মনু নদীর পাড়ে পড়ে আছে কোটি কোটি টাকার বালু
দৈনিকসিলেট ডেস্ক :
মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার হাজীপুর ও টিলাগাঁও ইউনিয়নে মনু নদীর দুই তীরে পড়ে আছে কোটি কোটি টাকার বালু। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তোলা হয়েছে এসব বালু। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, এসব বালুর ইজারাদার বিক্রির অজুহাতে জোরপূর্বক লুটের অপচেষ্টা চালালে তারা বাধা দেন। এতে এলাকায় উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এর জের ধরে যে কোনো সময় বড় ধরনের সংঘর্ষের আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। এসব বালুর ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। অভিযোগের পরিপ্রক্ষিতে সরেজমিন তদন্তক্রমে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কুলাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে চিঠি দিয়েছেন মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক। এদিকে নদীর তীরে বিশাল আকারের কমপক্ষে ১০টি বালুর স্তূপ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন দুই শতাধিক কৃষক। আউশ, আমন আর সবজি ক্ষেত সবই বিনষ্ট হচ্ছে এসব বালুর কারণে। বালুর ব্যাপারে অভিজ্ঞ লোকজন জানান, স্তূপ করে রাখা এসব বালুর বাজারমূল্য ১০ কোটি টাকারও বেশি হবে। যদি বালুগুলো নিলামে বিক্রি করা হয় তাহলে সরকার কোটি টাকা রাজস্ব পাবে।
এ বিষয়ে কুলাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মহিউদ্দিন বলেন, জেলা প্রশাসক মহোদয় এ ব্যাপারে বিধি মোতাবেক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এদিকে জমাটবদ্ধ এসব বালুর বিষয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসকের কাছে বর্তমান ইজারাদার খালেদ আহমদ একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। লিখিত অভিযোগে তিনি উল্লেখ করেছেন, সাবেক ইজারাদার বালু স্তূপ করে রাখায় তিনি ইজারাকৃত স্থান থেকে বালু উত্তোলন ও পরিবহন করতে পারছেন না। এতে তিনি আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। তাছাড়া সাবেক ইজারাদার বালু বিক্রি ও বিপণনের পাঁয়তারায় লিপ্ত। বালু ও মাটি ব্যবস্থাপনা (সংশোধন) আইন ২০১০-এর ধারা ৭-এর ক ও খ অনুসারে ইজারা গ্রহীতা কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান উত্তোলিত বালু বা মাটি কোনোক্রমেই সর্বসাধারণের ব্যবহার্য রাস্তা বা রাস্তা সংলগ্ন স্থান, খেলার মাঠ, পার্ক বা উন্মুক্ত স্থানে স্তূপ আকারে রেখে স্বাভাবিক চলাচলে বিঘ্ন ও জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করতে পারবে না। এছাড়া ইজারা গ্রহীতা কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান উত্তোলিত বালু বা মাটি সংশ্লিষ্ট মালিক বা আইনানুগ ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তির অনুমতি ব্যতীত স্থানীয় জনগণের জমিতে বা সরকারের জায়গায় বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের মাঠে কিংবা আঙিনায় স্তূপ আকারে রাখতে পারবে না। কিন্তু আইনের তোয়াক্কা না করে স্থানীয়দের জমিতে স্তূপ করে রাখা হয়েছে বিপুল পরিমাণ বালু।
সরেজমিন দেখা যায়, বিশাল জায়গাজুড়ে স্তূপ করে রাখা হয়েছে নদী থেকে তোলা বিপুল পরিমাণ বালু। একেকটি বালুর স্তূপ যেন একেকটি পাহাড়! ২০ থেকে ৩০ ফুট উচ্চতার এসব বালুর স্তূপের একেকটির আয়তন ৫ থেকে ১০ একর পর্যন্ত। মনু নদীর টিলাগাঁও ইউনিয়ন অংশে সালন ও গন্ডারগড় এলাকায় এবং হাজীপুর ইউনিয়নের মন্দিরা ও হরিচক এলাকায় বৃহৎ আকারের অন্তত ১০টি বালুর পাহাড় রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মনু নদীর বালুমহালের সাবেক ইজারাদার দীপক দাস ১ কোটি ৮০ লাখ টাকায় ইজারা নেন। তিনি এসব বালুর ইজারাদার হলেও নেপথ্যে ছিলেন বিগত আওয়ামী লীগের অনেক রাঘববোয়াল। তারা দল ও ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে মানুষের জমিতে বালুগুলো স্তূপ করে রাখেন।
কথা হয় হরিচক, মন্দিরা, সালন ও গন্ডারগড় গ্রামের কৃষক কবির মিয়া, আলীম, আশীষ দাস, সাজ্জাদ মিয়া, নেপাল ও খসরু মিয়ার সঙ্গে। এ সময় তারা অভিযোগ করেন, তারা সবাই কৃষিনির্ভর পরিবার। কৃষিকাজ করেই তাদের জীবিকা নির্বাহ হয়। ধান ও শীতকালীন সবজি বিক্রি করে বছরে তারা ভালোই রোজগার করতেন। কিন্তু এসব বালুর স্তূপের কারণে এলাকার দুই শতাধিক কৃষক ফসল ও শীতকালীন সবজি চাষে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। বিগত বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানির সঙ্গে মিশে বালু গিয়ে পড়ে কৃষি জমিতে। এতে বহু কৃষিজমি বিনষ্ট হয়। আউশ ও আমন ধান সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায়। শীতকালীন সবজি আবাদ করাও সম্ভব হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে পুরো বছরে কৃষির যে বিপুল ক্ষতি হয়েছে তার জন্য ইজারাদারের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ দাবি করেছেন ভুক্তভোগী কৃষকরা।
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বালুমহালের সাবেক ইজারাদার দীপক দাস হাজীপুর ইউনিয়নের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে ম্যানেজ করে বালুগুলো সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন। বালু বিক্রির অজুহাতে একাধিকবার স্তূপকৃত এসব বালু নিতে জোরপূর্বক লুটের চেষ্টাও চালিয়েছেন ইজারাদার।