স্মার্টনেস ও জনস্বাস্থ্যবিদদের নৈতিক বিকাশ
আমাদের সমাজে “স্মার্টনেস” শব্দটির ব্যবহার নিয়ে একটা বড় ভুল ধারণা রয়েছে। অনেকেই মনে করেন, দামি পোশাক, আধুনিক গ্যাজেট, বা আভিজাত্যপূর্ণ জীবনযাপনই স্মার্টনেসের প্রতীক। বাস্তবে বিষয়টি একেবারেই আলাদা। প্রকৃত স্মার্টনেস হলো পরিস্থিতি অনুযায়ী নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতা। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে মানিয়ে চলা, তাদের কষ্ট ও অভিজ্ঞতা উপলব্ধি করা এবং সেই অনুযায়ী আচরণ করাই আসল স্মার্টনেস। অর্থ-সম্পদ থাকলেও সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশতে না পারলে তাকে স্মার্ট বলা যাবে না।
জনস্বাস্থ্যবিদদের জন্য এই শিক্ষা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। জনস্বাস্থ্য কোনো কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ কাজ নয়। এটি মাঠের কাজ, মানুষের জীবনের সাথে মিশে থাকার কাজ। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রাম, পাহাড়, চরাঞ্চল কিংবা উপকূলীয় এলাকার অসংখ্য মানুষ এখনো প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার ন্যূনতম সুযোগ থেকেও বঞ্চিত। একজন জনস্বাস্থ্যবিদ যদি সত্যিকারের পরিবর্তন আনতে চান, তবে তাঁকে অবশ্যই সেই অজপাড়া গাঁয় যেতে হবে। সেখানকার মানুষকে শোনা, তাদের জীবনসংগ্রাম বোঝা এবং তাদের পাশে দাঁড়ানোই তাঁর দায়িত্ব। কষ্ট দেখে নাক সিঁটকালে বা দূর থেকে পরামর্শ দিলেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না।
এখানেই আসে নৈতিক বিকাশের প্রশ্ন। একজন জনস্বাস্থ্যবিদের শিক্ষা, দক্ষতা বা গবেষণা তখনই অর্থবহ হয়, যখন তা মানুষের বা¯ত্মব জীবনে কাজে লাগে। গবেষণা শুধু সম্মেলনের টেবিলে আলোচনার বিষয় হলে কোনো লাভ নেই। দরকার মানুষের জীবনমান উন্নয়ন। এজন্য প্রয়োজন মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি। গরিব বা প্রান্তিক মানুষকে অবহেলা করলে জনস্বাস্থ্যবিজ্ঞানের মৌলিক লক্ষ্য সবার জন্য সমান স্বাস্থ্য অধিকার ধূলিসাৎ হয়ে যাবে।
আজও স্বাস্থ্যসেবায় বৈষম্য আমাদের চোখে পড়ে। শহরের মানুষ সহজেই চিকিৎসা সুবিধা পায়, অথচ গ্রামীণ মানুষ সামান্য অসুখের চিকিৎসার জন্যও হাহাকার করে। এই বৈষম্য দূর করাই জনস্বাস্থ্যবিদদের প্রকৃত চ্যালেঞ্জ। এখানে স্মার্টনেস মানে হলো প্রযুক্তি জ্ঞান কিংবা বাহ্যিক চাকচিক্য নয়; বরং যে কোনো পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেয়া এবং মানুষের আস্থা অর্জন করা। মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এই সক্ষমতাই একজন জনস্বাস্থ্যবিদের পেশাগত এবং নৈতিক উৎকর্ষের প্রমাণ।
তাই বলা যায়, জনস্বাস্থ্যবিদদের জন্য স্মার্টনেস হলো মানবিকতা-ভিত্তিক এক জীবনদর্শন। এটি শেখায়, প্রতিটি মানুষ সমান মর্যাদার অধিকারী। এটি মনে করিয়ে দেয়, স্বাস্থ্যসেবার ন্যায্য প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হলে প্রত্যন্ত গ্রামের কৃষকের ঘরেও যেতে হবে, ক্ষুধার্ত শিশুর কান্নার প্রতিধ্বনি শুনতে হবে। এভাবেই গড়ে উঠবে নৈতিকভাবে পরিপূর্ণ, সত্যিকার অর্থে স্মার্ট জনস্বাস্থ্যবিদ।
শেষকথা, আমাদের সমাজে এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন এমন জনস্বাস্থ্যবিদ, যারা কেবল পেশাগত দক্ষতায় নয়, বরং নৈতিক বিকাশ ও মানবিকতায় সমৃদ্ধ। তারা যদি সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবার সমান সুযোগ তৈরি করতে পারেন, তবে একদিন গড়ে উঠবে একটি বৈষম্যহীন, ন্যায়সঙ্গত ও সুস্থ বাংলাদেশ।
মোহাম্মদ মেসবাহউর রহমান
লেখক: জনস্বাস্থ্য গবেষক, সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান,বায়োস্ট্যাটিস্টিক্স বিভাগ, নিপসম, মহাখালী, ঢাকা।