ট হয়। তাছাড়া অপরিশুদ্ধ ও ব্যাধিগ্রস্ত অন্তর মানুষকে আল্লাহর স্মরণ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। অতএব নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধ বিকাশের জন্যও আত্মশুদ্ধির প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
পরকালীন জীবনের সফলতা ও মুক্তি আত্মশুদ্ধির ওপর নির্ভরশীল। আত্মার পরিশুদ্ধি ছাড়া কেয়ামতের দিন কোনো কিছু উপকারে আসবে না। যে ব্যক্তি দুনিয়ায় নিজ আত্মাকে পবিত্র রাখবে পরকালে সেই মুক্তি লাভ করবে। এ জন্যই ইসলামে আত্মশুদ্ধির ব্যাপারে অত্যধিক গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। আত্মশুদ্ধির পথ ও পাথেয় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
দোয়া করা : দোয়া শব্দের অর্থ আল্লাহর কাছে চাওয়া, প্রার্থনা করা। নিজের মনের সব আকুতি নিয়ে বিনয়ের সঙ্গে মহান আল্লাহর কাছে কল্যাণ ও উপকার লাভের উদ্দেশ্যে এবং ক্ষতি ও অপকার থেকে বেঁচে থাকার জন্য প্রার্থনা করাই হলো দোয়া। কোরআন-হাদিসে দোয়াকেও ইবাদত হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। অন্তরের পবিত্রতা ও পরিশুদ্ধির জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করা আবশ্যক। দোয়ার মাধ্যমে ইবাদতে নিমগ্ন হলে আত্মা প্রশান্তি লাভ করে। দোয়া হলো আল্লাহর কাছে চাওয়ার অপূর্ব ও অতুলনীয় মাধ্যম। দোয়া মুমিনের প্রাপ্তি ও মুক্তির হাতিয়ার। আল্লাহর দরবারে একাগ্রচিত্তে কাকুতি-মিনতিসহ দোয়া করলে কবুল হয়। দোয়া সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহর কাছে বান্দার দোয়া অপেক্ষা অধিক মূল্যবান জিনিস আর কিছু নেই।’ (জামে তিরমিজি) বান্দা আল্লাহর কাছে যত বেশি দোয়া করে, আল্লাহতায়ালা তাকে তত বেশি ভালোবাসেন এবং প্রার্থিত জিনিস দান করেন। আল্লাহতায়ালা নিজে তার বান্দাদের দোয়া করার নির্দেশ দিয়েছেন। কোরআন মাজিদে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা আমাকে ডাকো, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব।’ (সুরা মুমিন ৬০) রাসুল (সা.) আত্মশুদ্ধির জন্য নিয়মিত দোয়া করতেন। তিনি দোয়ায় বলতেন, ‘হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে পরিশুদ্ধ অন্তর কামনা করছি।’ (মুসনাদে আহমদ) তিনি আরও দোয়া করতেন, ‘হে অন্তর পরিবর্তনকারী! আমার অন্তরকে আপনার আনুগত্যে দৃঢ় করে দিন।’ (মুসনাদে আহমদ)
আল্লাহকে ভয় করা : আল্লাহভীতি মুমিন জীবনের মূলভিত্তি। মহান আল্লাহ যেমন ক্ষমাশীল তেমনি কঠোর শাস্তিদাতা। তাই অন্তরে সর্বদা আল্লাহর ভয় ধারণ করতে হবে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘হে ইমানদানরা! তোমরা আল্লাহকে যথাযথ ভয় করো। আর মুসলমান না হয়ে কেউ মৃত্যুবরণ কোরো না।’ (সুরা আলে ইমরান ১০২) এ আয়াত থেকে বোঝা যায় যে, আল্লাহকে যথার্থরূপে ভয় করতে হবে। আল্লাহভীতির আগুনে পুড়ে মানুষ যেমন প্রবৃত্তি ও কামনাকে ভস্মে পরিণত করতে পারে, তেমন আর কোনোভাবেই পারে না।
কোরআন তেলাওয়াত : কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে একজন বান্দার সঙ্গে মহান আল্লাহর কথোপকথন হয়। কোরআন মাজিদ মহান আল্লাহর পবিত্র বাণী। এটি মানুষের প্রতি আল্লাহতায়ালার এক বিশেষ নেয়ামত। কোরআন হলো নুর বা জ্যোতি। আত্মার খোরাক এই কোরআন মাজিদ। যার প্রতি হরফে হরফে নেকি রয়েছে। কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে মানুষের অন্তরের কালিমা দূর হয় এবং অন্তর প্রশান্ত হয়। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই অন্তরেও মরিচা ধরে যেভাবে লোহায় পানি লাগলে মরিচা ধরে। বলা হলো, হে আল্লাহর রাসুল! এই মরিচা দূর করার উপায় কী? উত্তরে তিনি বলেন, মৃত্যুর কথা বেশি বেশি স্মরণ করা এবং কোরআন তেলাওয়াত করা।’ (বায়হাকি)
জিকির করা : আল্লাহকে স্মরণ করার নাম জিকির। অন্তর ও জবান এই দুটি সব সময় আল্লাহর কাজে নিয়োজিত রাখাই জিকিরের উদ্দেশ্য। জিকির মানবাত্মার রোগ-ব্যাধি দূর করে অন্তরকে পরিশুদ্ধ করে। এ ব্যাপারে দিকনির্দেশনা দিয়ে রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘প্রত্যেক বস্তুকেই পরিষ্কার করার যন্ত্র আছে। আর আত্মাকে পরিষ্কার করার যন্ত্র হলো আল্লাহর জিকির। (বায়হাকি) আল্লাহর জিকির হচ্ছে যাবতীয় ইবাদতের রুহ। তাই যত বেশি মহান আল্লাহর জিকিরে নিজেকে নিয়োজিত রাখা হবে অন্তর ততই পরিষ্কার হবে এবং অন্তরের রোগ-ব্যাধি দূর হবে। আল্লাহতায়ালা নিজেই মানুষকে বেশি বেশি জিকির করার নির্দেশ দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘জেনে রাখো! আল্লাহর জিকির দ্বারাই অন্তর প্রশান্ত হয়।’ (সুরা রাদ ২৮)
তওবা করা : তওবা আরবি শব্দ। এর অর্থ হলো সঠিক পথে ফিরে আসা, ক্ষমা প্রার্থনা করা, কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত হওয়া এবং আন্তরিকভাবে অনুশোচনা করা। ইসলামি পরিভাষায় কোনো অন্যায় বা অপরাধমূলক কাজ হয়ে যাওয়ার পর অনুতপ্ত হয়ে সেই কাজের জন্য মহান প্রভুর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং সেই অন্যায় কাজ ছেড়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে ভালো পথে ফিরে আসাকে তওবা বলা হয়। কোনো কোনো মনীষী বলেন, অনুতাপ ও অনুশোচনা সহকারে গুনাহ বর্জন করে আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করাকে তওবা বলে। তওবার মাধ্যমে অন্তরের কালিমা দূর হয়।
অসহায়ের পাশে থাকা : গরিব, দুস্থ ও অসহায় মানুষের পাশে থাকলে অন্তর নরম হয়। সমাজের দুস্থ ও অসহায় মানুষকে সহায়তা দানের প্রতি ইসলাম অধিক গুরুত্ব আরোপ করেছে। সুযোগ হলে সাধ্যমতো তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করা, খাবার খাওয়ানো এবং খোঁজখবর নেওয়া উচিত। এতে অন্তরের পরিশুদ্ধি অর্জিত হয়। পবিত্র কোরআনের বহু জায়গায় আল্লাহতায়ালা গরিব, অসহায় ও মিসকিনদের খাবার দান করার কথা বলেছেন। পবিত্র কোরআনে তিনি বলেন, ‘আমি তাকে দুটি পথপ্রদর্শন করেছি। অতঃপর সে ধর্মের ঘাঁটিতে প্রবেশ করেনি। আপনি কি জানেন, সে ঘাঁটি কী? তা হচ্ছে দাসমুক্ত করা কিংবা দুর্যোগ ও সংকটের দিনে এতিম, আত্মীয়স্বজন ও ধুলি-ধূসরিত মিসকিনদের অন্নদান করা।’ (সুরা বালাদ ১০-১৬) অভুক্ত ব্যক্তিকে আহার্য দেওয়ার ফজিলত বলতে গিয়ে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘মানুষের কল্যাণ সংশ্লিষ্ট যত কাজ আছে, তার মধ্যে সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম হচ্ছে দরিদ্র ও ক্ষুধার্তকে খাবার দান করা।’ (সহিহ বুখারি ১২)। আল্লাহই কিছু মানুষকে সম্পদ দিয়েছেন, আবার কিছু মানুষকে নিঃস্ব করেছেন। যাদের সম্পদ দেওয়া হয়েছে, তাদের সম্পদে অসহায় ও গরিব-মিসকিনদের হক রয়েছে। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘তাদের ধন-সম্পদে ভিক্ষুক ও বঞ্চিতদের হক রয়েছে।’(সুরা জারিয়াত ১৯) সাহাবিরা যখন খাবার খেতেন সঙ্গে দুয়েকজনকে নিয়ে খেতেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা এমন কাজের ভূয়সী প্রশংসা করে বলেছেন, ‘আর তারা আল্লাহকে ভালোবেসে মিসকিন, এতিম ও বন্দিদের খাবার দান করে। তারা বলে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আমরা তোমাদের খাদ্য দান করেছি, তোমাদের কাছে আমরা এজন্য কোনো প্রতিদান চাই না এবং কোনো কৃতজ্ঞতাও না।’ (সুরা দাহর ৮-৯)
অন্তরের কঠোরতা পরিহার : অন্তর কঠিন হওয়া মারাত্মক একটি রোগ। দীর্ঘ সময় মহান আল্লাহর স্মরণ থেকে দূরে থাকা এবং পাপকাজে লিপ্ত হওয়ার কারণে মানুষের অন্তর কঠিন হয়ে যায়। আল্লাহতায়ালা থেকে দূরত্ব যত বেশি সেই হৃদয়ের কাঠিন্য তত বেশি। অন্তর কঠিন হলে মানুষের হৃদয়ে আল্লাহভীতি নষ্ট হয়ে যায়। যাদের অন্তর কঠিন ও আল্লাহভীতি শূন্য তাদের সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘দুর্ভোগ সেই লোকদের জন্য, যাদের অন্তর আল্লাহর স্মরণের ব্যাপারে কঠোর, তারা স্পষ্টত বিভ্রান্তিতে রয়েছে।’ (সুরা জুমার ২২) কোরআন অন্তরের কঠোরতা দূর করার মহৌষধ। কোরআন তেলাওয়াত যেমন হৃদয়ের কাঠিন্য দূর করে, তেমনি জীবনের পাপ-পঙ্কিলতাকে ধুয়ে মুছে সাফ করে দেয়। ফলে মানব হৃদয়ে আল্লাহভীতি জাগ্রত হয়। কাজেই আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে আত্মশুদ্ধির প্রকৃত পথ ও পদ্ধতি অনুসরণ করে আত্মশুদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তি লাভের তাওফিক দান করুন। আমিন।