এক অনুস্মরণীয় রাষ্ট্রদূতের গল্প
কূটনীতির অর্থনৈতিক পুনর্জাগরণে মুশফিকুল ফজল আনসারী

রাষ্ট্রদূত—এই শব্দটি কেবল একজন প্রশাসনিক প্রতিনিধি বা কূটনৈতিক বার্তাবাহককে বোঝায় না।তিনি একটি রাষ্ট্রের মুখ, সংস্কৃতির রূপকার এবং অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দূত। তাঁর আচরণে, সিদ্ধান্তে এবং কৌশলে প্রকাশ পায় একটি দেশের মর্যাদা, সম্ভাবনা ও দৃষ্টিভঙ্গি।
বাংলাদেশের আধুনিক কূটনীতির ইতিহাসে এমন এক ব্যক্তিত্ব, যিনি এই তিনটি ভূমিকাকেই একসূত্রে বেঁধেছেন, তিনি হলেন—মুশফিকুল ফজল আনসারী, মেক্সিকোতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত। মুশফিকুল ফজল আনসারীর কূটনৈতিক যাত্রা শুরু হয়নি প্রথাগত আমলাতান্ত্রিক পথ ধরে। তিনি ছিলেন একজন নির্ভীক সাংবাদিক—যিনি কখনও সত্য উচ্চারণে ভয় পাননি। ওয়াশিংটন ও জাতিসংঘে দায়িত্ব পালনকালে তিনি স্বৈরাচারী সরকারের অপকর্ম, গণতন্ত্রবিরোধী কর্মকাণ্ড ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে ধারালো প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলেন।
এই সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতাই তাঁর কূটনৈতিক দর্শনের ভিত তৈরি করে দেয়—যেখানে রাষ্ট্রের প্রতিনিধি মানে কেবল আনুষ্ঠানিক বার্তা পৌঁছানো নয়, বরং দেশের মানুষ, মূল্যবোধ ও সম্ভাবনাকে মর্যাদার সঙ্গে উপস্থাপন করা।
রাষ্ট্রদূত হওয়ার পর থেকেই মুশফিকুল ফজল আনসারী তাঁর দায়িত্বকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তিনি বারবার বলেছেন—“কূটনীতি মানে শুধু প্রোটোকল নয়; এটি দেশের অর্থনীতি, বিনিয়োগ, সংস্কৃতি এবং প্রবাসীদের সম্পৃক্ততার এক পূর্ণাঙ্গ রূপ।” তার এই দৃষ্টিভঙ্গি মেক্সিকোতে বাংলাদেশের উপস্থিতিকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। বিদেশের মাটিতে থেকেও তিনি ভুলে যাননি দেশের কল্যাণ, জনগণের মর্যাদা ও রপ্তানিকারকদের স্বপ্নের কথা।
দক্ষিণ এশিয়ার পর বাংলাদেশ এখন ধীরে ধীরে তার রপ্তানি বাজারকে ল্যাটিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলে সম্প্রসারিত করছে। এই অঞ্চলের ৩০টিরও বেশি দেশে রয়েছে ৬৫ কোটি মানুষের বিশাল বাজার। পোশাক, ওষুধ, আসবাব, চামড়াজাত পণ্য ও হালকা প্রকৌশল পণ্য—সব ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে।
রাষ্ট্রদূত মুশফিকুল ফজল আনসারী লক্ষ্য করেন, মেক্সিকোসহ ল্যাটিন আমেরিকার অনেক দেশ বাংলাদেশের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে আগ্রহী। কারণ—বাংলাদেশের পণ্য গুণগত মানসম্পন্ন, দামে প্রতিযোগিতামূলক এবং উৎপাদনশীলতায় নির্ভরযোগ্য। এই প্রেক্ষাপটেই মেক্সিকোর বৃহত্তম রিটেইলার প্রতিষ্ঠান “কোপেল”-এর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেন রাষ্ট্রদূত আনসারী। এটি ল্যাটিন আমেরিকার সবচেয়ে বড় খুচরা বিপণন প্রতিষ্ঠান—যার মেক্সিকো ও আর্জেন্টিনায় রয়েছে দুই হাজারেরও বেশি স্টোর রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বের নানা দেশ থেকে পোশাক, ইলেকট্রনিকস, আসবাব, গৃহস্থালি সামগ্রী ও প্রসাধনী আমদানি করে। রাষ্ট্রদূতের আমন্ত্রণে কোপেলের প্রতিনিধি মারিয়া এলেনা ক্যাস্টিলো সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরে আসেন।
তিনি ঢাকায় এসে সাভারের আল মুসলিম গ্রুপের উৎপাদন ইউনিট পরিদর্শন করেন এবং বাংলাদেশের তৈরি পোশাক দেখে মুগ্ধ হন।তিনি বলেন—“বাংলাদেশের তৈরি পোশাক আন্তর্জাতিক মানের, দামে সাশ্রয়ী এবং রাজনৈতিকভাবে দেশটি স্থিতিশীল। আমরা ল্যাটিন আমেরিকার বাজারে বাংলাদেশি পণ্য নিয়ে যেতে চাই।”
আল মুসলিম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মুসলিম বলেন, “ল্যাটিন আমেরিকার বাজার জনবহুল ও অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রদূত মুশফিকুল ফজল আনসারীর সক্রিয় সহযোগিতা ছাড়া এ রকম উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হতো না।
বাংলাদেশের ওষুধ এখন বিশ্বের ১৫০টিরও বেশি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। রাষ্ট্রদূত মুশফিকুল ফজল আনসারী বিশ্বাস করেন, ল্যাটিন আমেরিকাও এই তালিকায় যুক্ত হতে পারে শিগগিরই। কারণ—ইকুয়েডর প্রতিবছর প্রায় ১.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের ওষুধ আমদানি করে, যা দেশটির মোট চাহিদার প্রায় ৮০%। মেক্সিকো, ল্যাটিন আমেরিকার দ্বিতীয় বৃহত্তম ফার্মাসিউটিক্যাল বাজার, প্রতিবছর প্রায় ৬.৪৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের ওষুধ আমদানি করে। বাংলাদেশের ওষুধ মানসম্মত, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এবং দামে তুলনামূলক কম। তাই রাষ্ট্রদূতের দৃষ্টি এখন সেই সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার দিকে—যাতে বাংলাদেশের ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্প ল্যাটিন আমেরিকার বাজারে নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে পারে।
অর্থনৈতিক কূটনীতির পাশাপাশি মুশফিকুল ফজল আনসারী প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক জোরদার করেছেন। তিনি প্রবাসী সম্প্রদায়ের জন্য আয়োজন করেছেন ব্যবসা-বিনিয়োগ সংক্রান্ত সেমিনার, সাংস্কৃতিক উৎসব এবং বাংলাদেশি পণ্যের প্রদর্শনী। তাঁর মতে—“বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শক্তি প্রবাসী সম্প্রদায়। তাদের মাধ্যমে আমরা অর্থনীতি ও সংস্কৃতিকে একইসঙ্গে বিশ্বে তুলে ধরতে পারি।”
মেক্সিকো সিটিতে তাঁর উদ্যোগে আয়োজিত “বাংলাদেশ নাইট” ও “মেড ইন বাংলাদেশ” প্রদর্শনী স্থানীয় গণমাধ্যমে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। এই অনুষ্ঠানগুলো বাংলাদেশের সংস্কৃতি, কারুশিল্প ও উদ্যোক্তাদের আন্তর্জাতিক পরিসরে নতুনভাবে পরিচিত করেছে।
রাষ্ট্রদূত আনসারীর কূটনীতি প্রমাণ করেছে—“কূটনীতি এখন শুধু নোট ভার্বাল বা রাষ্ট্রীয় ভিজিটের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এটি হতে পারে উন্নয়ন, কর্মসংস্থান এবং মানবিক সহযোগিতার বাস্তব হাতিয়ার।”
তিনি প্রতিটি বৈঠকে, প্রতিটি আলোচনায় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে তুলে ধরছেন নতুনভাবে। ল্যাটিন আমেরিকার শিল্প উদ্যোক্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ, ব্যবসায়িক ফোরাম আয়োজন, এবং বিনিয়োগ উৎসাহিত করা—সব কিছুতেই তাঁর ভূমিকা প্রশংসনীয়।
মুশফিকুল ফজল আনসারী শুধু একজন কূটনীতিক নন; তিনি আধুনিক বাংলাদেশের এক দূরদর্শী প্রতিনিধি, যিনি প্রমাণ করেছেন—রাষ্ট্রপ্রেম, অর্থনৈতিক চিন্তা ও মানবিকতা মিলেই গড়ে ওঠে সার্থক কূটনীতি। তাঁর প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কূটনীতি পেয়েছে নতুন গতি, নতুন দিশা। তিনি দেখিয়েছেন, “যেখানে রাষ্ট্রদূতরা শুধু দেশের ভাবমূর্তি নয়, দেশের অর্থনীতিকেও প্রতিনিধিত্ব করেন—সেখানেই জন্ম নেয় নতুন বাংলাদেশ।”
ভবিষ্যতের কূটনীতিকদের জন্য তিনি হয়ে উঠেছেন এক অনুকরণীয় উদাহরণ—একজন রাষ্ট্রদূত, যিনি কেবল কথা নয়, কর্মের মাধ্যমেই বিশ্বকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন এক উদীয়মান বাংলাদেশের সঙ্গে। রাষ্ট্রদূত মুশফিকুল ফজল আনসারী অর্থনৈতিক কূটনীতিকে দিয়েছেন নতুন দৃষ্টিভঙ্গি—যেখানে কূটনীতি মানে শুধু আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক নয়, বরং বাণিজ্য, বিনিয়োগ, সংস্কৃতি ও মানবিকতার এক সমন্বিত প্রয়াস।তিনি দেখিয়েছেন, রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিত্ব তখনই সফল হয়, যখন তা দেশের অর্থনৈতিক শক্তিকে বিশ্বের সঙ্গে সংযুক্ত করে, আর প্রতিটি রাষ্ট্রদূত নিজের অবস্থান থেকে দেশের উদ্যোক্তা, শ্রমিক ও প্রবাসীদের স্বার্থ রক্ষায় সেতুবন্ধনের ভূমিকা পালন করেন।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য তাঁর এই দৃষ্টান্ত সত্যিই অনুকরণীয়। যদি প্রতিটি রাষ্ট্রদূত একইভাবে অর্থনৈতিক সম্ভাবনা, বিনিয়োগবান্ধব সম্পর্ক ও মানবিক কূটনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যান—তবে অচিরেই গড়ে উঠবে এক সমৃদ্ধ, মর্যাদাবান ও মানবিক নতুন বাংলাদেশ, যেখানে কূটনীতি হবে উন্নয়নের চালিকা শক্তি, আর রাষ্ট্রদূত হবেন সত্যিকার অর্থে জাতির দূরদর্শী স্থপতি।






