মেধা বিকাশের শুরুতেই ঝড়ে পরার তালিকায় হাওরপাড়ে শিশু শিক্ষার্থীরা
হাওর বেষ্টিত সুনামগঞ্জ জেলা। এ জেলার হাওরাঞ্চলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে শিক্ষক সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। শিক্ষক সংকটের কারনে যেমন পাঠ্যদান করা যাচ্ছে না, একেই সাথে প্রধান শিক্ষক না থাকায় স্কুলগুলো অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছে।
এদিকে হাওরপাড়ের শিক্ষার্থীদের পরিবার গুলো আর্থিক সংকটের কারনে ভাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে পড়াশুনাও করতে পারছে না। এতে করে মেধা বিকাশের শুরুতেই ঝড়ে পরার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত হওয়ায়,শিশুদের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন হাওর পাড়ের অভিভাবকগন। দুর্গম যাতায়াত ব্যবস্থা, অবকাঠামো উন্নয়ন না হওয়া, সামাজিক অসচেতনতা, শিক্ষক সংকটসহ নানা কারণ পেছনে দায়ি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে ১৪৭৫টি। এসব বিদ্যালয়ে ২ লাখ ৯১ হাজার ৩ শত ৫৩ শিক্ষার্থী রয়েছে। আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সৃষ্ট পদের বিপরীতে প্রধান শিক্ষক ৩৮৯ ও সহকারী শিক্ষক মিলে ১ হাজার ২৮টি পদ শূন্য রয়েছে। ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব দিয়ে চালানো হচ্ছে দাপ্তরিক ও প্রাতিষ্ঠানিক কাজ। এছাড়াও প্রশিক্ষণ ও বদলি জনিত কারণে অর্ধশতাধিক বিদ্যালয়ে দুই থেকে তিন জন শিক্ষক দিয়ে আবার কোথাও কোথাও একজন শিক্ষক দিয়ে চলছে পাঠদান কার্যক্রম। শিক্ষক সংকট দূর করনে অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে অতিরিক্ত দায়িত্বে শিক্ষক নিয়ে এসে পাঠ্যদান কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখায় সার্বিক শিক্ষা ব্যবস্থার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
শাকিল আহমেদ, জামিল রহমানসহ জেলার সচেতন মহল বলছেন, সকল শিক্ষকগনেই নিজ নিজ সুবিধা জনক অবস্থান উপজেলা বা জেলা শহর এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল সেই সব স্কুল গুলোতে থাকতে চায় আর সে কারনে নিয়োগ পাওয়ার পর যোগদান করেই বদলী হয় সুবিধা জনক স্কুলে। কিন্তু হাওর পাড়ের শিশু শিক্ষার্থীদের দিকে কারো কোনো ভাবনা নেই। আর এ কারনেই হাওর পাড়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক সংকট প্রকট আকার ধারন করছে।
হাওর পাড়ে অভিভাবকগনের সাথে কথা বলে তারা জানায়, শিশু শিক্ষার্থীদের শিক্ষার শুরুটাই শুরু হয় প্রাথমিক বিদ্যালয় দিয়ে সেখানেই যত সমস্যা। হাওর পাড়ের বিদ্যালয় গুলোতে আসা যাওয়ার সড়ক নেই,বর্ষায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্কুলে যায় শিশু শিক্ষার্থীরা। কিন্তু শিক্ষক না থাকায় লেখা পড়া হয় না। আর যে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষক আছে,তারাও নিয়মিত বিদ্যালয়ে না আসায় এবং শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কঠোর মনিটরিং না করার কারনে পিছিয়ে রয়েছে শিক্ষা ব্যবস্থা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে,জেলার তাহিরপুর উপজেলার টাঙ্গুয়ার হাওরপাড় ঘেঁষে স্থাপিত মন্দিয়াতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টিতে প্রাক প্রাথমিক থেকে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত দেড় শতাধিক ছাত্রছাত্রী রয়েছে। ১৯৫২সালে থেকে অনুমোদিত ৫ জন শিক্ষকের পদ থাকলেও প্রধান শিক্ষক ও সহকারী প্রধান শিক্ষকের পদটি পুরন হয়নি। আর বর্তমানে ১ জন শিক্ষক দিয়ে চলছে বিদ্যালয়ের পাঠদান। এ অবস্থার কারনে পাঠদান কার্যক্রম একা চালাতে হিসসিম খাচ্ছেন এমনকি আগত শিশু শিক্ষার্থীদের সামাল দেয়াই কঠিন হয়ে পড়েছে।
শিক্ষক সংকটের কারনে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রতি বছরেই কমছে বলে জানিয়েছেন ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক সানজু মিয়া। শুধু এই স্কুলেটিই নয় জেলার বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর,জামালগঞ্জ,ধর্মপাশা,মধ্যনগর উপজেলা সহ বিভিন্ন উপজেলার প্রাথমিক বিদ্যালয় গুলোতে শিক্ষক সংকটে অচল অবস্থা চলছে বছরের পর বছর ধরে।
টাংগুয়ার হাওর পাড়ে অভিভাবক শফিক মিয়া বলেন, আমরা গরীব মানুষ। আয় কম, জীবনযাপন করাই কঠিন, সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছেলে মেয়েদের পাঠাই, কিন্তু শিক্ষক সংকট থাকায় পাঠ্যদান হচ্ছে না। এ কারনে ছেলে মেয়েরাও স্কুলেও যেতে চায় না, স্কুল বিমুখ হচ্ছে। অর্থের অভাবে ভাল প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করাতেও পারবো না।
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা খরচার হাওর পাড়ে বাসিন্দা ও শিক্ষার্থী অভিভাবক শাহ আলী, কলিম উদ্দিনসহ অনেকেই বলেন, সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় গুলোতে শিক্ষক না থাকায় পড়া শুনা হয় না। আর পুরুষ শিক্ষক নিয়োগে বেশী অগ্রাধিকার দিলে দুর্গম ও হাওর এলাকায় পাঠানো ও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কাজে লাগানো সহজ হবে, যা মহিলা শিক্ষককে দিয়ে হয় না।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা মোহন লাল দাশ জানান, হাওর এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে শিক্ষক সংকট নিরসনে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগন অবগত আছেন। শিক্ষক সংকটের কারণে হাওর এলাকায় শিক্ষক দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। নতুন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হবে খুব শ্রীর্ঘই আর নিয়োগ দেয়া হলেই এর সমাধান করা হবে।