মানুষের সম্মান সুরক্ষায় ইসলামের বিধান
দৈনিকসিলেট ডেস্ক :
সৃষ্টিগতভাবে মানুষ দুর্বল প্রকৃতির অধিকারী। তার কথা, কাজ, আচার-আচরণে মানবিক এই দুর্বলতা নানাভাবে প্রকাশ পায়।
মুসলমানের দায়িত্ব তার ভাইয়ের এই দুর্বলতাগুলো আড়াল করা। যাতে তার সম্মানহানি না ঘটে। হ্যাঁ, যদি তার দ্বারা সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষতি হওয়ার ভয় থাকে, তবে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে তা প্রকাশ করার সুযোগ আছে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার কামনা করে, তাদের জন্য আছে দুনিয়া ও আখিরাতের মর্মন্তুদ শাস্তি এবং আল্লাহ জানেন, তোমরা জানো না। ’ (সুরা : নুর, আয়াত : ১৯)
ইমাম কুরতুবি (রহ.) আয়াতের অর্থ এভাবে করেছেন, যারা মুমিনদের থেকে এমন কথার প্রসার কামনা করে, যা পূতঃপবিত্র নারী ও পুরুষের সম্ভ্রমহানির কারণ হয়, তাদের জন্য আছে দুনিয়া ও আখিরাতে মর্মন্তুদ শাস্তি। (তাফসিরে কুরতুবি)
মানুষের সম্ভ্রম গুরুতর বিষয়: মানুষের সম্ভ্রমকে মানুষ গুরুত্ব না দিলেও তা আল্লাহর কাছে গুরুতর বিষয়।
অজ্ঞ মানুষরাই তাকে গুরুত্ব দেয় না। ইরশাদ হয়েছে, ‘যখন তোমরা মুখে মুখে তা ছড়াচ্ছিলে এবং এমন বিষয় মুখে উচ্চারণ করছিলে, যার কোনো জ্ঞান তোমাদের ছিল না এবং তোমরা তাকে তুচ্ছ গণ্য করছিলে, যদিও আল্লাহর কাছে তা ছিল গুরুতর বিষয়। ’ (সুরা : নুর, আয়াত : ১৫)
সম্ভ্রমহানি নিষিদ্ধ: শরিয়তে মানুষের সম্মান ও সম্ভ্রমহানি নিষিদ্ধ। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) মিম্বারে উঠে চিৎকার দিয়ে বললেন, হে লোকেরা, যারা মুখে ইসলাম গ্রহণ করেছ, কিন্তু অন্তরে এখনো ঈমান দৃঢ় হয়নি! তোমরা মুসলমানদের কষ্ট দেবে না, তাদের লজ্জা দেবে না এবং তাদের গোপন দোষ অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হবে না।
কেননা যে ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইয়ের গোপন দোষ অনুসন্ধানে লিপ্ত হয়, আল্লাহ তার গোপন দোষ প্রকাশ করে দেবেন। আর যে ব্যক্তির দোষ আল্লাহ প্রকাশ করে দেবেন, তাকে অপমান করে ছাড়বেন, সে তার উটের হাওদার ভেতরে অবস্থান করে থাকলেও। (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ২০৩২)
অপরাধ প্রমাণের আগে দোষী নয়: ইসলাম অপরাধ প্রমাণের আগে কোনো ব্যক্তিকে দোষী বলে না এবং অপরাধের প্রচার করতে বারণ করে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা কেন এ ব্যাপারে চারজন সাক্ষী উপস্থিত করেনি; যেহেতু তারা সাক্ষী উপস্থিত করেনি, সে কারণে তারা আল্লাহর কাছে মিথ্যাবাদী। ’ (সুরা : নুর, আয়াত : ১৩)
ইসলামী আইনজ্ঞরা বলেন, অপরাধ প্রমাণের আগে ব্যক্তি অপরাধী নয় বলেই রাসুলুল্লাহ (সা.) মুনাফিকদের শাস্তি দেননি। (শরহু আল-আহাদিস আস-সাহিহা, পৃষ্ঠা ৩৬৮)
সুধারণাই মুমিনের পাথেয়: সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়ার আগ পর্যন্ত মুমিন অন্য কোনো মুমিনের ব্যাপারে মন্দ ধারণা পোষণ করবে না। আল্লাহ বলেন, ‘যখন তারা তা শুনল, তখন মুমিন পুরুষ এবং মুমিন নারীরা আপন লোকদের সম্পর্কে কেন ভালো ধারণা করল না এবং বলল না, এটা তো সুস্পষ্ট অপবাদ। ’ (সুরা : নুর, আয়াত : ১২)
মুমিন চুপ থাকে, আড়াল করে: মানুষের দোষ-ত্রুটি ছড়িয়ে দেওয়া মুমিনের বৈশিষ্ট্য নয়, বরং তার বৈশিষ্ট্য হলো অন্যের সম্মান-সম্ভ্রম নষ্ট হয় এমন বিষয়ে চুপ থাকা, মুমিনের দোষ গোপন করা। মহান আল্লাহ বলেন, ‘এবং তোমরা যখন এটা শ্রবণ করলে, তখন কেন বললে না, এ বিষয়ে বলাবলি করা আমাদের উচিত নয়, আল্লাহ পবিত্র, মহান। এটা তো এক গুরুতর অপবাদ। ’ (সুরা : নুর, আয়াত : ১৬)
তবে সমাজ, দেশ ও জাতির বৃহত্তর ক্ষতির আশঙ্কা থাকলে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে দোষ প্রকাশ করা নিন্দনীয় নয়।
সম্মান রক্ষার পুরস্কার: যে ব্যক্তি অন্যের সম্মান রক্ষার জন্য তার দোষ গোপন করে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে পুরস্কৃত করবেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি কোনো মুসলমানের দোষ গোপন করবে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার দোষ গোপন করবেন। (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৪৮৯৩)
নিজেরও আছে দায়: সম্মান-সম্ভ্রম রক্ষায় নিজেরও দায় রয়েছে। কোনো মুমিন যদি পাপ করে ফেলে, তবে তা গোপন রাখবে এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে। মহানবী (সা.) বলেন, আমার সব উম্মতকে মাফ করা হবে, তবে প্রকাশকারী ছাড়া। আর নিশ্চয়ই এটা বড়ই অন্যায় যে কোনো লোক রাতের বেলা অপরাধ করল, যা আল্লাহ গোপন রাখলেন। কিন্তু সে সকাল হলে বলে বেড়াতে লাগল, হে অমুক! আমি আজ রাতে এই কাজ করছি। অথচ সে এমন অবস্থায় রাত কাটাল যে, আল্লাহ তার কর্ম লুকিয়ে রেখেছিলেন, আর সে ভোরে উঠে তার ওপর আল্লাহর দেওয়া আবরণ খুলে ফেলল। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬০৬৯)
তাওবা করার পর গালমন্দ নয়: কোনো ব্যক্তি কোনো অপরাধ করার পর যদি তাওবা করে, তবে তাকে গালমন্দ করা যাবে না। কেননা রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, গুনাহ থেকে তওবাকারী এমন যেন তার কোনো গুনাহ নেই। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৪২৫০)
শাস্তি ভোগের পর গালমন্দ নয়: কোনো ব্যক্তি কোনো অপরাধ করার পর যদি শাস্তি ভোগ করে, তবে তাকেও গালমন্দ করা যাবে না। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.)-এর কাছে এক লোককে আনা হলো, সে মদ পান করেছিল। তিনি বললেন, তোমরা একে প্রহার করো। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, তখন আমাদের মধ্য থেকে কেউ হাত দিয়ে প্রহার করল, কেউ জুতা দিয়ে মারল, আর কেউ কাপড় দিয়ে মারল। মারধর যখন থামল, তখন কেউ বলে উঠল, আল্লাহ তোমাকে লাঞ্ছিত করুন। নবী (সা.) বললেন, এমন বোলো না, শয়তানকে এর বিরুদ্ধে সাহায্য কোরো না। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৭৭৭)
আল্লাহর সবার সম্মান ও সম্ভ্রম রক্ষা করুন। আমিন।