শত বছর ধরে যে শহরে থাকে না কেউ
দক্ষিণ-পশ্চিম তুরস্কের মুগলা প্রদেশের শহর কায়াকোয়। এক সময় সেখানে ছিল মর্যাদাপূর্ণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ছোট ছোট সড়ক, সারিবদ্ধ বাড়িঘর খাড়া উপত্যকার দিকে উঠে গেছে। শহরের মাঝখানে প্রাচীন ঝরনা। আছে বেশ কয়েকটি গির্জাও। উঁচু স্থানটি থেকে নীল এজিয়ান সাগরের জলরাশি চোখে ভাসে। গত ১০০ বছর ধরে শহরটিতে কোনো মানুষ থাকে না।
সুনসান নীরবতার কায়াকোয় যেন সত্যিকারের ‘ভূতের শহর’। বাসিন্দারা এটা পরিত্যক্ত হিসেবে ফেলে গেছেন; অতীত একে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। এটি এখন এক স্মৃতিস্তম্ভ, সময়ের গভীরে হিমায়িত। কার্যত এটি তুরস্কের অন্ধকার সময়ের এক বাস্তব স্মারক।
পাহাড়ের ঢালে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবন ধীরে ধীরে সবুজের আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে। এগুলো যেন অদৃশ্য জীবনের অন্তহীন দৃশ্য। বর্তমানে শহরটি দেখার জন্য অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও সুন্দর জায়গা। গ্রীষ্মকালে পরিষ্কার আকাশ ও প্রখর রোদ থাকে। আর শীতে আবৃত হয়ে থাকে পাহাড় বা সমুদ্র থেকে আসা কুয়াশায়।
কায়াকোয় শহরটি লেভিসি নামেও পরিচিত। এক শতাব্দী আগে এটি কমপক্ষে ১০ হাজার গ্রিক অর্থোডক্স খ্রিষ্টানের একটি ব্যস্ত শহর ছিল, যাদের অনেকেই ছিলেন কারিগর। তারা এ অঞ্চলের মুসলিম তুর্কি কৃষকদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণভাবে বাস করতেন। কিন্তু তুরস্কের স্বাধীন প্রজাতন্ত্র হিসেবে উত্থানকে ঘিরে যে অস্থিরতা তৈরি হয়, তাতে তাদের সরল জীবন ভেঙে পড়ে।
১৯২২ সালে গ্রিক-তুর্কি যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর প্রতিবেশী গ্রিসের সঙ্গে উত্তেজনায় উভয় দেশই একে অপরের সম্পর্কযুক্ত লোকদের তাড়িয়ে দেয়। এ সময় কায়াকোয় বাসিন্দারা যান গ্রিসে, আর গ্রিসের কাভালায় বসবাসকারী তুর্কিরা আসেন তুরস্কে। কিন্তু নতুন করে আসা তুর্কিরা এ শহরে থাকতে অস্বীকৃতি জানান। ফলে কায়াকোয় পড়ে যায় অবহেলায়; হয়ে পড়ে মানবশূন্য।
শহরের বাসিন্দাদের মধ্যে খুব অল্পসংখ্যক এখন জীবিত আছেন। তাদের মধ্যে ছিলেন আয়সুন একিজের দাদা-দাদি, যার পরিবার কায়াকোয়র প্রধান প্রবেশপথের কাছে একটি ছোট রেস্তোরাঁ চালায়। এ রেস্তোরাঁটি শহর ঘুরে দেখতে আসা পর্যটকদের জন্য জলখাবার পরিবেশন করে। একিজ বলেন, ‘গ্রিক লোকেরা কাঁদছিল। কারণ, তারা শহর ছেড়ে যেতে চাইত না। কেউ কেউ তাদের বাচ্চাদের তুর্কি বন্ধুদের কাছে রেখে গিয়েছিলেন। তারা ভেবেছিলেন, তারা ফিরে আসবেন। কিন্তু তারা কখনও ফেরেননি।’
একিজ বলেন, তাঁর দাদা-দাদির পরিবার রাখাল ছিল। সহজেই শহরের প্রান্তে জীবনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতেন। তিনি বলেন, তাদের বেশির ভাগ সহকর্মী কায়াকোয়েতে থাকতে পছন্দ করতেন না। কারণ, বাড়ির দেয়াল নীল রং করা হয়েছিল। এটা করা হয়েছিল বিচ্ছু বা সাপ তাড়ানোর জন্য।
কায়াকোয়ে তৈরি প্রায় দুই হাজার ৫০০টি বাড়ির অবশিষ্ট দেয়ালে এখনও নীল রং দেখা যায়। আধুনিক যুগের দ্বারপ্রান্তে এটি যেন প্রাচীন জীবনধারার একটি স্ন্যাপশট হিসেবে অবশিষ্ট রয়ে গেছে। সূত্র: সিএনএন।