বিশ্ব কন্যাশিশু দিবস
কন্যাশিশু: পরিবারের বরকত ও জান্নাতের চাবিকাঠি
প্রতিবছর ১১ অক্টোবর “বিশ্ব কন্যাশিশু দিবস” পালিত হয়। বিশ্বজুড়ে কন্যাশিশুর অধিকার, নিরাপত্তা ও শিক্ষার বার্তা পৌঁছে দিতে। আধুনিক সমাজে এই দিনটি অনেক মানবিক আহ্বানের প্রতীক হলেও, চৌদ্দশত বছর আগে ইসলাম যে মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করেছিল, তা আজও সকল সময়ের চেয়ে অধিক প্রাসঙ্গিক। কেননা কন্যাশিশুকে ঘৃণিত, অবজ্ঞার চোখে দেখার যুগে ইসলামই প্রথম ঘোষণা দিয়েছিল—وَإِذَا الْمَوْءُودَةُ سُئِلَتْ، بِأَيِّ ذَنبٍ قُتِلَتْ
‘যখন জীবন্ত কবর দেওয়া কন্যাশিশুকে জিজ্ঞাসা করা হবে—কোন অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছিল?’ (সুরা তাকওীর, আয়াত: ৮–৯)
এই আয়াত ছিল নারী শিশুর প্রতি মানবতার প্রথম বিপ্লবী আহবান।
ইসলাম শুধু কন্যাশিশু হত্যাকে নিষিদ্ধ করেনি; বরং তাকে রহমত, বরকত, ও জন্নাতের দরজা বলে ঘোষণা দিয়েছে। মহানবী (সা.)-এর দৃষ্টিতে কন্যাশিশু
রাসূলুল্লাহ (সা.) কন্যাশিশুর প্রতি বিশেষ মমতা দেখিয়েছেন। হাদিসের বর্ণিতি হয়েছে-
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم “ مَنْ عَالَ جَارِيَتَيْنِ حَتَّى تَبْلُغَا جَاءَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَنَا وَهُوَ ” . وَضَمَّ أَصَابِعَهُ .
‘আনাস ইবনু মালিক (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি দুটি মেয়ে সন্তানকে সাবালক হওয়া পর্যন্ত প্রতিপালন করে, কিয়ামতের দিনে সে ও আমি এমন পাশাপাশি অবস্থায় থাকব, এ বলে তিনি তার হাতের আঙ্গুলগুলো মিলিয়ে দিলেন।; (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৬৩১)
এ থেকে স্পষ্ট যে. ইসলাম কন্যাশিশুকে কোনো বোঝা নয়, বরং জান্নাতের হাতিয়ার হিসেবে দেখেছে। যে পিতা-মাতা তাদের ভালোবাসে, শিক্ষায়-নৈতিকতায় গড়ে তোলে, তারা আসলে জান্নাত অর্জনের পথে চলছে।
অন্য এত হাদিসে এসেছে-عَنْ عَائِشَةَ، أَنَّهَا قَالَتْ جَاءَتْنِي مِسْكِينَةٌ تَحْمِلُ ابْنَتَيْنِ لَهَا فَأَطْعَمْتُهَا ثَلاَثَ تَمَرَاتٍ فَأَعْطَتْ كُلَّ وَاحِدَةٍ مِنْهُمَا تَمْرَةً وَرَفَعَتْ إِلَى فِيهَا تَمْرَةً لِتَأْكُلَهَا فَاسْتَطْعَمَتْهَا ابْنَتَاهَا فَشَقَّتِ التَّمْرَةَ الَّتِي كَانَتْ تُرِيدُ أَنْ تَأْكُلَهَا بَيْنَهُمَا فَأَعْجَبَنِي شَأْنُهَا فَذَكَرْتُ الَّذِي صَنَعَتْ لِرَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ “ إِنَّ اللَّهَ قَدْ أَوْجَبَ لَهَا بِهَا الْجَنَّةَ أَوْ أَعْتَقَهَا بِهَا مِنَ النَّارِ ” .
‘আয়িশাহ (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একবার এক অসহায় স্ত্রী তার দুটি মেয়ে সন্তানসহ আমার নিকট আসলো।
আমি তাদেরকে তিনটি খেজুর খেতে দিলাম। সে দু’ মেয়ের প্রত্যেককে একটি করে খেজুর দিল এবং একটি নিজে খাবার জন্যে তার মুখে তুলল। সে মুহুর্তে মেয়ে দুটি এ খেজুরটিও খেতে চাইল। সে তখন নিজে খাবার জন্যে যে খেজুরটি মুখে তুলেছিল সেটি তাদের উভয়ের মাঝে বণ্টন করে দিল। তার এ আচরণ আমাকে আশ্চর্য করে দিল।
পরে আমি সে যা করেছে তা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সমীপে আলোচনা করলাম। তিনি বললেন, আল্লাহ তা’আলা এ কারণে তার জন্যে জান্নাত আবশ্যক করে দিয়েছেন অথবা তিনি তাকে এ কারণে জাহান্নাম হতে মুক্তি দিয়েছেন।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৬৩০)
কন্যাশিশুর প্রতি সমাজের দায়
বর্তমান সমাজে কন্যাশিশুরা নানাভাবে বৈষম্যের শিকার। শিক্ষায়, নিরাপত্তায়, এমনকি উত্তরাধিকারেও। অথচ ইসলামে এসব ক্ষেত্রে রয়েছে ন্যায়বিচারের দৃষ্টান্ত। পবিত্র কোরআনে ঘোষিত হয়েছে:
یُوۡصِیۡكُمُ اللّٰهُ فِیۡۤ اَوۡلَادِكُمۡ ٭ لِلذَّكَرِ مِثۡلُ حَظِّ الۡاُنۡثَیَیۡنِ ۚ فَاِنۡ كُنَّ نِسَآءً فَوۡقَ اثۡنَتَیۡنِ فَلَهُنَّ ثُلُثَا مَا تَرَكَ ۚ وَ اِنۡ كَانَتۡ وَاحِدَۃً فَلَهَا النِّصۡفُ ؕ …
‘আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের সন্তানদের সম্পর্কে নির্দেশ দিচ্ছেন, এক ছেলের জন্য দুই মেয়ের অংশের সমপরিমাণ। তবে যদি তারা দুইয়ের অধিক মেয়ে হয়, তাহলে তাদের জন্য হবে, যা সে রেখে গেছে তার তিন ভাগের দুই ভাগ; আর যদি একজন মেয়ে হয় তখন তার জন্য অর্ধেক…’ (সূরা আন-নিসা, আয়াত : ১১)
এখানে কন্যার জন্য ছেলে অর্ধেক হওয়া কোনো বৈষম্য নয়; বরং সামাজিক দায়িত্বের ভার অনুযায়ী ন্যায্য বণ্টন। ইসলাম কন্যাকে উত্তরাধিকারী করেছে, শিক্ষার অধিকার দিয়েছে, এমনকি পিতা-মাতার পরিচর্যায় অগ্রাধিকারও দিয়েছে। কিন্তু ওপর করও ভরণ পোষণের দায়িত্ব চাপায়নি।
ইসলামী ইতিহাসে নারীর অবদান
ইতিহাসে দেখা যায়, কন্যাশিশুদের শিক্ষা ও সম্মান রক্ষায় ইসলামি সভ্যতা ছিল পথিকৃৎ। নবী কন্যা ফাতিমা (রা.) ছিলেন তাঁর চোখের মণি। নবী (সা.) তাঁকে দেখলে উঠে দাঁড়াতেন, চুম্বন করতেন, পাশে বসাতেন।
তাঁর সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেছেন—قَالَ فَاطِمَةُ بَضْعَةٌ مِنِّيْ فَمَنْ أَغْضَبَهَا أَغْضَبَنِي
‘ফাতিমা আমার অংশবিশেষ; তাকে যে কষ্ট দেয়, সে আমাকে কষ্ট দেয়।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩৭১৪)
ইতিহাসের অন্য প্রান্তে রয়েছেন আয়িশা (রা.), উম্মে সালামা (রা.), রুবাইয়্যি বিনতে মুআওয়িয (রা.)—যাঁরা জ্ঞানে, ফতোয়ায়, চিকিৎসা ও সমাজকর্মে ছিলেন অগ্রগণ্য। তাঁরা প্রমাণ করেছেন, কন্যাশিশু সঠিকভাবে প্রতিপালিত হলে সে জাতির জন্য অমূল্য সম্পদ হয়ে ওঠে।
আজকের দায়িত্ব ও করণীয়
আজও বিশ্বের বহু স্থানে কন্যাশিশু জন্মের আগেই অবাঞ্ছিত, বিদ্যালয়ে অনিরাপদ, পুষ্টিতে বঞ্চিত। অথচ ইসলাম আমাদের শিক্ষা দিয়েছে যে, কন্যাশিশু হলো পরীক্ষার মাধ্যমে জান্নাতের টিকিট। তাই আমাদের করণীয়—
কন্যাশিশুকে ভালোবাসা, সম্মান ও ন্যায্য অধিকার দেওয়া।
তাদের শিক্ষায় বিনিয়োগ করা, ইসলামী ও আধুনিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ করা।
নির্যাতন ও যৌতুকপ্রথা প্রতিরোধে কাজ করা।
সমাজে “মেয়ে সন্তান বোঝা নয়, বরকত” এই দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিষ্ঠা করা।
কন্যাশিশু মানবতার অর্ধেক। ইসলাম সেই অর্ধেককে সম্মান দিয়েছে, যেন অন্য অর্ধেক পূর্ণতা পায়। আজকের বিশ্ব কন্যাশিশু দিবসে আমরা যেন সেই মহান আহ্বানে ফিরে যাই—
যে শিক্ষা নবী করিম (সা.) দিয়েছিলেন চৌদ্দশত বছর আগে—
“কন্যাশিশুকে ভালোবাসো, লালন করো, তাতে তোমাদের জন্য জান্নাত রয়েছে।”