জামায়াতের পিআর প্রস্তাব এবং বিএনপির লাভ-ক্ষতি
বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন এক আলোচনার জন্ম দিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। দলটি সম্প্রতি আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পিআর পদ্ধতি বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন ব্যবস্থা চালুর দাবি তুলেছে।
এই দাবিকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অঙ্গনে সৃষ্টি হয়েছে নতুন উত্তাপ। অন্যদিকে, প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এখনো প্রচলিত একক আসনভিত্তিক নির্বাচন পদ্ধতিই বজায় রাখতে চায়।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, পিআর পদ্ধতি চালু হলে সবচেয়ে বেশি সুবিধা পেতে পারে বিএনপিই—দলটি হয়তো নিজের অজান্তেই জামায়াতের এই প্রস্তাব থেকে লাভবান হতে পারে।
পিআর বা Proportional Representation হলো এমন একটি নির্বাচন ব্যবস্থা, যেখানে সংসদীয় আসন বণ্টন হয় দলের প্রাপ্ত মোট ভোটের আনুপাতিক হারে। অর্থাৎ, একটি দল জাতীয়ভাবে ৩০ শতাংশ ভোট পেলে সংসদে প্রায় ৩০ শতাংশ আসন পাবে—চাই সে ভোট কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় বেশি হোক বা কম।
এই পদ্ধতি বিশ্বের অনেক গণতান্ত্রিক দেশে চালু রয়েছে—জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, দক্ষিণ আফ্রিকা, নরওয়ে, ইন্দোনেশিয়া, জাপানসহ বহু রাষ্ট্রে এই পদ্ধতিতেই নির্বাচন হয়।
জামায়াতের যুক্তি—বাংলাদেশে পিআর পদ্ধতি চালু হলে সংসদে সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে, বড় দলের একচ্ছত্র আধিপত্য কমবে, এবং কালো টাকার প্রভাব, মনোনয়ন বাণিজ্য ও সহিংসতা অনেকাংশে হ্রাস পাবে।
গত স্বৈরাচারী সরকারের দীর্ঘ পনেরো বছরের শাসনামলে বিএনপির নেতা-কর্মীদের জন্য রাজনীতি করা ছিল যেন এক অসম্ভব চ্যালেঞ্জ। দলের হাজারো নেতাকর্মী কারাবন্দি হয়েছেন, অসংখ্য মামলা ও হয়রানির মুখে পড়ে সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে সরে গেছেন অনেকে। ওই সময়ে দলীয় কার্যক্রম সীমিত ছিল মূলত নির্বাসন, কারাবাস এবং আন্দোলন–বিক্ষোভের মধ্যে। ফলে একটি পুরো প্রজন্ম নির্বাচনী রাজনীতির বাইরে থেকে গেছে।
এখন রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরিবর্তনের আভাস দেখা দিতেই বিএনপির তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত প্রার্থীপদে ব্যাপক আগ্রহ ও প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে গড়ে প্রতিটি আসনের জন্য আট থেকে দশজন করে মনোনয়ন প্রত্যাশী রয়েছেন। কোথাও কোথাও এই সংখ্যা পৌঁছেছে ১৫ জনের কাছাকাছি।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এত দীর্ঘ সময় পর নির্বাচনে ফেরার প্রস্তুতি নিতে গিয়ে বিএনপি এখন অভ্যন্তরীণ সমন্বয়ের সংকটে পড়েছে। অনেকে মনে করছেন, মনোনয়ন প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারলে দলটি অভ্যন্তরীণ বিরোধ ও সংঘাতের মুখোমুখি হতে পারে।
দলীয় সূত্র আরও জানায়, বিএনপির প্রতিটি জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে এখন মনোনয়ন লবিং, গ্রুপিং ও প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা চলছে। অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয় নেতারা রাজধানীতে অবস্থান নিয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছেন মনোনয়ন পাওয়ার আশায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও চলছে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা—কেউ নিজের উন্নয়ন কর্মসূচির ছবি পোস্ট করছেন, কেউ আবার স্থানীয় জনপ্রিয়তাকে তুলে ধরে নিজেদের ‘যোগ্য প্রার্থী’ হিসেবে প্রচার করছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই পরিস্থিতি যদি নিয়ন্ত্রণে আনা না যায়, তবে মনোনয়ন নিয়ে বিভক্তি ও বিদ্রোহী প্রার্থিতা বিএনপির জন্য বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে। একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশী একই আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামলে, ভোট ভাগ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
“বিএনপি ১৫ বছর ধরে নির্বাচনের বাইরে ছিল। এখন হঠাৎ করে যখন নির্বাচনী রাজনীতিতে ফিরতে চাইছে, তখন দলের ভেতরে স্বাভাবিকভাবেই নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা ও গ্রুপিং তৈরি হয়েছে। এই বাস্তবতায় যদি পিআর পদ্ধতির মতো আনুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা চালু হয়, তবে তা বিএনপির অভ্যন্তরীণ সংকট অনেকটাই প্রশমিত করতে পারে।”
বিএনপি নেতাদের মধ্যেও কেউ কেউ পরোক্ষভাবে স্বীকার করছেন যে, এত বিপুলসংখ্যক মনোনয়নপ্রত্যাশীর ভিড় সামাল দেওয়া এখন একটি বড় সংগঠনগত চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক কেন্দ্রীয় নেতা বলেন,
“দীর্ঘদিন আমরা ভোটের বাইরে ছিলাম। এখন সবাই অংশ নিতে চায়। এটা স্বাভাবিক। কিন্তু একই আসনে একাধিক শক্তিশালী প্রার্থী থাকলে সমন্বয় না হলে বিরাট বিপত্তি ঘটতে পারে।”
এই প্রেক্ষাপটে পিআর বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচনী ব্যবস্থা বিএনপির জন্য হতে পারে একটি কার্যকর সমাধান। এতে প্রার্থীপদ নয়, দলের জাতীয় ভোটের হারই মূল হয়ে উঠবে। ফলে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও মনোনয়ন-সংক্রান্ত সংঘাতের সুযোগও অনেকটাই হ্রাস পাবে।
সম্প্রতি বিএনপি যখন জোটের শরিক জুনায়েদ সাকি এবং ভিপি নূরুল হক নূর-এর জন্য দুটি আসন ছাড়ার ইঙ্গিত দেয়, তখন দলের বিভিন্ন পর্যায়ে বিক্ষোভ ও মিছিল হয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন—এই পরিস্থিতিতে পিআর পদ্ধতি চালু হলে বিএনপি অভ্যন্তরীণ সংঘাত এড়াতে পারে এবং দলীয় ঐক্য রক্ষা সহজ হবে।
রাজনীতি বিশ্লেষক ড. রেজাউল করিম সিদ্দিকী মনে করেন—“বিএনপি যেভাবে নানা উপদলে বিভক্ত ও বহুপ্রার্থী নির্ভর হয়ে পড়েছে, পিআর পদ্ধতিতে গেলে সেই সংকট অনেকটাই দূর হবে। এতে কেন্দ্রীয়ভাবে ভোটের হিসাবই হবে মুখ্য, প্রার্থীপদ নয়।”
জামায়াতে ইসলামী মনে করে—এই পদ্ধতি চালু হলে বাংলাদেশের গণতন্ত্র আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে। তাদের ভাষায়, এতে জনপ্রিয়তার ভিত্তিতে রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হবে, ব্যক্তি নির্ভর রাজনীতি কমবে, আর সংসদে বৈচিত্র্যময় মতাদর্শের সহাবস্থান তৈরি হবে। আমরা কোনো দলের বিপক্ষে নই। পিআর পদ্ধতি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির ভারসাম্য আনবে। এতে সব দলই লাভবান হবে—বিশেষ করে বিএনপি।
তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের সংবিধানে একক আসনভিত্তিক নির্বাচন পদ্ধতি স্পষ্টভাবে বর্ণিত। ফলে পিআর ব্যবস্থা চালু করতে হলে সংবিধান সংশোধন অপরিহার্য।
এ ছাড়া নির্বাচন কমিশনকেও পুরো ভোট গণনা ও আসন বণ্টনের কাঠামো পরিবর্তন করতে হবে। অর্থাৎ, বিষয়টি কেবল রাজনৈতিক নয়, প্রযুক্তিগত ও আইনি প্রক্রিয়ারও বড় চ্যালেঞ্জ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে সব জাতীয় নির্বাচনই একক আসনভিত্তিক পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হয়েছে।
১৯৭৩ সালের প্রথম সংসদ নির্বাচন থেকে শুরু করে ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত এই পদ্ধতির বাইরে কোনো বিকল্প চেষ্টা হয়নি।
তবে প্রতিবেশী দেশ নেপাল ও পাকিস্তানে আংশিক পিআর পদ্ধতির প্রয়োগ দেখা গেছে। ফলে দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপটে বিষয়টি নতুন নয়, কিন্তু বাংলাদেশের জন্য তা একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা আরো মনে করেন, পিআর পদ্ধতি চালু হলে বিএনপি জাতীয়ভাবে তাদের জনপ্রিয়তার ভিত্তিতে আসন পাবে। এতে ভোট ভাগ হয়ে গেলেও ক্ষতির আশঙ্কা কমে যাবে।
এছাড়া, বিদ্রোহী প্রার্থী ও মনোনয়নসংক্রান্ত সংঘাত এড়ানো যাবে, জোট রাজনীতি আরও স্থিতিশীল হবে।
আরও বড় সুবিধা হলো—একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনে বিএনপির মোট ভোট ব্যাংক যদি ৩০-৩৫ শতাংশ হয়, তবে সেই অনুপাতে তারা সংসদে শক্ত অবস্থান নিতে পারবে, যা একক আসনভিত্তিক নির্বাচনে সবসময় সম্ভব হয় না।
বাংলাদেশের রাজনীতি এক নতুন সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। জামায়াতের প্রস্তাবিত পিআর পদ্ধতি অনেকের কাছে ‘অবাস্তব’ মনে হলেও, এটি ভবিষ্যতের রাজনীতিতে নতুন চিন্তার দরজা খুলে দিতে পারে।
বিএনপি যদি বাস্তবতা বুঝে এই প্রস্তাবের নীতিগত দিক বিবেচনা করে, তবে তা তাদের জন্যও হতে পারে এক কৌশলগত সুবিধার সুযোগ।
তবে বাস্তবায়নের পথে বাধা—সংবিধান সংশোধন, রাজনৈতিক ঐকমত্য এবং নির্বাচন কমিশনের নীতিগত অবস্থান। সব মিলিয়ে, দেশের গণতন্ত্র কোন পথে যাবে—তা এখন নির্ভর করছে রাজনৈতিক নেতৃত্বের দূরদর্শিতা ও সংস্কার সাহসের ওপর।
লেখক: কবি ও সাংবাদিক, সম্পাদক দৈনিকসিলেটডটকম