পরকালের পথে মুমিনের যাত্রা
আল্লামা আশরাফ আলী থানবি (রহ.)
পার্থিব জীবনের স্থিরতা ও নিশ্চলতার বিপরীতে পরকালের মানুষের যাত্রা তিন প্রকার- বিশ্বাসের গতিশীলতা, কাজের গতিশীলতা এবং অবস্থার গতিশীলতা। যে নিজেকে পরকালের পথিক মনে করে তার বিশ্বাস, কাজ ও অবস্থায় তার প্রতিফলন থাকবে। সে পরলোকের আকর্ষণ ও চিন্তায় সর্বদা অস্থির থাকবে। সে পরকালেরই অনুসন্ধান করে যাবে।
পরকালে অবিশ্বাসীদের মধ্যে এই গতি ও তাড়া নেই। কেননা তাদের বিশ্বাস সুস্থ ও সঠিক নয়। দুনিয়ামুখী মুসলমানদের মধ্যে বিশ্বাসের গতি থাকলেও কাজের ও অবস্থার গতি নেই। তারা পরকালে বিশ্বাস করলেও তাদের কাজ, ধ্যানজ্ঞান ও চেষ্টায় তা অনুপস্থিত।
কোনো অনুসন্ধান নেই। এই রোগটি মুসলিম সমাজে ব্যাপক। সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, আলেম সমাজেরও মন পরকালের চিন্তায় অস্থির নয়। অথচ কারো বিরুদ্ধে পৃথিবীর আদালতে কোনো মামলা দায়ের হলে তার মন অস্থির হয়ে যায়।
তখন তার মনে শান্তি ও স্থিরতা থাকে না। দেশে যখন প্লেগ মহামারি আকারে দেখা দিয়েছিল, তখন সবার মনে কেমন অস্থিরতা বিদ্যমান ছিল! সামান্য সময়ের জন্যও মনে শান্তি ছিল না। পরকালের জন্য আমাদের মনে অস্থিরতা নেই, কোনো ভাবান্তর নেই।
বেশির ভাগ মুমিনের অবস্থা হলো, বর্তমান অবস্থা থেকে দ্বিনি উন্নতির কোনো চিন্তা ও চেষ্টা নেই। যেমন- যথানিয়মে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ছি। এতেই আমরা স্থির আছি, এর বাইরে অতিরিক্ত নফল নামাজ পড়ার চিন্তা বা চেষ্টা কখনো করি না। কখনো এমন ভাবি না যে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজই আমি ঠিকমতো আদায় করছি কি না।
এমন চিন্তাও পরকালের পথে অগ্রগতির একটি দিক, যা আমরা পরিত্যাগ করেছি। মোটকথা, আমরা নিজ নিজ অবস্থায় স্থির হয়ে আছি এবং তা নিয়েই তৃপ্তি বোধ করছি। এটাকেই যথেষ্ট মনে করছি। অথচ আমাদের অবস্থা এমন হওয়া উচিত ছিল যে সব কিছু করার পরও আল্লাহর ভয়ে আমরা ভীত ও সন্ত্রস্ত থাকব।
মহান আল্লাহ বলেন, ‘এবং যারা তাদের প্রতিপালকের কাছে প্রত্যাবর্তন করবে এই বিশ্বাসে যে তাদের যা দান করার তা দান করে ভীত-কম্পিত হৃদয়ে, তারাই দ্রুত সম্পাদন করে কল্যাণকর কাজ এবং তারা তাতে অগ্রগামী হয়।’ (সুরা : মুমিনুন, আয়াত : ৬০-৬১)
কোনো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অধীন কর্মচারীরা খুব তৎপর হয়ে কাজ করার পরও তাদের মনে ভয় হয়, হয়তো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাদের কাজ গ্রহণ করবেন না। কর্মকর্তার আগমনের সময় হলে তাদের হৃদয়ে অস্থিরতা ও চাঞ্চল্য বিরাজ করে। তারা ভয় পেতে থাকে, না জানি আমার পরিণাম কী হয়! মুসলমানের অন্তরের অবস্থাও ঠিক এমনই হওয়া উচিত। মুসলমানের হৃদয় পরকালের ব্যাপারে কখনো নিশ্চিন্ত ও স্থির হতে পারে না। আল্লাহপ্রেমের সাধনাকারী সালিকের অবস্থা এমন না হলে মনে করতে হবে যে কিছুই অর্জিত হয়নি।
আম্বিয়ায়ে কিরাম সব দিক বিবেচনায় মুক্তিপ্রাপ্ত ও সফল হওয়া সত্ত্বেও সব সময় পরকালের ব্যাপারে চিন্তিত থাকতেন। বিপরীতে আমাদের পরকালীন জীবনের পথে কোনো অগ্রগতি না থাকা সত্ত্বেও আমরা কেমন আনন্দে দিন পার করছি! আমরা নিজের পরহেজগারি নিয়ে গর্ব বোধ করি। নিশ্চিতভাবে আমরা নবীদের থেকে অধিক আল্লাহভীরু নই। আল্লাহর ভয়ে তাঁদের প্রাণ ছিল ওষ্ঠাগত। মুসলমানের করণীয় সম্পর্কে একজন কবি বলেন, ‘প্রেম কী? বলো, প্রিয়জনের আজ্ঞাবহ দাস হওয়া এবং স্বীয় ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষাকে তারই ইচ্ছাধীন করে অস্থির ও পেরেশান থাকার নাম প্রেম।’
এই চিন্তা ও চাঞ্চল্য আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য, নিজের দ্বিনি উন্নতি করার জন্য। আল্লাহর নৈকট্যের কোনো সীমা নেই, কাজেই এক নির্দিষ্ট পরিমাণ নৈকট্য লাভ করে বিরত ও তৃপ্ত হওয়া যায় না। আল্লাহর দরবারের অবস্থা হলো, তুমি যতই উন্নতি লাভ করো না কেন, তা নিতান্ত সামান্য। একজন কবি বলেন, ‘ভাই! আল্লাহর দরবার একটি সীমাহীন দরবার। তার যতই কাছে পৌঁছবে, ততই সে অতিক্রান্ত পথ চিহ্নবিহীন অনতিক্রান্ত বলে বোধ হবে।’
পৃথিবীতে এমন বহু ধনী আছে, তারা পৃথিবীতে যতই উন্নতি লাভ করুক না কেন, কোনো পর্যায়েই তৃপ্ত হয় না। যে পরিমাণ ভূমিরই মালিক হোক না কেন, তাতে তৃপ্তি আসে না। বরং আরো বেশি সম্পদ ও ভূমির মালিক হওয়ার স্বপ্নে বিভোর থাকে।
সারকথা হলো, যার যে জিনিস অর্জনের দুর্দমনীয় আকাঙ্ক্ষা থাকে তা লাভ করে সে কখনো তৃপ্ত হয় না। দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় হলো, পরকালের ব্যাপারে মানুষের মন তৃপ্ত হয়ে যায়। মাওলানা রুমি (রহ.) বলেন, ‘এই নশ্বর পৃথিবীর ভালোবাসায় তোমার আত্মা তৃপ্ত হয় না। কিন্তু জগত্গুলোর সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তাআলা থেকে তোমার মন কিভাবে তৃপ্ত হয়ে গেল। স্ত্রী-পুত্রের ভালোবাসা থেকে তোমার মন তৃপ্ত হলো না, তবে দয়াল আল্লাহর ভালোবাসা থেকে কেন তুমি তৃপ্ত হয়ে গেলে?’
পৃথিবীর ঝামেলায় কখনো তোমাদের মন বিরক্ত হয় না; কিন্তু আল্লাহ ও রাসুল (সা.) থেকে বিরক্ত হয়ে একদম ঠাণ্ডা হয়ে বসে গেলে? কোথায় আগ্রহ! কোথায় উৎসাহ! কোনো চিন্তাই নেই যে ভবিষ্যতে কী হবে? তবে আমাদের মূল রোগ হলো, পার্থিব জীবনের প্রতি আমরা সন্তুষ্ট হয়ে গেছি। যারা সত্যিকার অর্থে নিজের দ্বিনি উন্নতি চায়, কবির ভাষায় তাদের অবস্থা হলো, ‘প্রিয়জন বুকেই আছে, তবু প্রিয়জনকেই খুঁজি। নদীর তীরে বসে আছি, কিন্তু তৃষ্ণায় ঠোঁট শুকিয়ে গেছে।’
বন্ধুগণ! নিজের ভেতর পরকালের চিন্তা জাগ্রত করুন। আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন হোন। পরকালের চিন্তা ও ধ্যান জাগ্রত করার পদ্ধতি হলো, মুরাকাবা করা, আল্লাহওয়ালাদের সঙ্গে থাকা, আল্লাহর জিকির করা, দিনরাত আল্লাহর মহিমা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা ইত্যাদি। আল্লাহ সবাইকে তাঁর ধ্যানে মগ্ন থাকার তাওফিক দিন। আমিন।
মাওয়ায়েজে আশরাফিয়া থেকে আলেমা হাবিবা আক্তারের ভাষান্তর।